গণপিটুনিতে হত্যা আসলে ‘পাবলিক ক্রসফায়ার’
চলছে সমাজতাত্ত্বিক আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এ কেমন সমাজ, এ কেমন মানুষ? যেন এ সমাজ আমরা চিনি না, জানি না। হঠাৎ করে ‘এমন সমাজ’ আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। ‘মূল্যবোধ’, ‘নৈতিকতা’, ‘অবক্ষয়’, ‘বিকৃতি’ শব্দগুলো বারবার সামনে আনছেন বিজ্ঞজনেরা। ‘সামাজিক অবক্ষয়’, ‘নৈতিকতা’ বা ‘মানবিক মূল্যবোধ’ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। কোথায় চলে গেল যে ফিরিয়ে আনতে হবে?
ফিরিয়ে আনার আগে তো জানতে হবে যে, কোথায় গেল। তা কি আমরা জানি? সমাজবিদ বিজ্ঞজনেরা জানেন? একদিনে হঠাৎ করে চলে গেছে, না আস্তে আস্তে গেছে? চলে যাওয়ার সেই সময়টা কি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সমাজবিদরা? সতর্ক করেছিলেন দেশ পরিচালনাকারী রাজনীতিকদের? আমরা কি জানি বা নিশ্চিত যে ‘মানবিক মূল্যবোধ’ বা ‘নৈতিকতা’ নামক বস্তু আমাদের ছেড়ে চলে গেল, না তাড়িয়ে দিয়েছি?
ফিরিয়ে আনার উপায় বা প্রক্রিয়া কী, পথ কোন দিকে?
মানুষের মননে ‘বিশ্বাসহীনতা’ এবং ‘আস্থাহীনতা’ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যিনি বা যারা ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ বোঝাচ্ছেন, মানুষ তার বা তাদের ‘মূল্যবোধ’ নিয়ে সন্দেহ করছেন। যা বলছেন বা যা লিখছেন, তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। যখন বলা হচ্ছে ‘চিন্তা’ করবেন না, ‘আস্থা’ রাখুন। মানুষ তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছেন এটা ভেবে যে, যা বলছেন তা সত্যি নয়। ‘বিশ্বাসহীনতা’র মাঝে জন্ম নিচ্ছে আরেক বিশ্বাস। এই ‘বিশ্বাস’ স্থায়ী আসন করে নিচ্ছে মননে।
‘আপা, পোলাপান নিয়ে যে চিন্তায় আছি’- গৃহকর্মী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলছেন।
কেন, কী হয়েছে?
‘পোলাপান ধইরা নিয়া যাইতেছে। ব্রিজে মানুষের মাথা লাগবো।’
এসব সত্যি না, গুজব। ব্রিজ বানাতে মানুষের মাথা লাগে না।
‘কী যে কন আপা, সবাই জানে মাথা লাগবো। আপনি জানেন না!’
