'টাকা খাওয়া যায় না'
আজ ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ। এ বছর ঈদের আনন্দের মাঝে নীরবে পার হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়-'বায়ু দূষণ'। বায়ু দূষণ আমাদের অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। নীরব ঘাতক বায়ু দূষণের কারণে এ দেশে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে গত বছর প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু মাত্র বায়ু দূষণের কারণেই ২০১৫ সালে ২ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ মারা যায় বাংলাদেশে, এর মধ্যে শহরাঞ্চলে মারা যায় ৮০ হাজার, আর রাজধানীতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমাদের অর্জন অনেক। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজ আমরা মধ্য আয়ের দেশ। আমাদের অর্থনীতি দ্রুত সামনের দিকে ধাবমান। কিন্তু পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও অনেক বেশি হতো। বিশ্ব ব্যাংকের ওই সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে পরিবেশ দূষণ না হলে আমরা ২০১৫ সালেই আরও ৬.৫২ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় করতে পারতাম, আমাদের জিডিপি (আভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদন) বৃদ্ধির হার অন্তত আরও তিন ভাগ বেড়ে ৯ হতো।
যেহেতু আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু উন্নয়নের কথা ভেবেছি, যেকোনো ভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিকে নজর দিয়েছি কিন্তু পরিবেশের তোয়াক্কা করিনি, এর জন্য আমাদের মূল্যও দিতে হচ্ছে সীমাহীন।
কিসের বিনিময়ে আমাদের এই অর্জন?
আমরা আজ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীর মালিক, আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি ধুলা আর বিষাক্ত গ্যাসের সমুদ্রে- আমাদের রাজধানী বাতাস বিশ্বের সবচে দূষিত নগরীর তালিকার শীর্ষে, আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে কারণ আমরা দূষিত জলাধারগুলো ব্যবহার করতে পারি না। আমাদের মাথাপিছু প্রাকৃতিক বনের পরিমাণও কিন্তু সবচেয়ে নিচের দিকে।
গত ৪০ বছরে আমারে রাজধানীর চারপাশের ৭৫ ভাগ জলাভূমি ভরাট করে ফেলেছি। আমাদের দেশে যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার শতকরা ২৮ ভাগ হয় দূষণজনিত কারণে, আর সারা বিশ্বে গড়ে এই হার শতকরা মাত্র ১৬ ভাগ।
জলবায়ুর ঝুঁকির দিক থেকেও তো আমরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটা। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, জনসংখ্যা। এতটুকু দেশে এতো এতো মানুষ, আমরা দিনে দিনে আরও ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু আমাদের যেন বিকার নেই।
মনে পড়ে যায় নেটিভ আমেরিকান সেই প্রবাদ- 'যখন শেষ গাছটি কেটে ফেলা হবে, শেষ মাছটি খেয়ে ফেলা হবে, শেষ জলাধারটি বিষাক্ত হবে, তখন বুঝবে টাকা খাওয়া যায় না।'
আমাদের এখন মনে রাখতে হবে, পরিবেশ সম্মত সহজ জীবন যাপন ছাড়া আমাদের আর বাঁচার উপায় নাই। আর সে উদ্যোগ সরকার বা কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে নয়, শুরু করতে হবে ব্যক্তি পর্যায় থেকে। নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্যই এটা দরকার।
কখনো কেউ চিন্তা করেছেন, আজ থেকে অনেক বছর পর যখন আপনি থাকবেন না, তখন আপনার ছোট্ট সন্তানটি বড় হবে, তখন তার জন্য কেমন পরিবেশ রেখে যাচ্ছেন!
সরকার যদিও কাগজে কলমে পরিবেশকে গুরুত্ব দেয় কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কমই দেখি। উন্নয়নের স্বার্থে সরকারকে দেখা যায় প্রায়শই পরিবেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে। সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে সরকারকেও পরিবেশ রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
কোনো উন্নয়ন প্রকল্প যদি পরিবেশবিরোধী হয়, সরকারেরই উচিত সেসব প্রকল্প হাতে না নেওয়া ।
উন্নয়ন ও পরিবেশ বিতর্ক নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমাদের ভেবে দেখতে হবে ট্যানারি শিল্পের জন্য বুড়িগঙ্গা বা ধলেশ্বরীর মতো দুটো নদীকে আমরা যে মেরে ফেললাম সেটা ঠিক হলো কি না! চামড়া দিয়ে আমরা কতো টাকা আয় করেছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ দুটো নদী মেরে ফেলা, একটা জনপদকে দূষণের মাধ্যমে ধ্বংস করার চেয়ে বেশি কি না!
ভারত রামপালের মতো দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিজেদের বনের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে না করার আইন করে। আর আমরা আমরা আমাদের বনের গা ঘেঁষে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে পরিবেশবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়ন করি!
সরকার ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করে। কিন্তু দেশের একটা ইট ভাটাও সে আইন মানে না, কিন্তু তারপরও সব চলছে।
ইছামতি নদীর মুখ যেখানে পদ্মার নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়ে সেখানে বাঁধ দিয়ে স্থায়ীভাবে নদীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকার এই নদী পুনরুদ্ধারের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছিল। পাবনা শহরের প্রাণ এই ইছামতি নদী পুনরুদ্ধারের আশা আরও কমে গেল।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালঞ্জ শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি নয়। বরং অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা। নইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হবে কিন্তু বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না। দেশের পরিবেশ যদি বসবাস করার উপযুক্ত না থাকে তাহলে আর এতো উন্নতি দিয়ে কী হবে? আমরা আর গর্ব করব কী নিয়ে?
আর আমরা যদি পরিবেশের কথা ভুলে থাকি, এড়িয়ে যেতে চাই, তাহলে এই দেশ খুব শিগগিরই এগিয়ে যাবে সেই পরিণতির দিকে। আর কে না জানে যে, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না!
পিনাকী রায়, প্রধান প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার
pinaki@thedailystar.net
Comments