মাদ্রিদ জলবায়ু সম্মেলন: প্রত্যাশা প্রাপ্তির বড় ফারাক
এ বছর দাবানলে পুড়েছে আমাজন আর আফ্রিকার হাজার হাজার একর বন। ভারত-জাপানে লু হাওয়ায় প্রভাবে ২০০ জনের বেশি মারা গেছে। সারাবছর জুড়েই একের পর এক সাইক্লোন আঘাত হেনেছে বিভিন্ন উপকুলে। শুধু আফ্রিকা, জাপান আর চীনেই সাইক্লোনে প্রায় ১২০০ লোকের মৃত্যু হয়েছে ২০১৯ সালে। আর বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে অকাল বৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন তো বছর জুড়ে লেগেই আছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের আঘাতে যখন পৃথিবীর প্রত্যেকটি অঞ্চলের মানুষ এ বছর বিপর্যস্ত ছিলো, অনেকেই আশা করেছিলেন বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে বিশ্বনেতৃবৃন্দ এবার হয়তো আন্তরিক হয়ে উদ্যোগ নিবে।
কিন্তু তারপরও মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে দেখা গেলো বিশ্বনেতৃবৃন্দের টনক নড়েনি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর যেমন অনীহা, বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমাতেও তারা ছাড় দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, ২০১৫ সালে নেওয়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যতোটুকু সমঝোতা এসেছিলো, তাও এবার ছিলো ব্যর্থ হবার পথে।
‘টাইম ফর অ্যাকশন’ বা ‘কাজ করার সময় এখনই’ এই শ্লোগান নিয়ে মাদ্রিদে শুরু হওয়া জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা ছিলো গত শুক্রবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের ৪০ ঘণ্টা পরও রোববার বিকাল পর্যন্ত চলেছে দর দরকষাকষি। কিন্তু তাতেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসেনি। সামনের বছরও আবার শুরু করতে হবে একই বিষয়ের আলোচনা, চলবে দর কষাকষি।
এ বছরের শুরুর দিকে জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গ সরকার প্রধানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমরা আপনাদের দিকে নজর রাখছি।” টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ গ্রেটার ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের লাখ লাখ শিশু তাদের ক্লাস বাদ দিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া জুড়ে নেমে এসেছে রাস্তায়। গ্রেটার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাদের অভিভাবকেরাও। দাবি তুলেছে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতকে সুরক্ষা দেওয়ার।
জলবায়ু অধিকার কর্মীরাও বিভিন্ন ফোরামে জোরালো দাবি তুলেছে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য, বিশ্বনেতারা যেনো বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ফলাফল প্রায় শূন্য। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসিসিওপি ২৫) এর ২৫তম শীর্ষ সম্মেলনের পাঁচটি প্রধান লক্ষ্য ছিলো- আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার পুনরায় চালু করা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে যে যে ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে তা মোকাবেলায় অর্থ সংস্থান করা, উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দীর্ঘমেয়াদী অর্থের জন্য একটি পথনির্দেশ বা রোডম্যাপ তৈরি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত দেশগুলোকে দায়বদ্ধ করা এবং সমস্ত জলবায়ু বিষয়ক সমস্ত কর্মকাণ্ডে লিঙ্গ, মানবাধিকার এবং স্থানীয় অধিকারের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা।
দেশগুলো প্রথম চারটি বিষয়ের কোনটিই মেনে নেয়নি। একটি লৈঙ্গিক কর্ম পরিকল্পনা অনুমোদন হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা বিশেষত আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে একমত হতে পারেনি। যদিও তারাই জলবায়ু প্রভাব দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চিলিতে অবরোধ আন্দোলনের কারণে এবারের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনটি শেষ মুহূর্তে সান্টিয়াগো থেকে মাদ্রিদে স্থানান্তরিত হয়েছিলো। কিন্তু এটা চিলি জলবায়ু সম্মেলন নামেই পরিচিত এবং এর সভাপতিত্ব করেছেন চিলির পরিবেশমন্ত্রী ক্যারোলিনা স্মিথ। অধিবেশন শেষে তিনি গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেনে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের পর এমন ব্যর্থ আর কোনো সম্মেলন হয় নাই বলে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন।
জলবায়ু সম্মেলন বার্থ: ব্যর্থতার মানে কী?