অমুক জায়গায় মাথা পাওয়া গেছে, অমুক জায়গা থেকে বাচ্চা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ছে। ছেলেধরাকে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। গৃহকর্মীর কাছে তথ্যের অভাব নেই। যেসব তথ্য তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।
এই ‘বিশ্বাস’ কি শুধু গৃহকর্মীদের মনে? বিষয়টি বোঝার জন্যে গত দুই দিন জেলা-উপজেলা-গ্রাম পর্যায়ের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করলাম, গুজবটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কারও সন্তানকে ‘ছেলেধরা’ নিয়ে গেছে, কারও কাছে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ফরিদপুরের একজন বললেন, ময়মনসিংহ থেকে নাকি ‘ছেলেধরা’ দুই শিশুকে নিয়ে গেছে। ‘নাকি’ দিয়ে সবাই শুনেছেন, কেউ দেখেননি। কিন্তু বিশ্বাস করছেন। কেউ নিশ্চিত বিশ্বাস করছেন, কেউ সন্দেহযুক্ত বিশ্বাস করছেন। চুয়াডাঙ্গায় যে শিশুটিকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, এমন ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড এই প্রথম ঘটছে না। এখন ‘ব্রিজে মাথা লাগবো’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন।
চাঁদে সাঈদিকে দেখা গেছে, বিজ্ঞ-শিক্ষিত অনেককেই তা বিশ্বাস করতে দেখেছি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরি করতে শত শত মানুষের মাথা লেগেছিল, শিশুকাল থেকে এ গল্প শুনে বড় হয়েছি।
এখন পদ্মা ব্রিজে মাথা লাগবে, গল্প নয়- অনেক মানুষের বিশ্বাস। মেট্রো রেলে মাথা লাগার গল্প নেই। বঙ্গবন্ধু (যমুনা) ব্রিজ তৈরির সময়ও মানুষের মাথার প্রসঙ্গ আসেনি। পদ্মা ব্রিজের ক্ষেত্রে কেন এলো? সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্টদের সরল অভিযোগ, পদ্মা ব্রিজ বিরোধী বিএনপি-জামায়াত এই গুজব ছড়িয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সময় বিএনপি-জামায়াত ছিল না, ছিল না ফেসবুক। গুজব ছড়িয়েছিল। এমনভাবেই ছড়িয়েছিল যে, একশ বছর পরে এসেও মানুষের মনে তা রয়ে গেছে।
এবারের ক্ষেত্র সরল অভিযোগ বিএনপি-জামায়াত, না এর অন্য কোনো সামাজিক তাৎপর্য আছে? গুজব ছড়ানোর সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি ছিল, যা প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ‘গুজব ছড়ানো হচ্ছে’ প্রকৃত কারণ না জেনে, এ ধরণের প্রচারণাও যে গুজবের জন্যে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়াটাই হয়ে যাচ্ছে মূল বিবেচনার বিষয়। এই প্রবণতা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে।
সাধারণ পর্যবেক্ষণ বা বিশ্লেষণে কিছু বিষয় দৃশ্যমান হয়।
পানি-নদী বা সাগর, যেখানে মানুষ অতিক্ষুদ্র-অসহায়, সেখানে অদৃশ্য কোনো দানব জাতীয় শক্তি মানুষের কল্পনায় রয়ে গেছে।
যে নদীর গতি-প্রকৃতি যত ভয়ঙ্কর, সেই নদীতে ব্রিজ নির্মাণে অত্যন্ত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়। দশবার চেষ্টা করে একবার সফল হওয়ার গল্প ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেই নদীর দানবীয় রুদ্ররূপকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে রক্ত বা মানুষের মাথার গল্প ছড়িয়ে পড়ে। গল্প ছড়ানোর পেছনে সংস্কার বা কুসংস্কার যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, কিছু উপাদানও বিদ্যমান রয়েছে, শুধু বাংলাদেশে নয়-বহু দেশে।
