মানুষ যদি সে না হয় মানুষ...
সেদিন রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম চার পাঁচজন শিশু খেলাচ্ছলে একটি বিড়ালের গলায় দড়ি দিয়ে বনবন করে ঘুরাচ্ছে। ওরা আনন্দে হাসছে কিন্তু আমি দেখলাম বিড়ালটার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। অসহায় বিড়াল জানেও না কেনো ওকে এভাবে ঘুরানো হচ্ছে ? এই দৃশ্য দেখে আমার এত কষ্ট হলো যে বাচ্চাদের বললাম বাবারা ওকে ছেড়ে দাও। ও তো তোমাদের মতই একটা বাচ্চা। ওর মা ওর জন্য কাঁদছে।
বাচ্চারা কী বুঝলো জানিনা, ওরা ওর দড়িটা খুলে দিলো। আমার মনে হলো বাচ্চাগুলো কতটা কঠিন হৃদয় নিয়ে বড় হচ্ছে। এরা ভেবেই দেখে না কোনটা আনন্দ, আর কোনটা অত্যাচার। হয়তোবা কেউ ওদের কখনও বলেইনি এভাবে কোনো মানুষ বা পশুপাখিকে অত্যাচার করতে হয় না।
এই শিশুদেরকে কীইবা বলবো, সেদিন খবরে দেখলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলের ছাত্রীরা নাকি তিনটি বিড়ালের বাচ্চাকে মা বিড়ালের সামনে পুড়িয়ে মেরেছে, বিড়ালের বাচ্চাদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। মা বিড়ালটি তার বাচ্চাদের সামনে বসেছিলো চুপচাপ। মানুষের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে তার কী মনে হচ্ছিলো, সে আলোচনায় নাইবা গেলাম।
শেখেরটেক এলাকায় পাড়ার একটি কুকুর ঘুরে বেড়ায়, এদিক সেদিক থেকে তাকে কিছু খাবার দাবার দেওয়া হয়। ওই এলাকার কোন এক লোকের বাসার সামনে এই কুকুরটা নাকি রাতে উচ্চস্বরে কেঁদেছিলো। রাতে কুকুরের কান্না খারাপ লক্ষণ, তার মনে হলো কুকুরটিকে মেরে ফেলা দরকার। একদিন সে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শাস্তি দেওয়ার জন্য কুকুরটির লেজ কেটে ছেড়ে দিলো। অসহায় কুকুরটি তার রক্তঝরা লেজটি নিয়ে এক কোণে বসেছিলো, আর ব্যথায় চিৎকার করে কেঁদেছিলো। পাড়ার কয়েকজন তরুণ কুকুরটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও পারেনি।
অনেকেই আছেন যারা বিড়াল কুকুর ভালবাসেন না বা পছন্দ করেন না। সে হতেই পারে, পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখায় যে বা যারা, তারা যে একদিন মানুষের প্রতিও নিষ্ঠুর আচরণ করবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াই যায়। কারণ জীবহত্যা মহাপাপ এই বোধটা যদি ছোটবেলা থেকে আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা না যায়, তাহলে মানব হত্যাও থামানো যাবে না। আজকে যখন কোন মানুষকে একক বা দলবদ্ধভাবে নিষ্ঠুর আচরণ করতে দেখি, তখন খুব একটা অবাক হই না, কিন্তু খুবই কষ্ট পাই। যেমনটা কষ্ট পাচ্ছি একের পর এক গণপিটুনির নামে হত্যাকাণ্ড দেখে। নিজেকে আরও বেশি অসহায় লাগছে এর বিরুদ্ধে কিচ্ছু করতে না পারার দু:খে।
বাংলা ট্রিবিউন জানিয়েছে গত ৬ মাসে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৬ জন। এ সব ঘটনাকে হত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে কোন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ এখন পর্যন্ত নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এসব ঘটনার দায় কার? এই গণপিটুনি আসলে সমবেতভাবে ঘটানো একটি হত্যাকাণ্ড। যে হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে দায় নিতে হয় না কিন্তু বেশ বিকৃত আনন্দ নিয়ে একজন মানুষকে মারা যায়।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অভিযোগ করার অপেক্ষা না করে, নিজ থেকে পুলিশের উদ্যোগী হয়ে তদন্ত করে এসব ঘটনার বিচার করা জরুরি। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেছেন সমাজে অস্থিরতার কারণে জনপরিসরে কেউ কাউকে মারতে শুরু করলে সেটি সংক্রামিত হয় এবং তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এটি মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট। শাস্তি থাকলে মানুষ এ ধরণের ঘটনা থেকে দূরে থাকবে।
