এই মরণযাত্রা বন্ধ হোক, যাক দক্ষ কর্মী
৯ মে, ২০১৯। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর আশি জন মানুষ, যাদের মধ্যে অর্ধশতই বাংলাদেশি। ছোট্ট একটি নৌকায় শুরু সেই যাত্রা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপ্নের সেই যাত্রা হয়ে উঠলো মরণযাত্রা। তিউনিসিয়ার উপকূলে ঢেউয়ের তোড়ে নৌকাটি উল্টে গেলো। মারা গেলো অন্তত ৩৯ বাংলাদেশি।
চোখের সামনে একে একে সেদিন সহযাত্রীদের মৃত্যু যাদের দেখতে হয়েছিলো, তাদের একজন সুনামগঞ্জের আব্দুল মতিন। মতিনসহ ১৫ বাংলাদেশি সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে তীব্র ঠাণ্ডা পানিতে আট ঘণ্টা ভেসে ছিলেন। আর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বিল্লাল তো চোখের সামনে দেখলেন, নৌকায় তার দুই ভাতিজা ও ভাগনে সাগরে ডুবে মারা গেলো। সিলেটের গোলাপগঞ্জের মাহফুজ আহমেদ দেখলেন, চোখের সামনে মারা গেলো তার আপন দুই ভাই।
ঢাকায় ফিরে শাহজালাল বিমানবন্দরে তারা বলছিলেন, “আমরা যে আশি জনের মতো ছিলাম, প্রতি পাঁচ মিনিটে যেনো একজন করে লোক হারিয়ে যাচ্ছিলো। এভাবে একজন একজন করে অনেক লোক হারালাম। আমরা রইলাম আর অল্প কয়েকজন। হঠাৎ দেখি একটা মাছ ধরার ট্রলার। আমাদের হাত পা আর চলছিলো না। আমরা সবাই মিলে ‘হেল্প, হেল্প’ বলে চিৎকার করছিলাম। আর যদি দশ মিনিট দেরি হতো আমরা সবাই মারা যেতাম।”
মতিন, মাহফুজদের কথা শুনতে শুনতে স্মৃতিতে আসছিলো ২০১৫ সালের ২৭ আগস্টের কথা। লিবিয়ার জোয়ার সাহারা থেকে সেদিন নৌকায় করে ইতালির পথে রওনা হয়েছিলেন ২০০ মানুষ। ৩৮ ঘণ্টা ধরে নৌকা চলছিলো। হঠাৎ পাটাতনে পানি চলে আসায় নৌকা ডুবে যেতে থাকে। শেষ মুহূর্তে কোস্টগার্ড এসে উদ্ধার করায় বেঁচে যান বাংলাদেশের মাগুরার ছেলে রুবেল শেখ। ২৪ জন বাংলাদেশিসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়, যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। কোস্টগার্ড পরে ট্রলারে থাকা জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আর ট্রলারের পাটাতনের নীচ থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশিসহ অর্ধশত লাশ। ইঞ্জিনের গরমে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছিলেন বেঁচে যাওয়া রুবেল শেখ।
সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৫ সালে নিহত সিরিয় শিশু আয়লানের ছবি সবাইকে কাঁদিয়েছিলো। কিন্তু আমরা কতোজন জানি লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশি শিশু ইউসুফের কথা? ওই দুর্ঘটনায় বাবা রমজান আলীর সঙ্গে ইউসুফের লাশটি সেদিন ভেসে গিয়েছিলো ভূমধ্যসাগরে। একই দুর্ঘটনার ঘটনায় নিহত বাংলাদেশিদের একজন শাহাদাতের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। শাহাদাতের মা বকুল আক্তার আমাকে আহাজারি করে বলেছিলেন, “আমার একটাই ছেলে। ওর বাপও সৌদিতে থাকে। আমরা সবাই শাহাদাতকে না করেছিলাম এভাবে যেতে। ওর বাবাও বলেছে, তুই আমার একটাই ছেলে, যাইস না। কিন্তু ছেলেটা আমার পৃথিবী থেকেই চলে গেলো। আমি কী নিয়ে বাঁচবো?”
