ডেঙ্গু, সঙ্গে মশকরা আর উপহাস

dengue
এডিস মশা। ফাইল ছবি

মশকরা আর উপহাস দু’টি শব্দেরই আভিধানিক অর্থ ‘কৌতুক’, ‘তামাসা’, ‘ঠাট্টা’, ‘চ্যাংড়ামি’, ‘রঙ্গ’, ‘মজা’ ইত্যাদি।

২০০০ সালে প্রথমবার ডেঙ্গু বাংলাদেশে এসেছিলো ‘আতঙ্ক’ নিয়ে। সেই ‘আতঙ্ক’ তাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বহু মানুষকে। পর পর তিন বছর সক্রিয় ছিলেন তিনি।

এবার ডেঙ্গু শুধু ‘আতঙ্ক’ নয়, ‘মশকরা আর উপহাস’ শব্দ দু’টি সঙ্গী করে নিয়ে এসেছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘দায়িত্ব’ নিয়ে রাস্তায় নেমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এবার ‘দায়িত্ব’ নিয়েছেন মেয়র সাঈদ খোকন।

“আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই”-খুবই অবাক করা বিষয়, এত ক্ষমতাবান মেয়রের কথার কোনো গুরুত্ব দিতে দেখা গেল না এডিস মশাকে। ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তেই থাকলো। সকল ‘আতঙ্ক’ মেয়র একা বহন করার ‘দায়িত্ব’ নিলেও, নগরবাসী কোনোভাবেই অধিকার ছেড়ে দিতে রাজী নন।

ভানুর সেই কৌতুকের কথা নিশ্চয় স্মরণে আছে অনেকের। পরামর্শকের চরিত্রে লর্ড ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কাছে নিতাই এসেছেন খুনের মামলার আসামি খোকনকে বাঁচানোর পরামর্শ নিতে। ভানু উকিল ঠিক করে দিয়েছেন। জজ কোর্টে খোকনের ফাঁসির রায় হয়েছে। ভানু হাইকোর্টের ‘দায়িত্ব’ নিয়ে সাহস দিয়েছেন। সেই কৌতুকের শেষাংশ-

“...(কাঁদতে কাঁদতে) হাইকোর্টেও তো খোকনের ফাঁসির হুকুম হইয়া গেল! কিছুই তো করন গেল না...।

-না, তগ দেখছি আমার উপর কুনু আস্থাই নাই! এতকাল ত আমারে বিশ্বাস কইরা আইছস, ঠকছস কুনুদিন? আমি ত মইরা যাই নাই...। বাঁইচা তো আছি...। খোকনরে গিয়া ঝুইলা পড়তে ক...। আমি ত আছিইইইই...।”

এক শহরে দুই দুইজন মেয়র এখনও আছেন, তবুও নগরবাসী আতঙ্কিত হওয়া থেকে বিরত থাকছে না। আতঙ্ক ছড়ানো অব্যাহত রেখেছে মশা এডিস। হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে ভরে গেছে। রোগী ভর্তির লম্বা লাইন। গণমাধ্যম এসব সংবাদ প্রকাশ করছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ, জানাচ্ছে গণমাধ্যম। এক্ষেত্রেও ‘দায়িত্ব’ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন মেয়র সাঈদ খোকন। সাড়ে তিন লক্ষ সংখ্যাকে ‘গুজব’র সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সাত থেকে দশ হাজারের বেশি হবে না।”

অনেকে বলছেন ‘ডেঙ্গু মহামারি’ আকার ধারণ করেছে। ‘দায়িত্ব’ নিয়ে সংশোধন করে দিয়েছেন মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি বলেছেন, “ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার এখনও মহামারি আকার নেয়নি। মহামারির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে।”

‘মহামারি’র সংজ্ঞা তিনি বলেননি। অভিধানে মহামারির সংজ্ঞা ‘যে সংক্রামক রোগে বহু লোক মরে’।

সরকারি হিসেবে মারা গেছেন ৮ জন, বেসরকারি হিসেবে ২৫ থেকে ৩০ জন। দেড় কোটি মানুষের শহরে ৮ জন বা ২৫-৩০ জন মারা যাওয়াকে তো আর ‘বহু’ বলা যায় না! সিভিল সার্জন বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী যেই মারা যান না কেনো, তারাও তো একটি সংখ্যাই!

