যেমন ছিলো ২০১৯ সালের সিনেমাপাড়া
এবারও ঘটনাবহুল ছিলো ঢাকার সিনেমা জগত। একটা সময় বছর বছর সিনেমা নির্মাণ সংখ্যা বাড়ত এবং এখন বছর বছর সিনেমা নির্মাণ কমছে। একটার পর একটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল।
তারপরও শিল্পী ও সিনেমা সংশ্লিষ্টরা ব্যস্ত সময় পার করেছেন, তবে অভিনয়ের পেছনে নয়, সংগঠনের পেছনে। বছরজুড়ে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি ব্যবসায়িক সফলতা পেলেও প্রশংসা পেয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমা। কিছু সিনেমা বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে।
সিনেমা জগতের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। আবার এসেছে নতুন মুখও। এককভাবে রাজত্ব করে গেছেন একজন নায়ক। বছরের সিনেমাপাড়ার সব খবর জানতে দ্য ডেইলি স্টারের এই আয়োজন।
সিনেমা কমার রেকর্ড: এক সময় ঢাকায় বছরে মুক্তি পেতো কয়েকশ সিনেমা। সেই জৌলুস আর নেই। দিন দিন কমছে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে গেলো কয়েক বছর ধরে। তবে, সবচেয়ে কম সংখ্যক অর্থাৎ রেকর্ড করার মতো হতাশাজনক খবর হচ্ছে ২০১৯ সালে মোট মুক্তি পাওয়া সিনেমার সংখ্যা হচ্ছে ৪০টি। এছাড়াও, আমদানিকৃত কয়েকটি সিনেমাও মুক্তি পেয়েছে।
বেড়েছে অনুদানের টাকা: সিনেমা নির্মাণ কমলেও এবং সিনেমার দর্শক কমে গেলেও সরকার কর্তৃক অনুদানের টাকার পরিমাণ বেড়েছে। এক সময় অনুদান পাওয়া যেতো ত্রিশ লাখ টাকা। এরপর তা সামান্য বাড়ানো হয়। আশার কথা হচ্ছে, এবছর অনুদানের টাকার পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ানো হয়েছে। এই বছর থেকে যারা অনুদান পাবেন, তাদের একটি সিনেমার জন্য দেওয়া হবে এক কোটি টাকা।
বিদেশে প্রশংসিত ফারুকীর সিনেমা: মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব প্রতিযোগিতায় প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়াও, সিডনী চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে এই সিনেমাটি। খ্যাতিমান এই পরিচালক ‘ব্রিজ টু হলিউড’র প্রশিক্ষক হিসেবে নাম লেখান। তিনি নতুন সিনেমা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’র শুটিং শুরু করেছেন দেশের বাইরে।
চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত নীতিমালা: চলতি বছর চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত নীতিমালা হয়েছে। এই নীতিমালার আওতায় রয়েছে অনেককিছু। তার মধ্যে অন্যতম রয়েছে, শুটিং স্পটে কোনো শিল্পী দেরী করে উপস্থিত হলে তাকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে সরব সংগঠনগুলো: ২০১৯ সালে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সংগঠনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, সিনেমা তৈরির সংখ্যা কমে গেলেও সংগঠন এবং এর নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড় বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। কোনো কোনো শিল্পীকে অভিনয়ে নয়, নির্বাচন আর সংগঠন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন তার মধ্যে একটি। টানা দ্বিতীয়বারের মতো এই সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছেন মিশা ও জায়েদ খানের প্যানেল। এবছর অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচনও।
ভরসা শাকিব খান: টানা ২০ বছর ধরে শাকিব খান অভিনয় করছেন ঢাকাই সিনেমায়। এখনো ঢাকাই সিনেমায় একমাত্র ভরসা করার মতো নায়ক তিনি। গত বেশ কয়েকবছর ধরে তার একক রাজত্ব চলছে সিনেমায়। ২০১৯ সালটাও তেমনিভাবে রাজত্ব করেছেন তিনি। তার অভিনীত কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ও চলতি বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাসওয়ার্ড’ ভালো ব্যবসা করেছে। এবছর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে একসঙ্গে তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে চারটি নতুন সিনেমা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
আশা জাগিয়েছে কিছু সিনেমা: বছরজুড়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবসা করতে পারেনি। অনেক সিনেমাই লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। তারপরও কিছু সিনেমা সুধী মহলে প্রশংসিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমাটি সব শ্রেণির দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে। ‘সাপলুডু’ ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘মায়াবতী’ এবং ‘যদি একদিন সিনেমা’সহ আরও কিছু সিনেমা, যা আশা জাগিয়েছে নতুন করে।
একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ: ধারাবাহিকভাবে গত কয়েকবছর ধরে সিনেমা হল বন্ধ হতে চলেছে। এবছরও সারাদেশে বেশ কয়েকটি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে সেখানে শপিংমল নির্মাণ করা হয়েছে। এ বছর ঢাকা শহরে সব শেষ বন্ধ হয়ে গেছে রাজমনি সিনেমা হলটি। তবে, সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার সংখ্যাটা বাড়লেও বাড়ছে সিনেপ্লেকসের সংখ্যা। সবশেষ এই বছর মহাখালীতে সিনেপ্লেকসের তৃতীয় শাখার উদ্বোধন করা হয়েছে।
হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো সারাদেশের সিনেমা হল: ঢাকাই সিনেমার এবছরের নানা ঘটনার মধ্যে বড় একটি ঘটনা হচ্ছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি ১২ এপ্রিল থেকে একযোগে সিনেমা হল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলো সংবাদ সম্মেলন করে। কয়েক দিন বন্ধও ছিলো। শেষে হল মালিক কর্তৃপক্ষ তাদের ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেয়।
জয়ার জয়-জয়কার: কোনো কোনো সিনেমার তারকা সারাবছর কাজ করেছেন। কেউ আবার বেকারও থেকেছেন। বছরজুড়ে কাজ করা তারকাদের অন্যতম জয়া আহসান। দেশের চেয়ে ভারতে এবছর সিনেমা বেশি করেছেন তিনি। ভারতে জয়ার একাধিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ভারতে তিনি এবছর সবশেষ অভিনয় করেছেন ‘রবিবার’ সিনেমায়।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রত্যাখ্যান: সিনেমার শিল্পীদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ পুরস্কার আগেও কয়েকজন শিল্পী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০১৯ সালে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন মোশাররফ করিম।
ছোটপর্দার পরিচালকরা এবছরও বড়পর্দার জন্য কাজ করেছেন: গিয়াসউদ্দিন সেলিম মূলত নাট্যপরিচালক। যদিও ‘মনপুরা’ তৈরি করে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে ব্যাপক সফলতা পান। তিনি এবছর ‘পাপ পুণ্য’ নামে নতুন সিনেমার শুটিং করেছেন। চয়নিকা চৌধুরী ছোটপর্দার আরেক সফল পরিচালক। এবছর তিনি প্রথমবার সিনেমা পরিচালনা করেছেন। সিনেমাটির নাম ‘বিশ্বসুন্দরী’। মেজবাউর রহমান সুমন ছোটপর্দার পরিচালক। তিনিও এবছর নির্মাণ করেছেন ‘হাওয়া’ নামে একটি সিনেমা। নাদের চৌধুরীও রয়েছেন এই তালিকায়। আরও কয়েকজন ছোটপর্দার পরিচালক এবছর সিনেমা তৈরি করেছেন।
আলোচনায় তারা: শাকিব খানের পর সেই অর্থে বলতে গেলে খুব বেশি নায়ককে আলোচনায় দেখা যায়নি। তবে, সিয়াম আহমেদ ‘ফাগুন হাওয়ায়’ অভিনয় করে আলোচনায় ছিলেন। আরিফিন শুভ আলোচনায় ছিলেন ‘সাপলুডু’তে অভিনয় করে। এছাড়াও, চিত্রনায়ক নিরব ‘আব্বাস’ সিনেমাটি করে আলোচনায় ছিলেন। ভিলেন হিসেবে তাসকিন রহমানও ছিলেন আলোচনায়। গায়ক তাহসান ‘যদি একদিন সিনেমা’ করে আলোচনায় ছিলেন।
সিনেমা থেকে দূরে: ২০১৯ সালে শাবনূরকে নতুন কোনো সিনেমায় দেখা যায়নি। নায়ক রিয়াজও সিনেমা থেকে অনেকটাই দূরে ছিলেন বছরজুড়ে। বছর শেষে অবশ্য ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমায় একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিয়াজ।
ঢাকাই সিনেমার আরও কিছু ঘটনা: ২০১৯ সালে ঢাকাই সিনেমায় ঘটে গেছে আরও কিছু ঘটনা। অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। নতুন নায়িকা এসেছেন কয়েকজন। তার মধ্যে একজন হচ্ছেন জাহারা মিতু। প্রথম সিনেমায় নায়ক হিসেবে পেয়েছেন শাকিব খানকে। নায়ক মান্নার স্ত্রী একসময়ের চিত্রনায়িকা শেলী মান্না অনেকদিন পর নতুন করে সিনেমা প্রযোজনায় এসেছেন। বিরতির পর পূর্ণিমা নতুন করে সিনেমায় ফিরেছেন।
নায়ক ফেরদৌস ভারতীয় সরকার কর্তৃক ভিসা বাতিল হওয়ায় সেদেশের সবধরনের সিনেমার শুটিং বন্ধ রেখেছেন। পূর্ণিমা, মাহী, আরিফিন শুভসহ বেশ কয়েকজন তারকার ফেসবুক হ্যাকড হয়েছিলো এ বছর। সিনেমাপাড়া হিসেবে খ্যাত কাকরাইলে প্রযোজকদের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে এ বছর। বছরের শেষের দিকে নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে কিছু পোস্টার ও ব্যানার দিয়ে তাকে নিয়ে সমালোচনা করে কে বা কারা। এর প্রতিবাদে রাজপথে মিছিল পর্যন্ত করেছেন চলচ্চিত্র শিল্পীরা। অন্যদিকে বছরজুড়ে মহরত অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন সিনেমার।
Comments