অনেকেরই হয়ত স্মরণে আছে, পদ্মাসেতুর কাজ শুরুর সময়ে নদীতে গরুর রক্ত দেওয়া হয়েছিল। পদ্মাসেতুতে কয়েক’শ চীনা নাগরিক কাজ করছেন।
“কর্মরত এসব চীনা নাগরিকরা তাদের প্রথাগত বিশ্বাস ও রীতি অনুযায়ী রোববার দুটি কালো ষাঁড়, দুটি খাসি এবং দুটি মোরগ পদ্মা তীরে জবাই করে। পরে পশুর রক্ত ঢেলে দেওয়া হয় পদ্মায়।” (বিডিনিউজ২৪.কম, ১ মার্চ ২০১৫)
গত কয়েক বছরে পদ্মা নদীর ভয়াবহতার বহু সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। পদ্মার স্রোত, গভীরতা, বহু নিচেও শক্ত মাটির সন্ধান না পাওয়া, পাইলিং জটিলতা ইত্যাদি। গরুর রক্তে হয়নি, মানুষের মাথা লাগবে, গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে এমন ধারণাও কাজ করে থাকতে পারে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে কতটা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়েছিল, তার বহু গল্প আছে। পদ্মা ব্রিজের প্রতিকূলতার গল্প তো মানুষে মুখে মুখে। প্রতিকূল পরিবেশ গুজব ছড়ানোর জন্য অনুকূল। কেউ যদি উদ্দেশ্য নিয়েও এসব গুজব ছড়িয়ে থাকেন, তাদের জন্য সহজ হয়েছে।
সেই সমাজেই গুজব ছড়ানো সহজ, যে সমাজের মানুষের সামনে অজস্র প্রতিকূলতা। হঠাৎ করে যখন মানুষ তার গতিপথে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন, তখন বিরক্ত হন। বিরক্তি প্রকাশে যখন বাধা আসে, তখন মানুষ ক্ষুব্ধ হন। স্বাভাবিক কাজকে অস্বাভাবিক করে তুললে, দেখা দেয় অস্থিরতা। ব্যক্তির অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে সমষ্টিতে। সেখান থেকে সমাজে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বলার চেষ্টা করি। যেমন, নির্বাচন বা ভোট। ভোট দিয়ে কি হয়, ভোট পেয়ে নির্বাচিতরা ভালো কিছু করেন কী-না, এত কিছু মানুষ সব সময় ভাবনায় আনেন না। সাধারণভাবে মানুষ ভোট দিতে চান। এটা তার ‘ক্ষমতা’ বা ‘অধিকার’ মনে করেন। যখন ভোট দিতে পারেন না, রাতে ভোট বা মৃত মানুষের ভোট দেওয়ার গল্প শোনেন, সিইসি বলেন ‘কিছু করার নেই’ তখন মানুষের ভেতরে হতাশা তৈরি হয়। হতাশা প্রকাশে বাধা পেলে তার ভেতরের ক্ষুব্ধতা পরিণত হয় অস্থিরতায়। সামনে যা দেখেন, যাদের দেখেন অবিশ্বাস করতে থাকেন। সন্দেহ করেন, আস্থা হারিয়ে ফেলেন। গুজব ছড়ানোর জন্য যা অত্যন্ত অনুকূল।
মানুষ যা দেখেন তার উল্টো ব্যাখ্যা যখন আসে, তখন মানুষ নিজেকে গুরুত্বহীন-অসহায় ভেবে ক্ষুদ্ধ হন। ভিডিও চিত্রে মানুষ দেখলেন যে, মিন্নি তার স্বামীকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। যখন বলা হলো, মিন্নি ‘সেভাবে’ চেষ্টা করেননি, তখন মানুষের মন থেকে আস্থা-বিশ্বাস দুটোই চলে যায়। যা বলা হচ্ছে তা সত্যি হতেও পারে, কিন্তু মানুষ তা বিশ্বাস করেন না। কারণ যারা ‘বিশ্বাস’ করাতে চাইছেন, তারা বহু নজীর তৈরি করে মানুষের মনে ‘অবিশ্বাসী’ হিসেবে প্রায় স্থায়ী পরিচিতি পেয়ে গেছেন।
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্প কোনো মানুষই বিশ্বাস করেন না।
‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’র নামে আসলে কী ঘটে, সে বিষয়ে মানুষ পরিষ্কার ধারণা রাখেন। চট্টগ্রামের কাউন্সিলর একরামের সন্তানের সেই কথা ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে...’ মানুষের মনোজগতকে বিক্ষুব্ধ করে দেয়। অদ্ভুত বিষয়, এই মানুষই আবার ক্রসফায়ার সমর্থন করেন, মিষ্টি বিতরণ করেন। এই সুযোগ নিয়ে গল্প বলা চলতে থাকে।