আইসিডিডিআর,বি পরীক্ষা করে বলেছে, “সিটি কর্পোরেশনের মশার ওষুধের কার্যকারিতা নেই।” আবারও ‘দায়িত্ব’ নিয়ে এগিয়ে এসে মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, “পুরোপুরি না হলেও ওষুধের কার্যকারিতা আছে।” স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আরও একটু এগিয়ে থেকে বলেছেন, “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি ওষুধ ঠিক আছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে।”

কোথায় বা কবে ওষুধ পরীক্ষা করা হয়েছে, জানাননি মন্ত্রী বা মেয়র। ‘ডেঙ্গু’ কার নিয়ন্ত্রণে আছে, মশা এডিসের, সিটি কর্পোরেশনের না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের? জানা যায়নি।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর চেয়েও বেশি দায়িত্ব নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, “যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকিউটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।”

ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, “প্রতিদিন দুর্ঘটনায় ১৫ জন মারা যায়। প্রায় ১০ জন লোক রোজ সাপের কামড়ে মারা যায়। আর কয়েক মাসে মাত্র ৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমরা এসব খবর রাখি না।”

নিশ্চয় খবর রাখছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ও উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম। দক্ষিণের মেয়র তার এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে ‘অ্যারোসল’ সরবরাহ করবেন। কবে অ্যারোসল দিবেন, তা বলেননি। মশার ওষুধের যদি কার্যকারিতা থাকে, তবে কেনো স্কুলে স্কুলে অ্যারোসল? স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা যখন বাড়িতে আসবেন, তখন কী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি। তবে অ্যারোসল দিয়ে যে দেড়-দুই কোটি মানুষের শহরকে ডেঙ্গুমুক্ত করা যায়, এমন অভিনব পদ্ধতি ভাবতে পারাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়!

ওষুধের কার্যকারিতা না থাকার বিষয়টি উত্তরের মেয়র প্রায় মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ওষুধ আনতে অক্টোবর পর্যন্ত সময় লাগবে।” সেই পর্যন্ত ঢাকা উত্তরের এডিস মশা চুপচাপ বসে থাকবে কী-না? দক্ষিণে পুরোপুরি বা আংশিক অকার্যকর ওষুধ ও কার্যকর অ্যারোসল ছিটালে, দক্ষিণের বাসিন্দা দল বেধে উত্তরে চলে যাবে না-মশা এডিস এমন নিশ্চয়তা দিয়েছে কী-না, জানা যায়নি।

পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কবে কখন কোন এলাকায় যাবেন, তা জানার উপায় উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন উত্তরের মেয়র। নগরবাসীকে তা মনিটর করতে বলেছেন। আর ডেঙ্গু হয়েছে কী-না, বিনামূল্যে পরীক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে জনগণকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন”- জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কথা কম বলে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রী-মেয়রদের।

ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে মে-জুন মাস থেকে। তখন সিটি কর্পোরেশনের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তাদের মশা নিধনের ওষুধ আমদানির বাজেট ৪০ কোটি টাকা। সেই সময় সম্ভবত তারা পুরো টাকার ওষুধই আমদানি করেছে। ওষুধের যদি কার্যকারিতা না থাকে, তাদের কী করার আছে! তাদের যা করার আছে তারা তা করছেন। ‘দায়িত্ব’ নিয়ে ‘আতঙ্কিত’ হতে নিষেধ করছেন, সংখ্যা বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের ‘অতিরঞ্জন-গুজবে’ বিভ্রান্ত হতে নিষেধ করেছেন। কয়েক’শ মেডিকেল টিম তৈরি করে রেখেছেন, বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষা ও অ্যারোসলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর কী চাই!

জনগণ আর কী চান তা জানার আগেই আওয়ামী মহাজোটের অংশীজন রাশেদ খান মেনন বলেছেন, “ওষুধ কেনায় দুর্নীতি আর অদক্ষতা ঢাকতেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের খবরকে দক্ষিণের মেয়র ‘গুজব’ বলেছেন।”

মশা এডিসের ভয়ে পরিকল্পনা কমিশনে যাচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, “ওখানে বেশি মশা। এ পর্যন্ত দুইবার কামড় দিয়েছে, একবার চিকুনগুনিয়া ও আবার ডেঙ্গু...এটা কি কথা হলো নাকি?”

শেষ করি অর্থমন্ত্রীর কথা দিয়েই, “ডেঙ্গুর যন্ত্রণা কী, আমি বুঝি। আল্লাহ যেনো কারও ডেঙ্গু না দেয়।’

নগরবাসী বসবাস করছেন, আল্লাহর উপর ভরসা রেখেই।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Family reunited after 18 years

Stranded in Malaysia, man finally comes back home

17m ago