এই ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোয় যে সংবাদটি করেছিলাম তার শিরোনাম ছিলো, ‘মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালির পথে’। ছেলে হারানোর চারবছর পেরিয়ে গেলেও শাহাদাতের মায়ের সেই আহাজারি আজও থামেনি। কিন্তু সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে মতিন বা রুবেলদের ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাও বন্ধ হয়নি।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিয়মিত এই ধরনের ঘটনা শুনতে হয়। শুধু কী ইউরোপ? যেকোনো মূল্যে বিদেশ যাওয়ার এই চেষ্টাকে প্রায়ই মনে হয় মরণযাত্রা।
এই তো মে মাসে ৩৯ জনের মৃত্যুর ঘটনার এক মাস পরেই জানা গেলো, ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় ৬৪ জন বাংলাদেশিসহ ৭৫ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী ১৪ দিন ধরে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকায় ভাসছেন। শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্থান সঙ্কটের কারণ দেখিয়ে নৌকাটিকে তীরে ভিড়তে দেয়নি তিউনিসিয়া। এ বছরের নভেম্বর মাসেও ভূমধ্যসাগর থেকে ২০০ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে ১৭১ জন ছিলেন বাংলাদেশি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএমের ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ঢোকার চেষ্টা করেছে যেসব দেশের নাগরিকেরা, বাংলাদেশিরা রয়েছেন সেরকম প্রথম পাঁচটি দেশের তালিকায়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যতো মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করা চেষ্টা করে, সেই তালিকায় বাংলাদেশও আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যে দেশগুলো শীর্ষ তালিকায় আছে সেগুলো হলো– সিরিয়া, নাইজেরিয়া, গায়ানা, আইভরি কোস্ট, মরক্কো, ইরাক, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া এবং গাম্বিয়া। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের নাগরিকরা কেনো আফ্রিকা বা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিকদের সঙ্গে এভাবে সাগর পাড়ি দিচ্ছে?
লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেই দেশে ফিরে বলছেন, ঢাকা থেকে লিবিয়া বা তুরস্ক যেতে একজনকে দশ হাজার ডলারের বেশি অর্থ দিতে হয়। এরপর একটি চক্র ঢাকা থেকে তাদের দুবাই বা তুরস্কে নেয়। পরে বিমানে করে লিবিয়া পৌঁছান তারা। সেখান থেকে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এইভাবে বিদেশে গেলে পরণতি ভয়াবহ। মৃত্যুর আশঙ্কা তো আছেই, বেঁচে থাকলেও যেতে হবে জেলে।
অনেক বাংলাদেশিরই জানা নেই, ইউরোপের পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। ইউরোপ এখন আর অবৈধভাবে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, বরং কাগজপত্রহীন মানুষগুলোকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই তো বছর বছর তিনেক আগে ইউরোপ তো বলেই বসলো, অবৈধ এ সমস্ত লোকজনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা না হলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যথাযথ কাগজপত্রবিহীন মানুষগুলোকে এখন ইউরোপ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এজন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-র অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী ইউরোপ থেকে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত আনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এগুলো দেশের জন্য খুবই অস্বস্তিকর।
সিরিয়া, লিবিয়ায় না হয় যুদ্ধ চলছে, তাই সেখানকার নাগরিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুমদ্রপথ পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশিরা কেনো জীবনের এত ঝুঁকি নিচ্ছেন? শুধুই কি ভাগ্য অন্বেষণ, নাকি যে কোনোভাবে বিদেশে যাওয়ার নেশা। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে যে জরিপ করেছে, তাতে দেখা গেছে- আরও ভালো জীবনযাপন এবং পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণই নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এসব তরুণ মনে করেন না যে- নিজের দেশে তাদের ভবিষ্যৎ আছে। তাছাড়া এমনিতেই বাংলাদেশিদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ভয়াবহ। তারা মনে করেন- বিদেশে গেলে ভাগ্য বদলে যাবে। অনেকের ভাগ্য বদলাচ্ছে সেটাও সত্য। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতি তো বদলাচ্ছেই।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত চার দশকে এক কোটি বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। তারা প্রতি বছর ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরও দেশে এক হাজার ৫৫৮ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। প্রবাসীরা প্রতি বছর যে টাকা পাঠাচ্ছেন, সেটা মোট বিদেশি ঋণ বা বিদেশি বিদেশি বিনিয়োগের চেয়ে সাত আটগুণ বেশি।
এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ (রিজার্ভ) ৩৩ বিলিয়ন বা তিন হাজার তিনশ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভের এই অর্জনের মূল কৃতিত্ব প্রবাসীদের। কিন্তু যারা এতো দুঃখ কষ্ট সহ্য করে প্রবাসী আয় পাঠান, তাদের জন্য কতোটা করে রাষ্ট্র? প্রবাসীদের সাধারণ অভিযোগ, বিদেশে যখন তারা নানা বিপদে পড়েন বা কোন কাজে দূতাবাসে যান, প্রায়ই সময়ই তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয় না। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে বিমানবন্দরেও আছে নানা ভোগান্তি। সেগুলোও বন্ধ করতে হবে।
ইতিবাচক পরিসংখ্যান সবসময়ই ভালো লাগে। এক কোটি লোক দেশের বাইরে, এক হাজার ৫৫৮ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় সবই ইতিবাচক খবর। আমরা সবাই জানি, ২০১৭ সালে বিদেশে কর্মসংস্থানে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ওই বছর ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। কিন্তু অস্বস্তির খবর হলো, ওই বছরেরই ৫ মে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট একটি সংবাদ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিলো ‘বাংলাদেশ ইজ নাও দ্য সিঙ্গেল বিগেস্ট কান্ট্রি অব অরিজিন ফর রিফিউজিস অন বোটস এজ নিউরুট টু ইউরোপ এমারজেস’।
ওই সংবাদে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়াসহ ইউরোপে কীভাবে অবৈধ বাংলাদেশিরা প্রবেশ করছে, তার তথ্য তুলে ধরা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক অথবা সাব-সাহারা অঞ্চলের কিছু দেশের অধিবাসীরা না হয় অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশিরা হাজার মাইল দুরের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার এই পথ কেনো বেছে নিচ্ছেন?
আসলে শুধু ইউরোপ নয়, দক্ষিণ অফ্রিকা কিংবা মালয়েশিয়া যেতেও বাংলাদেশিরা নানাভাবে জীবনের ঝুঁকি নেয়, কারণ বিদেশের স্বপ্নে বিভোর বহু মানুষ মনে করেন যে- সাগর, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বিদেশে গেলেই মিলে যাবে স্বপ্নের চাবিকাঠি। আর সেটা যদি ইউরোপ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু বিদেশে পাড়ি দেওয়ার এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা দেশের ভাবমূর্তি সংকটে ফেলে। এসব কারণেই দেখা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান নিচে। পরপর তিনবার বাংলাদেশ এখন টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে।
এই তো বছর দুয়েক আগেও সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে খবর হয়েছিলো। মালয়েশিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশিদের সেই গণকবরগুলো দেখতে হয়েছে। কাজেই সেই স্মৃতি ভুলবো কী করে! এই যে বিদেশের স্বপ্নে বিভোরতায় মৃত্যুঝুঁকি নেওয়া, সেই মরণযাত্রা থামাতেই হবে। সেজন্য দরকার নতুন নতুন শ্রমবাজার।
তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের নতুন বাজার খুব বেশি হয়নি। পুরনো বাজারের মধ্যে সৌদি আরবে যারা গেছেন, তাদের সবাই যে ভালো চাকরি পেয়েছেন তাও নয়। তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি মন্দার দিকে। অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়েছে, অনেক বাংলাদেশি কাজ পাচ্ছেন না। অনেকে ফিরে আসছেন। গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীদের অনেকেই নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। এখন বিকল্প বাজার জরুরি। সঙ্গে জরুরি দক্ষতা উন্নয়ন। অদক্ষ লাখ লাখ লোক না পাঠিয়ে দক্ষ লোক পাঠাতে হবে। আর অভিবাসন খরচ কমাতে হবে।
