আমাদের জীবন ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’
‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ বহু আগে পড়া উপন্যাসের এই কথাটি আমাদের জীবনে চরম সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, খুব সম্প্রতি খবরে দেখতে পেলাম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে।
খবরটা পড়ে মনে হলো, এখন আমাদের কী করা উচিৎ? এসব ভেজাল বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খাবো? নাকি ওষুধ না খেয়ে জড়ি-বুটি, দোয়া-তাবিজের দিকে ঝুঁকবো? নাকি ওষুধ না খেয়ে অসুখকে আপন করে নেবো? নাকি এসব ওষুধ খেয়ে মারা পড়বো? অধিকাংশ মানুষ এই ভয়ঙ্কর তথ্যটি জানবেন না। যারা জানবেন তারা এভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে যেতে থাকবেন। আমাদের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে- “রাখে আল্লাহ মারে কে?” আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা চলছি।
অবাক লাগছে এই ভেবে যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে এতো ভয়ঙ্কর একটি তথ্য পাওয়ার পরও সরকার নির্বিকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কি এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেছে? কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে? এখনো জানি না, এরকম কোনো খবরও পাইনি। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মানের যদি এই জীবন ধ্বংসকারী ভূমিকা হয়, তখন কর্তৃপক্ষ চুপ থাকে কেমন করে? অন্যসব অব্যবস্থার মতো আমরাও অম্লান বদনে এই অপরাধ মেনে নিচ্ছি।
সে যাক কুইনাইন নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। এবার অন্য একটি গল্প বলি। বেশ কয়েকবছর আগে জেলা শহরে আমার এক আত্মীয়র বাসায় রাতে খেতে বসেছি। কারো কারো জন্য আটার রুটি বানানো হয়েছে। সেই বাসায় যখন রান্নার কাজ চলছিলো, তখন লোডশেডিং ছিলো। ঘরে আটা ছিলো না বলে পাশের দোকান থেকে আটা কিনে আনা হলো। আমরা যখন খেতে শুরু করেছি দেখলাম রুটিটা কেমন যেনো একটু বিস্বাদ লাগছে। ঠিক সে সময় লাইট চলে আসার পর দেখলাম বানানো রুটিতে অনেক পিঁপড়া মরে ভাজা হয়ে গেছে এবং বেশকিছু পিঁপড়া আমাদের পেটেও চলে গেছে। অগত্যা রুটি খাওয়া বন্ধ করা হলো। আটার প্যাকেটটা নিয়ে দেখলাম প্রায় মাস খানেক আগে এটির ব্যবহারের তারিখ পার হয়ে গেছে। তাই কোনো একটি ফুটো দিয়ে দলে দলে পিঁপড়া প্রবেশ করেছে আর আমরা পিঁপড়াভুক হয়ে তা ভক্ষণ করেছি।
পরের দিন দোকানদারকে ধরা হলে, সে কাঁচুমাচু করে উত্তর দিয়েছিল, “হামরালা ছোট দোকানি। তারিখ-টারিখ ঠিক বুঝ না। কবে কিসের দিন পার হয়া গেইলো টের পাও নাই। কন্তিুক এই আটা তো মুই বাজারের বড় দোকান থাকি কিনি আনছো ১০ দিন আগোত। তাইলে মোর দোষ কুণ্ঠে?”
কথাতো ঠিক। সেই অত বছর আগেই যদি একটি জেলা শহরের বাজারে এরকম মেয়াদোত্তীর্ণ প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হয়, তাহলে আজকে যে তা হাজার গুণ বেড়েছে, তা সহজেই অনুমেয়।
পুরো রোজার মাসটা শান্তিতে থাকতে পারলাম না। একদল মানুষ বিভিন্ন দোকানে বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় যাচ্ছেন, হেঁশেলে ঢুকে পড়ছেন, এটা-সেটা নাড়ানাড়ি করে মরা মুরগির রোস্ট বা কাবাব, পচা মাছের ভুনা, তেলাপোকা ঠাসা মিষ্টি- এমন মিষ্টি, যার রসে মিষ্টিও ভাসে, তেলাপোকাও ভাসে, পিঁপড়ামাখা রুটি বা বিস্কুট, বড় বড় সুপার শপের বাসি মাংস, মাছ, তারিখ পার হয়ে যাওয়া ঘি, মাখন, চকলেট, আইসক্রিম- ইত্যাদি মেলা কিছু উদ্ধার করেছেন। এসব দেখে নতুন করে বিরক্তির উদ্রেক হলো।