ব্যর্থতার অর্থ হলো কোপেনহেগেন শীর্ষ সম্মেলনের ব্যর্থতার পরে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সকলের জন্য ভরসা হয়ে এসেছিলো, যা কী না ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা, অর্থের অভাবে ব্যর্থ হয়ে যেতে বসেছে। কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেশিরভাগ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো নির্ভর করছিলো উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থের উপর। এখন সেই অর্থ শুধু দূর আকাশের তারা হয়ে থাকলো। কিন্তু ভুক্তভোগী দেশগুলো জানে না কোথা থেকে সে অর্থ আসবে, কতো আসবে।
আন্তর্জাতিক কার্বন মার্কেট শুরু করা যাচ্ছে না, কারণ মাদ্রিদে জড়ো হওয়া ১৯৫টি দেশের সরকার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোন পদ্ধতিতে এটা চালু করা যায়, সে বিষয়ে নিয়ে একমত হতে পারেনি। এর ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ কার্বন নিঃসরণ কম করা বা না করার বিনিময়ে উন্নত দেশগুলি থেকে যে নির্দিষ্ট আর্থিক সুবিধা পেতে পারতো, সেটা আর হচ্ছে না। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেরা আর কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে উৎসাহিত হবে না।
প্যারিস এগ্রিমেন্টের আর্টিকেল ৬ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে সম্মেলনে। আলোচনায় কার্বন মার্কেট বিষয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিরা একে অপরকে দোষারোপ করেছেন। উন্নত দেশগুলো চীন এবং ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে ফাঁকিবাজি প্রকল্প গ্রহণ করে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ করেছে।
এদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করেছে, উন্নত দেশগুলো কার্বন বাজার চালুর পথ বন্ধ করে বিশ্বকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের ৪০ ঘণ্টা পর পর্যন্ত প্রতিনিধিরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন, ব্রাজিল এবং ভারতের প্রতিনিধিরা এই বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন, কিন্তু শেষ মিনিট পর্যন্ত আলোচনা করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে তারা পারেননি। আগামী বছর বন-এ অনুষ্ঠিত সম্মেলনের অন্তর্বর্তীকালীন আলোচনায় এবং গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনে এ বিষয়ে আবারও আলোচনা হবে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন এখন যেহেতু প্যারিস চুক্তি ত্যাগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনে জানিয়েছে, মার্কিন প্রতিনিধিদল উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সাহায্য করার ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী অর্থ নিয়ে আলোচনার উৎসাহ দেখায়নি। যদিও ২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০২০ সাল থেকে উন্নত বিশ্ব প্রতিবছর উন্নয়নশীল বিশ্বকে ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করবে।
এমনকি মার্কিন প্রতিনিধি দলটি মাদ্রিদে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশের জন্য ‘লস এন্ড ড্যামেজ’ নামে যে একটি পৃথক ফান্ড গঠনের বিষয়ে বলেছে, যে দেশগুলি প্যারিস চুক্তিটি অনুমোদন করেছে, তারাই এই ‘লস এন্ড ড্যামেজ’ ফান্ডটি তদারকি করবে। তার অর্থ হচ্ছে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তির আওতায় থাকবে না, তারা এই বাবদ কোনো অর্থও দিবে না।
অধিবেশনে নিকারাগুয়ার প্রতিনিধি আমেরিকার এই পদক্ষেপকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বর্তমানে যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা মোকাবিলার জন্য এই ‘লস এবং ড্যামেজ’ নামে একটি পৃথক ফান্ড গঠনের জন্য বাংলাদেশ গত কয়েকবছর ধরে জোরালো দাবি তুলে আসছে। যদিও ‘লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ড’ গঠিত হয়নি, তবে ফান্ড গঠনের পথে বড় ধাপ পেরুনো গেছে। এই ফান্ডের জন্য একটি এক্সপার্ট গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে, গঠিত হবে একটি সান্টিয়াগো নেটওয়ার্ক। ফান্ডের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা সামনে বছর চলবে।
এখন অপেক্ষা ২০২০ সালে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনের। আর পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা।
পিনাকী রায়, প্রধান প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার
pinaki@thedailystar.net
Comments