শুধু অবাক হয়ে ভাবছি এই উন্মত্ত জনতা সন্তানের মা, বাক প্রতিবন্ধী বাবা, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ সবাইকে শুধু সন্দেহের বশে হত্যা করছে। অথচ এই যে শত শত ধর্ষক ধরা পড়েছে বিভিন্ন সময়ে, কই তাদের গায়ে তো একটা চড়-থাপ্পড়ও দিলো না এই জনতা। ইমাম, স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, পরিবারের সদস্য, পাশের বাড়ির ছেলে ধর্ষণের অভিযোগে ধরা পড়লো এবং জোর গলায় নিজেদের অপরাধ স্বীকারও করলো, কিন্তু কই জনতার মধ্যে তো কোন ক্ষোভ লক্ষ্য করলাম না। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ছেলেধরা সন্দেহে একজন বাবা ও মাকে হত্যা করা যায় উন্মত্ত জোশ নিয়ে, কিন্তু ধর্ষক হাতেনাতে ধরা পড়ার পর এদের শাস্তির দাবিও করে না এই জনতা। আরও অবাক লাগে যখন দেখি, একজন মানুষকে কোন দোষে অভিযুক্ত করে বা সন্দেহ করে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে এবং তখন অনেক মানুষ দলবেঁধে তাতে অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু যখন একদল দুর্বৃত্ত একজন মানুষকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, তখন একজনও এগিয়ে আসে না তা থামাতে। সবাই দর্শক হয়ে যায়। এও কি এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা নয়?
এই যে মানুষকে ডাইনি, ছিনতাইকারী, ছেলেধরা হিসেবে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই প্রচলিত আছে। ভারতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে শুধু ডাইনি সন্দেহেই হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৫০০। পুলিশও স্বীকার করেছে সাক্ষী প্রমাণের অভাবে এ ধরণের অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা ছাড়া পেয়ে যায় এবং আবারও অপরাধ করে এবং বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আক্রোশেরও বলি হয় অসহায় মানুষ।
আইন সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী গত ৮ বছরে ৮০০ জনকে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, “একটি সমাজে পৌনঃপুনিকভাবে ‘মব’ তৈরির ঘটনা কেনো ঘটে, কীভাবে ঘটে তার তিনটি ব্যাখ্যা আছে। প্রথমটি হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। যখন সমাজে ‘মোরাল প্যানিক’ ছড়িয়ে পড়ে তখন ‘মব’ তৈরি হয়। ‘মোরাল প্যানিক’ হচ্ছে এমন ধারণা বা ভীতি যা সমাজের বড় অংশের মানুষের জীবনযাপনে ভয়াবহ কিছু তৈরির হুমকি নিয়ে হাজির হয়। এগুলো বিভিন্ন কারণে ছড়ানো হয়। ওই অবস্থায় ‘ইভিল’ মোকাবিলার নামে, লোকজন দল বেঁধে ওই ইভিলের প্রতীক হিসেবে একজন মানুষকে আক্রমণ করে, হত্যা করে।”
তিনি বলেন, “দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে সামাজিক। একটা সমাজে যখন সামাজিক বাঁধনগুলো দুর্বল হয়ে যায় তখন দেখা যায়, মানুষ আর এই ধরনের ঘটনার যে মানবিক একটা দিক আছে, তারা যে অন্য একজন মানুষকে হত্যা করছে তা ভাবে না। মানুষ ভাবে না, কেননা ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে, আইনবহির্ভূতভাবে হত্যার এক ধরনের বৈধতা তৈরি হয়েছে।”