সারাবছর ধরে আমরা এসব ছাইপাঁশ গলধকরণ করছি, হজমও করছি। হজম করার পর কখনো বদহজম হয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে বা রোগ হয়ে শরীরে থেকে যাচ্ছে। সবইতো আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তাহলে হঠাৎ রমজান মাসে এসে এই তৎপরতা কেনো? এই প্রশ্ন দেশের সবার। আমরা যে ছাইপাঁশ খাই, তাতো আমরা জানি। সব ভুলে বেশ সুখে আমরা খানাপিনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বিভিন্ন সুপার শপে গিয়ে গিয়ে ভেজাল, নকল জিনিস কিনছি। কিন্তু, হঠাৎ রমজান আসার পর কীই এমন ঘটলো যে ভোক্তা অধিকারের লোকজন সচেতেন হয়ে উঠে আমাদের সামনে এসব ভেজাল, নকল, নিম্নমানের ও অস্বাস্থ্যকর খাবার এনে হাজির করলেন? অন্যভাবে বলা যায় মোড়ক উন্মোচন করলেন এবং আমাদের দুঃখ, শোক, বিস্ময় বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন।
এদেশে বিশেষ করে শহর জীবনে আমাদের এই বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক। বাংলাদেশে আমরা যা কিছু খাই, খুঁজলে এর সব কিছুতেই বিভিন্ন মাত্রার বিষ পাওয়া যাবে । ফলমূলে ফরমালিন তো শাকসবজিতে কীটনাশক, খাদ্যে ভেজাল তো পানিতে পোকামাকড়। দেশীয় ফল আম, লিচু, আনারস ও জামে এতো পরিমাণে কীটনাশক দেওয়া হয় যে বাজারে ‘এখানে ফরমালিনমুক্ত ফল পাওয়া যায়’ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। কাঁচাবাজারে যা কিছু বিক্রি হচ্ছে, সবকিছুই ক্ষতিকর। আবার দামি বা কম দামি হোটেলে রান্নার পর যা বিক্রি হচ্ছে তাও ক্ষতিকর। এসব ছাইপাঁশ খেয়ে আমরা মানে বাংলাদেশের মানুষ যে কীভাবে বেঁচে আছি, জানি না।
শুধু কি খাবার দাবার? পানি, ওষুধ, স্যালাইন, কসমেটিকস, কাপড়-চোপড় সবকিছুতেই ভেজাল আছে। যে বাতাসে আমরা নিঃশ্বাস নেই সে বাতাস দূষিত, যে পানি আমরা পান করি তাতে ময়লা, যে নদীর মাছ খাই সেই মাছে ওষুধ, যে গরুর দুধ খাই সেই গরু খাচ্ছে বিষাক্ত খাবার, যে মুরগি খাচ্ছি সেই মুরগির খাবারে বিষ। কাজেই কোথাও রক্ষা নাই আমাদের।
দেখলাম ঈদের আগে বিএসটিআই ৫২টি এবং পরে প্রায় ২২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নিতে বলেছে। এই পণ্যগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই আমার বাজারের তালিকায় আছে। ভালো কোম্পানি জেনে তাদের প্রোডাক্ট কিনতাম, এখন দেখছি বাজে মানের। অজানা-অচেনা কোম্পানি আজেবাজে জিনিস বিক্রি করে কিন্তু, নামকরা কোম্পানি কেনো করবে? এদের সব প্রোডাক্টের উপর সিল গালা করে দেওয়া দরকার। অবশ্য সেক্ষেত্রে ঠক বাছতে গা উজাড় হবে।
আমরা শুধু যে খাবারে ভেজাল খাচ্ছি, তা নয়। শরীরে মাখছিও ভেজাল। বড় বড় নামকরা সুপার শপ, যারা ধনাঢ্য পরিবারের ক্রেতা ছাড়া, সাধারণ পরিবারের ক্রেতাদের সাথে কথাও বলেন না- সেসব দোকানেও নিম্নমানের জিনিস বিক্রি করা হচ্ছে। তাদের অনেককেই জরিমানা করা হলো। জিনিস জব্দ করা হলো।
এই যে নামকরা সব বিউটি পার্লার, তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে যে তারা সেবা গ্রহীতাদের ঠকাচ্ছে। অনেক টাকার বিনিময়ে তারা মেয়াদোত্তীর্ণ প্রোডাক্ট দিয়ে গ্রহীতাদের যে সেবা দিচ্ছে, তা খুবই ভয়ঙ্কর ফল বয়ে আনতে পারে। কাজেই আমরা কী কিনছি, কী খাচ্ছি, কী গায়ে-মুখে মাখছি এর কোনো মান নেই।
এমনকী আমাদের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মাছেরা কী খাচ্ছে, এরও কোনো মান নেই। ফলে সবাই মিলে নিম্নমানের খাওয়া খেয়ে ধুকে ধুকে বেঁচে আছি। সেই গানের মতো- “যেভাবেই বাঁচি, বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের মাঝামাঝি।”
আমাদের প্রশ্ন শুধু একটাই ধরাধরির এই ভালো উদ্যোগটি শুধু রমজান মাসে না করে সবসময় বিরতি দিয়ে দিয়ে করা হয় না কেনো? ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের লোকবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেশব্যাপী ভেজাল, নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ সব মালামাল ধরা হোক এবং প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা হোক। শুধু জরিমানা নয়, তাদের বাণিজ্যের লাইসেন্স বাতিল করা হোক। আইন প্রয়োগ করা হোক শক্ত হাতে। তাহলেই হয়তো বা এদেশের মানুষ বাঁচবে, পশুপাখি, খাল-বিল, নদীনালা, বৃক্ষ সবাই বাঁচবে। সবাই শক্তের ভক্ত, নরমের যম। আমরা সেদিনের প্রতীক্ষায় থাকলাম।
লেখক: যোগাযোগকর্মী
Comments