মানুষ জেনে গেছে যে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি হবে না। আইন বা আইন প্রয়োগকারীদের প্রতি বিশ্বাস বা ভরসা নেই। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার মূল কারণও আস্থাহীনতা। ধরে পুলিশে দিলে শাস্তি হবে না, এমন বিশ্বাস থেকে নিজেরা পিটিয়ে হত্যা করছে। গণপিটুনিতে হত্যা আসলে ‘পাবলিক ক্রসফায়ার’।
এমন অবিশ্বাস-আস্থাহীন ভয়ানক পরিবেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা নীতি নির্ধারকরা যখন সত্য বলেন, তখনও মানুষ অবিশ্বাস করেন।
শুধু ক্রসফায়ার বা পাবলিক ক্রসফায়ার নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রের বাস্তবতা কম-বেশি একই রকম। যেমন ‘ছেলেধরা’ গুজবের চেয়েও চিন্তা বা মহাচিন্তার বিষয় ডেঙ্গু। তখন যিনি বলেন ‘ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই- মানুষের কাছে তিনি ‘বিশ্বাসী’ মানুষ নন। ডেঙ্গুতে হাসপাতাল ভরে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে মানুষ। আর মেয়র তখন ‘রোডশো’ করছেন! মানুষ মনে করছেন তাদের সঙ্গে ‘উপহাস’ করা হচ্ছে।
উপহাসকারীরা উন্নয়ন বলতে অবকাঠামো বোঝেন, মানুষকে বুঝতে বাধ্য করতে চান। অবকাঠামো উন্নয়ন খুব জরুরি, মানুষের তা বুঝতে সমস্যা হয় না। মানুষের এও বুঝতে সমস্যা হয় না, অবকাঠামো নিজে উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের সহায়ক। ‘সহায়ক’কে যখন এক নম্বরে আনা হয়, তখন মানুষের মনে সন্দেহ ছড়ায়। ১০ টাকার কাজ ৫০ টাকায় করতে হলে, মানুষ নিজেকে প্রতারিত ভাবেন। মানব সম্পদের উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়নই যে টেকসই উন্নয়ন নয়, মানুষ যে তা বোঝেন না- তা তো নয়।
মানুষের বোঝা আর বোঝানোর মধ্যে ফারাক বাড়তে থাকে, দৃশ্যমান অন্যায্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অন্যায্যতা যখন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যায়, তখন মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। অবক্ষয় দৃশ্যমান হয় মানে, দুর্নীতি-অনিয়ম-জুলুম-দাম্ভিকতাময় হয়ে পড়ে সমাজ। ‘এ কেমন সমাজ’- প্রশ্নের অবকাশ নেই। এমন সমাজই আপনি-আপনারা-আমরা তৈরি করেছি। ‘মূল্যবোধ’ বা ‘নৈতিকতা’ কোথাও চলে যায়নি, তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘অবক্ষয়’ ডেকে আনা হয়েছে। আর আইনের শাসন? প্রায় অর্ধশত বছরের বাংলাদেশে, তা প্রতিষ্ঠার সঠিক কোনো চেষ্টাই হয়নি কখনও।
‘মূল্যবোধ’ ফিরিয়ে আনার বা ‘অবক্ষয়’ ঠেকানোর সহজ কোনো পথ নেই। যারা ‘ভালো হয়ে যাওয়ার’ বুদ্ধি দেন, তার প্রভাব সমাজে পড়ে না। মানুষের মনে স্থায়ী হয়ে যায় যে, এমন সমাজে যে কোনো কিছু করা যায়। দায় নিতে হবে না তার, শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অন্যায়-অনিয়ম দেখতে দেখতে, মানুষ নিজেও এক সময় তার অংশ হয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ করে, একজন মা বা বোনকেও পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে। এই ‘সন্দেহ’ মানে শুধু সন্দেহ নয়, নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের অনাচার আর অন্যায্যতার ফসল।
Comments