‘চলচ্চিত্র শিল্পে ১৭টি সংগঠন, এদের আসলে কাজ কী? -বাপ্পারাজ
ঢাকাই চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয় অভিনেতা বাপ্পারাজ। ১৯৮৬ সালে বাবা নায়করাজ রাজ্জাকের পরিচালনায় ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে তার। নিজ অভিনয় গুণে জয় করেছেন দর্শক হৃদয়। বর্তমানে চলচ্চিত্রে অভিনয় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রে দর্শকপ্রিয় অনেক ছবি উপহার দেয়া এ অভিনেতা নিজের বর্তমান অবস্থান এবং চলচ্চিত্রের অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে।
স্টার অনলাইন : বর্তমানে অভিনয় থেকে আপনি দূরে কেন?
বাপ্পারাজ : আসলে অভিনয় থেকে আমি দূরে আছি সেটা ঠিক নয়। আমি যে ধরনের চরিত্রে কাজ করতে চাই, সে রকম চরিত্র আমাদের সিনেমার গল্পে তৈরি হচ্ছে না বলেই কাজ করা হচ্ছে না। তাছাড়া আমাদের নির্মাতারা একান্নবর্তীভাবে কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পীদের কথা ভেবে এখন আর গল্প তৈরি করেন না। যাকে দরকার তাকে পেলেই হলো, বাকি শিল্পীদের নিয়ে ভাবার সময় এখন আর নেই তাদের কাছে। সে জন্যই হয়তো আমার এখন আর নিয়মিত কাজ করা হয়ে ওঠে না। আর বাবা-চাচার চরিত্র করার মতো বয়সও এখন হয়নি।
স্টার অনলাইন : অভিনয়ের শুরুটা হয়েছিল কীভাবে?
বাপ্পারাজ : আব্বার ইচ্ছাতেই আমার চলচ্চিত্রে আসা। যদিও চলচ্চিত্রে কাজ করার ইচ্ছা ছিল, কখন থেকে করব তা নিজে বুঝে উঠতে পারিনি। যখন আমি এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করলাম তখন আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করবেন এবং আমাকে সেই ছবির হিরোর চরিত্রে কাজ করতে হবে। তখন থেকেই আব্বার ইচ্ছাতেই চলচ্চিত্রে আমার অভিষেক হয়।
স্টার অনলাইন : অভিনয় জীবনে পথচলায় কোনো মজার স্মৃতি?
বাপ্পারাজ : মজার স্মৃতি তো অনেকই আছে, কোনটা রেখে কোনটা বলব ভেবে পাচ্ছি না। তবে একটা মজার স্মৃতি এখনো মনে পড়লে খুবই হাসি পায়- ‘বনের রাজা টারজান’ ছবির শ্যুটিংয়ে আমরা পুরো ইউনিট কক্সবাজারে ছিলাম। কক্সবাজার শৈবালে আমরা যে রুমে ছিলাম, আমাদের পাশের রুমে ছিল ওমর সানী। তার সেখানে অন্য ছবির শ্যুটিং ছিল। তখন ওমর সানীর রাইজিং সময় ছিল। সে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমাদের দেখানোর জন্য বারান্দায় এসে ব্যায়াম করছিল। আমাদের ইউনিটের সঙ্গে ছিল নতুন ম্যাডামসহ আরো অনেকে। তখন নতুন ম্যাডামকে বললাম, ‘সানী আমাদের ব্যায়াম দেখাচ্ছে চলেন আমরা তাকে মজা দেখাই।’ আমরা সবাই মিলে তাকে ঘিরে ফেলি এবং তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়ে মজা করতে থাকি। আমাদের সবার কার্যক্রম দেখে সানী হতভম্ব হয়ে কী করবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সানীর সেই চেহারা মনে পড়লে আমার এখনো হাসি পায়। সানীর সঙ্গে এখনো দেখা হলে সেই ঘটনাটি মনে করিয়ে দিয়ে এখনো মাঝে মাঝে মজা নেই।
স্টার অনলাইন : অভিনয়ে আপনার অনুপ্রেরণা কে?
বাপ্পারাজ : আমার অভিনয়, দর্শকের ভালোবাসা নিয়ে চলচ্চিত্রে অবস্থান তৈরি করা যা কিছুই বলি না কেন সবকিছুই আব্বার কারণেই হয়েছে। আব্বার উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসার কারণেই আজকের আমি। মোট কথা আব্বাই আমার অনুপ্রেরণা।
স্টার অনলাইন : চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার ভাবনা?
বাপ্পারাজ : আমাদের চলচ্চিত্র বর্তমানে যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে এর জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। ছবির গুণগত মান, হলের পরিবেশ একটা মুখ্য বিষয় হলেও আমার মনে হয় আমাদের চলচ্চিত্র নিজেদের সৃষ্টি করা গৎবাঁধা নিয়মের মধ্যেই বন্দি। শুরু থেকে যেভাবে চলছে, এখনো ঠিক তাই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলতে পারছি না। আবার অনেক ছবিতে প্রযুক্তির অপারগ ব্যবহার ছবিটিকে দর্শক মহলে হাসির খোরাক বানিয়ে দিচ্ছে।
স্টার অনলাইন : বর্তমান সংগঠনগুলো কী চলচ্চিত্রের স্বার্থে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে?
বাপ্পারাজ : আমি সংগঠনের পক্ষে কখনোই ছিলাম না আর এখনো নেই, যখন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সংগঠন ছিল না, তখন ইন্ডাস্ট্রি অনেক ভালো ছিল। এখন নাকি ইন্ডাস্ট্রিতে ১৭টি সংগঠন। এদের আসলে কাজ কী? চলচ্চিত্রের স্বার্থে এরা কী করছে? ছবি বানানো, ছবি বণ্টন কোথাও এদের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ নেই। তারা সংগঠনগুলোতে বসে বসে নেতা নির্বাচন, আড্ডাবাজি, পিকনিক ইত্যাদি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। চলচ্চিত্রের স্বার্থে যেহেতু সংগঠন দিয়ে কোনো কাজই হচ্ছে না, আমার মনে হয় এসব সংগঠন বাদ দিয়ে তাদের ঘরে বসে টেলিভিশনে ছবি দেখলেও আমাদের চলচ্চিত্র স্বস্তির দম নিতে পারবে।
স্টার অনলাইন : নতুন যারা চলচ্চিত্রে কাজ করতে চায় তাদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে?
বাপ্পারাজ : নতুনরা এসে কাজ করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রের বর্তমান সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে। নতুনদের দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ছবি নির্মাণ করার মতো পরিচালক নেই বললেই চলে। তাছাড়া পরিচালকরা পুরনো শিল্পীদেরই এখন ঠিকভাবে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে নতুনদের জন্য কী করবেন তারা। আমি মনে করি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান সময়টা নতুনদের অনুকূলে নেই।
স্টার অনলাইন : অভিনয়ের বাইরে কোনো শখ রয়েছে?
বাপ্পারাজ : অনেক আগে থেকেই আমার গাড়ির শখ। ইন্ডাস্ট্রির সবাই এই বিষয়টা জানে। এই যেমন গাড়ি চালানো, কেনা-বেচা, পুরনো গাড়ি কিনে তা আবার মডিফাই করা ইত্যাদি। এ কাজগুলো আমি খুব আনন্দ নিয়ে করি।
স্টার অনলাইন : আপনার কোনো অপ্রাপ্তি?
বাপ্পারাজ : না। আল্লাহর রহমতে আমার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই। কারণ আমার চলাফেরা খুবই সাধারণ। চাহিদা খুবই স্বল্প। টাকা-ধন-সম্পত্তির কোনো প্রকার লোভ নেই। একজন মানুষ তার যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে তার আর কোনো অপ্রাপ্তি থাকার কথা নয়। আমার বেলায়ও ঠিক তাই। আমার আমিতে আমি তৃপ্ত।
স্টার অনলাইন : আপনার অবসর সময় কাটে কীভাবে?
বাপ্পারাজ : সময় তার নিয়মে চলে যায়। সর্বদা কাজের মধ্য দিয়েই চলতে হয়। এর মাঝেও কিছু সময় বের করে ছবি দেখা, ছোট ভাইয়ের বাচ্চাদের সঙ্গে সময় দেয়া, পরিবারকে সময় দেয়ার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য মিলিয়ে আমার অবসর কেটে যায়।
স্টার অনলাইন : আপনার অভিনীত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে বিয়োগান্ত চরিত্রেই দেখা যেত। এমন চরিত্রে অভিনয়ে কী আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন নাকি পরিচালকের চাওয়ার ওপর নির্ভর হয়ে কাজ করতেন?
বাপ্পারাজ : না, এটা একদমই ঠিক নয়। যদি ১০০টা ছবি করে থাকি, তার মধ্যে হয়তো ১০টা ছবিতে আমাকে এমন চরিত্রে দর্শক দেখতে পেত। কিন্তু ওই ১০টা ছবিই এত জনপ্রিয় হয়ে গেছে যে তারা এই চরিত্রের বাইরে আর আমাকে কল্পনা করতে পারছে না। তার জন্যই সবার মাঝে আমাকে নিয়ে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। কিন্তু আমি সর্বদাই চরিত্রের ব্যালান্স করেই কাজ করেছি।
স্টার অনলাইন : আপনার বাবা নায়করাজ রাজ্জাককে নিয়ে ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা আছে?
বাপ্পারাজ : এ ইন্ডাস্ট্রির পেছনে বাবার অনেক অবদান রয়েছে। একজন নায়করাজ রাজ্জাক এই ইন্ডাস্ট্রিতে আর আসবে কিনা জানি না। বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে বাবাকে নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু কাজ করতে চাই।
স্টার অনলাইন : ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা আছে কী?
বাপ্পারাজ : চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা সব সময় আমার মাঝে কাজ করে। কিন্তু সময়টা এখন প্রতিকূলে। যদিও একটি ছবি নির্মাণ করেছি। তবুও সময়, পরিস্থিতি, ব্যবসা- সবকিছু অনুকূলে নিয়ে আবারো চলচ্চিত্র নির্মাণ করব।
Comments