কারণ, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে যে অভিবাসন খরচ, সেটা যেকোনো দেশে থেকে অনেক বেশি। সরকার প্রত্যেকটা দেশের জন্য নির্ধারিত খরচ বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু কাগজে কলমেই সেটা আছে। যারা বিদেশে লোক পাঠায়, তারা অনেক সময়েই বহুগুণ বেশি টাকা নেয়। এর কারণ, বিদেশে যেমন মধ্যসত্ত্বভোগী আছে, দেশেও তেমনি নানা স্তরে দালালদের দৌরাত্ম্য। ফলে আট থেকে দশ লাখ টাকাও লাগে বিদেশে যেতে।
এছাড়া, পদে পদে আছে ভোগান্তি-হয়রানি। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনা-বেচা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র- সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কতো কী। আর প্রবাসে মৃত্যু তো আছেই।
আমরা দেখি প্রতিদিন এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশে যাচ্ছে অনেক লোক, আরেক দিকে কিন্তু প্রতিদিন আট থেকে দশজন প্রবাসীর লাশও আসছে। কফিনে করে কার্গো গেট দিয়ে আসে বলে অনেকেরই সেটা চোখে পড়ে না। এদের কেউ মারা যাচ্ছেন স্ট্রোকে, কেউ বা হার্ট অ্যাটাকে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে প্রায় ৪০ হাজার হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে। এদের অনেকেই ২৮ কিংবা ৩০ বছরেও মারা গেছেন। এছাড়াও, গত সাত বছরে অন্তত দুই লাখ প্রবাসী ফিরে এসেছেন। তাদের কথাও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে বিদেশ থেকে ফিরলে কীভাবে সবাই মিলে তার পাশে ফের দাঁড়ানো যায়।
প্রায় দেড়যুগ ধরে অভিবাসন খাতটা দেখছি। স্বীকার করতেই হবে সরকারের আন্তরিকতা ও চেষ্টার কমতি নেই। এই সরকারের আমলে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য প্রবর্তিত জীবন বিমা কর্মসূচি, প্রবাসী কর্মীদের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের মতো ইতিবাচক অনেক কাজও হয়েছে। কিন্তু তারপরও বলতেই হবে, অভিবাসন খাতের পরিস্থিতি উত্তরণের বহু পথ বাকি। তবে সবার আগে সোনার হরিণের জন্য অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করে, জেনে বুঝে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও খরচ কমাতে হবে। দরকার নতুন শ্রমবাজার, নারীদের সুরক্ষা। বিদেশ থেকে যারা ফেরত আসছেন সফল বা ব্যর্থ হয়ে, তাদের সবার পাশে থাকতে হবে। তবে রাষ্ট্র-দূতাবাস-স্বজন সবাইকে মনে রাখতে হবে- প্রবাসীরা শুধু টাকা পাঠানোর যন্ত্র নয়। তারাও মানুষ। কাজেই সবসময় তাদের মানবিক মর্যাদা দিতে হবে। সেটি শুধু বছরের একটি দিন নয়, সারাবছর তাদের মর্যাদা দিতে হবে। পাশাপাশি সবাই মিলে কাজ করে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বা মরণযাত্রা বন্ধ করতে হবে।
বন্ধ করতে হবে কারণ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় বিশ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন। এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ১৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। কাজেই আমাদের এই মরণযাত্রা থামাতেই হবে। শুধু সমুদ্রপথ নয়, দুর্গম মরুপথে, তুষারপথে ও বনজঙ্গল পার হয়ে বিদেশে যেতে গিয়ে অনেকে জেলে যান। অনেকে মারা যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করতেই হবে।
এতোকিছুর পরেও কোটি লোকের বিদেশে কর্মসংস্থানের খবরটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক। সরকারি-বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতিবছর যে প্রবাসী আয় আসছে, সেটি মোট জাতীয় আয়ের প্রায় দশ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। তবে শুধু কর্মী পাঠানোর সংখ্যা না বাড়িয়ে দক্ষতার দিকেই সবার এখন নজর দিতে হবে। কারণ, যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের অর্ধেকরও বেশি এখনও অদক্ষই। ফলে বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়লেও প্রবাসী আয় সেভাবে বাড়ছে না। সেজন্যই আরও বেশি দক্ষ কর্মী পাঠাতে হবে। এবারের ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের স্লোগানটা তাই অনেক বেশি যৌক্তিক। এবারের স্লোগান- ‘দক্ষ হয়ে বিদেশে গেলে অর্থ ও ও সম্মান দুই মেলে’। আসলেও তাই।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসকে সামনে রেখে আবারও স্যালুট কোটি প্রবাসীকে। কারণ এক কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল সবুজের জন্য ভালোবাসা। কাজেই লাল সবুজের পাসপোর্টধারী এই প্রবাসীদের স্যালুট।
শরিফুল হাসান, এক যুগেরও বেশি অভিবাসন খাত নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। এখন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান।
Comments