সীমান্তের এই মিলনমেলা যদি স্থায়ী হতো!

Flag Down
সীমান্তের বেনাপোল-পেট্রাপোলের নোম্যান্সল্যান্ড অংশে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় দুই দেশের পতাকা নামানোর দৃশ্য। ছবি: শরিফুল হাসান

শেষ বিকেলে সীমান্তে এসে থেমে যেতে হলো। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কুচকাওয়াজ করে আসছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। ভারত সীমা থেকে এলো তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা। দাঁড়িয়ে গেলো তারা নোম্যান্সল্যান্ডের জিরো পয়েন্টে। দুই দেশের দর্শনার্থীরাই ততোক্ষণে গ্যালারিতে বসে পড়েছেন।

দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তখন নিজ নিজ দেশের সীমান্তে এসে খুলে দিয়েছে সীমান্তের গেট। কুচকাওয়াজের পর বিউগলের সুরে বাংলাদেশ ও ভারতীয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় দুই দেশের জাতীয় পতাকা নামানো বা ‘ফ্ল্যাগ ডাউন’-এর আনুষ্ঠানিকতা।

নোম্যানসল্যান্ডে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানিয়ে একই সঙ্গে তা নামিয়ে আনা হয়। এরপর সামরিক কায়দায় এই পতাকাকে সম্মান জানিয়ে নিজ নিজ দেশের পতাকা বহন করে নিয়ে যান নিজ নিজ দেশের সদস্যরা। এর আগে বিজিবি ও বিএসএফ-এর দুই সদস্য যখন একজন আরেকজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন দুই প্রান্তেই তখন হাততালি। নিজ নিজ দেশে ফেরার সময় বেশিরভাগের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। কারো কারো চোখ ভেজা। সম্প্রীতি ও ভালোবাসার এমন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

গতকাল (২০ আগস্ট) বিকালের বেনাপোল ও পেট্রাপোল সীমান্তের কথা বলছি। জানা গেলো, রোজ বিকালে সীমান্তে পতাকা নামানোর এই দৃশ্য দেখতে ভিড় করেন দুই দেশের লোকজন। সাধারণত পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডের পাশে কেউ যেতে না পারলেও বিকালের পতাকা নামানোর এই নয়নাভিরাম দৃশ্য সবার জন্যই উন্মুক্ত করে দিয়েছে বিজিবি ও বিএসএফ। উৎসবমুখর পরিবেশে সীমান্তে ‘রিট্রেট শিরোমণি’ বা ‘ফ্ল্যাগ ডাউন’ নামের এই অনুষ্ঠান যেনো দুই বাংলার মিলনমেলায় পরিণত হয়। মাত্র আধা ঘণ্টা চলে এই অনুষ্ঠান। এ সময় আমদানি-রফতানিসহ পাসপোর্টধারী যাত্রীদের চলাচল বন্ধ থাকে বা বন্ধ রাখা হয়।

দুই দেশের সাধারণ মানুষ যেনো রোজ বিকালে পতাকা নামানোর অনুষ্ঠান দেখতে পান সেজন্য বিএসএফ ও বিজিবি দর্শনার্থীদের জন্য শূন্যরেখার দুই পাশে দুটি অত্যাধুনিক গ্যালারী তৈরি করেছেন।

জানা গেলো, বেনাপোলের বাইরে শার্শা, নাভারন, ঝিকরগাছা ও যশোর থেকেও অনেকে আসেন। একইভাবে ভারতের বনগাঁ থেকে শুরু করে উত্তর চব্বিশ পরগনা এমনকী কলকাতা থেকেও নাকি লোকজন মাঝে-মধ্যে আসেন। পতাকা নামানোর এই মনোরম দৃশ্য দেখে তারা মুগ্ধ হন। পাশাপাশি বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক দেখে পুলকিত হন তারা।

অবশ্য হওয়ারই তো কথা। কারণ ভারত সীমান্তের ওই পাড়ে থাকা বহুজনের বাড়ি যে বাংলাদেশেই ছিলো। আবার বহু বাংলাদেশির বাড়িও যে ছিলো ওইপ্রান্তে। ভিসা জটিলতার কারণে যাওয়া-আসা করতে না পারলেও প্রতি বিকালে ‘ফ্ল্যাগ ডাউন’ দেখতে তো আর বাধা নেই। বরং পতাকা নামানোর অনুষ্ঠান দেখতে এসে কয়েকজনকে দেখলাম, বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করতে। অনেকেই আবার ছবি তুলছিলেন, ভিডিও করছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে আবার নিজ নিজ দেশে ফিরতো হলো।

বিজিবি ও বিসিএফ সদস্যরা জানলেন, শুধু বেনাপোল নয়, আখাউড়া-আগরতলাসহ আরও কয়েকটি সীমান্তে এই পতাকা নামানোর অনুষ্ঠান চলছে। জানা গেলো, ১৯৫৯ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্যের ওয়াগা সীমান্তে সূর্যাস্তের মুহূর্তে দুই দেশের জাতীয় পতাকা নামানোর সময় একইরকম যৌথ প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠান দেখতে শুধু ভারত-পাকিস্তান নয় বিশ্বের বহু দেশ থেকে হাজার-হাজার পর্যটক প্রতিদিন সেখানে বেড়াতে যান। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক বছর আগে নয়া দিল্লিতে বিজিবি ও বিএসএফের ৩৭তম সীমান্ত সমন্বয় সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত হয়। তবে শুরুতে জিরো পয়েন্টে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় পর্যটকদের সমস্যা হচ্ছিলো। সে কারণেই পরে গ্যালারি হয়। এখন প্রতিদিন শেষ বিকালে সীমান্তের এই পয়েন্টগুলো হয়ে উঠে মিলনমেলায়।

বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে দুই বাংলার মানুষের আবেগ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম- বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাবছিলাম ১৯৪৭ সালে যেভাবে দেশভাগ হলো বিশেষ করে দুই বাংলা সেটা কী কখনো স্বাভাবিক মনে হয়েছে দুই বাংলার মানুষের কাছে? সীমান্তের এই মিলনমেলা যেমন সম্প্রীতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো তেমনি মনে করিয়ে দিচ্ছিলো কাশ্মীর নিয়ে এই অঞ্চলে উত্তেজনা-উদ্বিগ্ন হওয়ার কথাও। আবার শিলং থেকে আসামের রাজধানী গোয়াহাটি যেতে যেতে গাড়ি চালকের কাছে শুনছিলাম আসামের ৪০ লাখ মানুষের কথা যারা সেখানকার এনআরসির (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। ওদিকে মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদীর পাড়ে রয়েছে রোহিঙ্গা সংকট। ভাবতে গেলে কতো কিছু মাথায় আসে। ভারত সীমান্ত থেকে ইমিগ্রেশনসহ সব কাজ শেষ করে প্রিয় বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে ঢাকার পথে আসতে আসতে ভাবছিলাম, পৃথিবীর সব সীমান্তে যদি হতো শুধু মিলনমেলা। যদি যুদ্ধ আর সহিংসতা শেষ হয়ে যেতো এই পৃথিবী থেকে! আদৌ কী কোনোদিন আসবে এমন দিন?

শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

Shariful06du@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Election in Bangladesh

Election in first half of ’26 is not unreasonable, but Dec ’25 is doable

Whatever the differing stances of various political parties may be, people in general would prefer to exercise their franchise.

10h ago