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “তৃতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে রাজনৈতিক। যখন আইন-আদালত, পুলিশ, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপরে মানুষের আর কোনও আস্থা থাকে না এবং তারা ধরে নেন যে, এই ব্যবস্থায় সুবিচার হবে না, ফলে তাকেই এই ‘বিচার’ করতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত যখন রাষ্ট্র, সরকার ও প্রভাবশালীরা এই ধরনের ঘটনাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উসকে দেয়, এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের বিচার হয় না, উপরন্তু ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য পায়। সেটা অন্যদের ‘মব’ হয়ে উঠতে উৎসাহী করে।”
মূল কথা একটাই এইসব ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের কখনও শাস্তির আওতায় আনা হয় না বলে, এরা বারবার এ জাতীয় ঘটনা ঘটাবার সুযোগ পায়। শুধু গণপিটুনি কেনো, ধর্ষণ, অপহরণ, যৌন হয়রানি, অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন কোনোটারই ঠিকমত বিচার হয় না বলে অপরাধীরা বারবার এই অপরাধ করে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, সাধারণ নাগরিক করুক বা যেই এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত হোক না কেনো, দায় রাষ্ট্রের। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে পুলিশকে এই দায় নিতে হবে। কেননা, নিয়ম অনুযায়ী, প্রিভেনশন বা অ্যাকশন পাওয়ার পুলিশের। যখন ঘটনা ঘটছে তারা যদি তথ্য পায় সেটি সাধ্যমতো আটকানোর কাজটি কতটা করছে, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। ঘটনাস্থলে সবসময় পুলিশ নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে খবর পাওয়ার পর সে নিজে উদ্যোগী হয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করছে কিনা।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, “মব-এর একটা আলাদা চরিত্র আছে। রিফাত হত্যা বা অভিজিৎ রায়কে প্রকাশ্যে কোপানোর ঘটনায় পাবলিক নিজেদের সংযুক্ত বোধ করে না, কিন্তু ছেলেধরার গুজব বা রাস্তার যেকোনো দুর্ঘটনায় সে নিজেকে সম্পৃক্ত বোধ করে এবং তার ভেতর সেই সময়কার গণমানুষের সক্রিয়তার মানসিকতা সংক্রমিত হয়। সে সেখানেই বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।”
মব বা গণহামলায় সম্পৃক্তদের মধ্যে বিবেকবোধ কাজ করে না এবং তারা যেটা করছে সেটাই ঠিক বলে বিবেচনা করতে থাকে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ এইসব ঘটনা দেখে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। বিভিন্নভাবে ক্ষোভ দু:খ প্রকাশ করছি কিন্তু কেউ পথে নামছি না। আমাদের এই উদাসীনতা, মুখ ঢেকে রাখার সংস্কৃতি অপরাধীদের শক্তিশালী করছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা অপরাধীদের উসকে দিচ্ছে।
পত্রিকায় দেখলাম সরকার সন্দেহজনক ঘটনা অথবা গুজবের ভিত্তিতে কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, এ ধরণের ঘটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে এবং আইনশৃংঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারাদেশে অভ্যন্তরীণ সার্কুলার জারি করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। আমরা সবসময় আশাবাদী হতে চাই। বিশ্বাস রাখতে চাই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর। একমাত্র আইনের যথাযথ প্রয়োগই পারে অব্যাহত অপরাধ ঠেকাতে। সেই সঙ্গে মানুষকেও সচেতন হতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে সুদৃঢ় করতে হবে।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments