মৃত ব্যক্তির ভোটদান ও ‘করণীয় কিছু নেই’ সমাচার

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা। ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

‘কোথায় যাই, কার কাছে যাই’- মহাদেব সাহার জনপ্রিয় কবিতার লাইন একটু পরিবর্তন করে বলা যায় ‘কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে’? ভরসার জায়গা কোথায়? বলছি বাংলাদেশের জনগণের কথা। বহুবিধ প্রশ্নের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন দৃশ্যমান হয়েছিলো, তার একটি এখন আবার আলোচনায়।

১. কিছু কেন্দ্রে ‘শতভাগ’ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় বা সৌদি আরবে থাকেন যারা, তারা বাংলাদেশে না এসেও সশরীরে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছিলেন!

বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রের ‘শতভাগ’ ভোটের সংবাদ দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছিলো ১ জানুয়ারি, নির্বাচনের ১ দিন পর।

দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ ‘শতভাগ’ ভোট দেওয়া এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন এ বছরের ১ জানুয়ারি। মৃত এবং প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছিলেন তিনি। অনুসন্ধানে জানতে পারেন-

বগুড়ার চিকাশি মোহনপুর গ্রামের হজরত আলীর স্ত্রী জাহেদা খাতুনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৩ মার্চ। তার ভোটার নম্বর ১০১৪৮২২২৪৯৬৭ (ক্রমিক নম্বর: ২৩৩)। জাহেদার ছোট ছেলে আকবর আলী (৪০) জানান, ২০১৮ সালের জুনে তার মা পারিবারিক কলহের জেরে তার এক প্রতিবেশী আত্মীয়ের হাতে নিহত হন।

এই হত্যার পর মামলার প্রধান আসামি মেহের আলী কারাগারে রয়েছেন। অথচ এই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেহের আলীর বাবা ইউসুফ আলী জানান, তিনি ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা এবং মেহের আলীর স্ত্রী আরজিনা বেগম ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেননি। হত্যাকাণ্ডের পর আরজিনা বগুড়ায় থাকতে শুরু করেন এবং তিনি এখনো এই গ্রামে ফিরে আসেননি।

চিকাশি মোহনপুর গ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ মইনুল হাসান (ভোটার নম্বর: ১০১৪৮২০০০২৮৪) ভোট দিয়েছেন বলেও ভোটার তালিকার মাধ্যমে জানা যায়।

মইনুলের মা সালেহা বেগম বলেন, তার ছেলে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে প্রায় ১ বছর হলো। সে সেখানে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিষয়টি দাঁড়ালো এমন, যিনি নিহত হয়েছেন ২০১৮ সালের জুন মাসে, তিনি ভোট দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। হত্যাকারী জেলে, তিনিও ভোট দিয়েছেন। না, জেলে কোনো ভোটকেন্দ্র ছিলো না। ভোট দেওয়ার জন্যে মুক্তিও পাননি, কিন্তু ভোট দিয়েছেন। এক বছর ধরে যিনি মালয়েশিয়ায় আছেন, তিনিও ভোট দিয়েছেন। পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা ছিলো না, সেভাবে তিনি ভোট দেনওনি। ভোটার তালিকা অনুযায়ী তিনি সশরীর উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে এ তথ্য জানার পর রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত কাগজ পেতে বেগ পোহাতে হয়। এবং তা দেরিতে পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে নির্বাচন নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ সামনে চলে আসায়, ‘শতভাগ’ ভোটের বিস্তারিত প্রতিবেদন আর প্রকাশিত হয়নি।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ, ১২৭টি কেন্দ্রে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে।

যে সংবাদ দ্য ডেইলি স্টারসহ দু-একটি গণমাধ্যম প্রকাশ করেছিলো ১ জানুয়ারি, সেই সংবাদের সত্যতা এখন স্বীকার করে নিলো নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ‘১০৮টি আসনের ৮৮৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা একটি ভোটও পাননি।’ (কালের কণ্ঠ ২ জুলাই, ২০১৯)

প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “শতভাগ ভোট পড়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই।”

কেনো ‘করণীয় কিছু নেই’ তার পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যুক্তি দিয়েছেন এভাবে, “ভোটের পর পরই গেজেট আকারে ফল প্রকাশ হয়ে যায়। গেজেট প্রকাশের পর ইসির কিছু করার থাকে না। তাই খতিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আরো কিছু বিষয় পর্যালোচনার দাবি রাখে।

ক. নির্বাচন কমিশন যেদিন নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের জন্যে (১ জানুয়ারি) বিজি প্রেসে পাঠিয়েছিলো, সেদিনই (১ জানুয়ারি) শতভাগ ভোটের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো।

খ. শতভাগ ভোট, রাতে ভোট, ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট, নির্বাচন নিয়ে এমন বহুবিধ গুরুতর অভিযোগ আলোচনায় থাকলেও, তড়িঘড়ি করে গেজেট আকারে ফল ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। যদিও আইনগতভাবে এতোটা তাড়াহুড়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। সুযোগ ছিলো অভিযোগগুলোর তদন্তের।

গ.  নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখেও তাদের কাছে সত্যতা জানতেও চায়নি। অর্থাৎ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ‘অজানা’ ছিলো না।

ঘ. ‘শতভাগ’ ভোট, মৃত বা প্রবাসে থাকা ব্যক্তির ভোট দেওয়াকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, ‘স্বাভাবিক নয়’। বিষয়টি কি আসলে এতো সহজ বা সরল? প্রথমত, প্রিজাইডিং অফিসার বা রিটার্নিং কর্মকর্তার উপর যে দায়িত্ব ছিলো, তারা তা পালন করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা যে দায়িত্ব পালন করেননি বা করতে পারেননি, তা গণমাধ্যমকে বা নির্বাচন কমিশনকে যথা সময়ে জানাননি। নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকে দায়িত্ব পালন করেননি এসব কর্মকর্তারা। ‘দায়িত্ব পালন না করা’ এবং ‘না জানানো’র পক্ষে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

দায়িত্ব পালন না করে, তথ্য না জানিয়ে করা ‘অপরাধ’-কে কি ‘স্বাভাবিক নয়’ বলা যায়?

ঙ. প্রিজাইডিং অফিসার বা রিটার্নিং কর্মকর্তা কেনো আগে জানালেন না, তা নির্বাচন কমিশন জানতেও চাননি। গেজেট প্রকাশের পর ফল হয়তো পরিবর্তন করা যাবে না, কিন্তু ‘মৃত ব্যক্তি’র ভোট দেওয়ার অভিনব ঘটনার তদন্তে সমস্যা কী? আইনে কোনো বাধা আছে? ‘করণীয় কিছু নেই’- প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি এমন কথা বলতে পারেন?

২. যুক্তি হিসেবে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যার বিষয়টি সামনে আনা হয়। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪১ হাজার ১৫৫। শতভাগ ও ৯৯ ভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৪০টি। প্রশ্ন হলো, এটি কি বড় কোনো অভিযোগ না ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’? ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৩৪০টি কেন্দ্রে এমন অনিয়মের প্রেক্ষিতে কি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়?

চ. দেশে মোট ভোটার প্রায় ১০ কোটি ৪১ লাখ। নির্বাচন কেন্দ্রিক জরিপ করা হয় এক, দেড় বা দুইহাজার ভোটারের মতামতের ভিত্তিতে। গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের করা জরিপের ফলাফলে সাধারণত ভুল প্রমাণ হয় না। সাড়ে ১০ কোটির মধ্যে ২ হাজার মানুষের মতামতভিত্তিক জরিপ যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে ৪১ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে ৩৪০ কেন্দ্রের নজির ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলার সুযোগ থাকে না। ৪১ হাজার কেন্দ্রের অনিয়মের প্রমাণ সামনে আসবে বা আনতে হবে- এটা তো কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। তাহলে তো ১০ কোটি ভোটারের মতামত নিয়ে জরিপ করতে হবে। ৩৪০টি কেন্দ্রের ঘটনা তদন্ত করে নির্বাচন কমিশন বলতে পারতো, অন্যত্র এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটেনি। কিন্তু, তখন নির্বাচন কমিশন তদন্ত না করে, এখন বলছে ‘করণীয় কিছু নেই’।

ছ. টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিলো। ৩৩টিতে রাতে সিল দেওয়ার তথ্য জানিয়েছিলো টিআইবি। বিবিসি তাদের সংবাদে একটি কেন্দ্রে আগে ভোটের ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিলো। খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে ভোটের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে ফল প্রকাশ করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সেই সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটের ভিডিওচিত্র বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেছিলো ডয়চে ভেলে।

জ. টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন কমিশন বলেছিলো, রিটার্নিং বা প্রিজাইডিং অফিসারদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেনি টিআইবি। যাদের কাছে মৃত ব্যক্তিরা এসে ভোট দিয়েছেন, তাদের থেকে তথ্য নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে? নির্ভরযোগ্য বিকল্প পথে সংগৃহীত তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না? যারা নির্বাচন কমিশনকে সময়মতো তথ্য জানাননি, তারা টিআইবিকে সঠিক তথ্য জানাবেন, জানাতেন?

ঝ. ভোট শুরু হওয়ার আগে কী করে ব্যালট বাক্স ভরে গেলো? এই প্রশ্নের উত্তর জানার বা জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দায়িত্ব সেরেছিলো তারা। ভোটারের চেয়ে ভোট বেশি, কী করে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো, জানার প্রয়োজন মনে করেনি কমিশন।

৩. ‘করণীয় কিছু নেই’ বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, কেউ চাইলে আদালতে যেতে পারেন। ’সচিবরা কী করেন, প্রধানমন্ত্রীকে কেনো সবকিছু করতে হয়’, ‘গাড়ির হর্ন’ বা ‘সিজার রোধে নীতিমালা’ বা ‘এডিস মশা-ডেঙ্গু’ থেকে শুরু করে নিরাপদ খাবার, সব বিষয় নিয়েই আদালত কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। যার যা করার কথা তা করছে না বলে, কথা বলতে হচ্ছে, নির্দেশনা দিতে হচ্ছে আদালতকে। সেই নির্দেশনারও অনেকগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

এখন ’মৃত ব্যক্তি’ কেনো বা কীভাবে ভোট দিলেন, প্রতিকার চাইতে যেতে হবে আদালতে!

সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন তাহলে কী করবে বা তাদের কাজ কী? নির্বাচন কমিশনাররা জনগণের অর্থে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি-বাড়ি-বেতন-ভাতা-প্রটোকল ভোগ করবেন, আর জনগণকে আদালতে যাওয়ার নির্দেশনা দিবেন?

যে নির্বাচন কমিশনের একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার কথা, তারা যদি বলেন ‘কিছু করণীয় নেই’ প্রশ্ন আসে মানুষ তাহলে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে!

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Family reunited after 18 years

Stranded in Malaysia, man finally comes back home

55m ago