শৈশবের সেই ঈদ
ছোটবেলায় ঈদের দিনটি যতো এগিয়ে আসতো আমাদের আনন্দ ততোই বেড়ে যেতে থাকতো। চিন্তা একটাই নতুন কাপড়, সেই কাপড় পরে পাড়া বেড়ানো আর মজার মজার খাবার খাওয়া এবং যতো খুশি ততো খাওয়া। আমরা শুধু দুই ঈদেই ভালো কাপড় পেতাম। সঙ্গে এক জোড়া ভালো জুতো। যদিও তখনও আম্মা চেষ্টা চালাতেন আমাদের জামা-জুতোর সাইজ একটু বাড়িয়ে কিনতে, যাতে সারাবছর ধরে অনায়াসে চলে যায়। একটু বুঝ হওয়ার পর আমাদের প্রবল প্রতিবাদে তা আর করতে পারতো না।
ঈদে কার কেমন জামা হবে, তা লুকানোর জন্য ছিলো প্রাণান্তকর চেষ্টা। দর্জি বাড়ি থেকে কাপড় এনে এমন একটা জায়গায় লুকাতাম যেনো কেউ একটুও দেখতে না পায়। যারা বাসায় জামা বানাতো তাদের ছিলো আরও বিপদ। সবসময় সতর্ক থাকতে হতো সেলাইয়ের পর ঘর ঝাড় দেওয়ার সময় যেনো এক টুকরো কাপড়ও ঘরের বাইরে চলে না যায়। গেলেই চরম সর্বনাশ। আমার বড় ফুপুর মেয়েদের দেখেছি, বাসায় যখন ওদের জামা সেলাই করা হতো, ওরা তখন ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিতো। যাতে কেউ কাপড়ের ছায়াটাও কেউ দেখতে না পায়!
সবচেয়ে মজার ঈদের ড্রেস ছিলো পাড়ার ছেলেদের। পরিবারে যদি তিন ভাই থাকতো, তবে কি এক অজ্ঞাত কারণে তিনজনই পেতো একই ডিজাইনের পাঞ্জাবি। অথবা এক ডিজাইনের শার্ট বা গেঞ্জি। ব্যাপারটা কতোটা হাস্যকর ছিলো তা বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাদের ছোটবেলায় এতো চাকচিক্য ছিলো না। এখনকার ভাষায় বলা যায় ‘সিম্পলের মধ্যে গরজিয়াস’ কাপড়েই আমাদের ঈদ সারতে হতো। কিন্তু অনেক না পাওয়ার মধ্যে এই পাওয়াটা আমাদের জন্য অনেক বেশি ছিলো। কখনও কখনও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আরো ২/১ টা জামা জুটে গেলে, সেটা হতো বাড়তি পাওনা।
এখন যেমন ঈদ উপলক্ষে আমরা ব্যাপক কেনাকাটা করি- ফার্নিচার, গয়নাগাটি, শাড়ি কাপড়, পর্দা, চাদর, হাড়ি-পাতিল, ক্রোকারিজ- কোনো আইটেমই বাদ যায় না। কিন্তু, তখন অবস্থাটা সেরকম ছিলো না। তবে কেমন ছিলো সেসময়ের ঈদের দিনের গৃহসজ্জা? যেমন ঈদের ৪/৫ দিন আগে থেকে বাসায় একটা হৈ চৈ ফেলে দিতো আম্মা। বাসার চাদর, টেবিল ক্লথ, সোফার কভার, পর্দা সব ধোলাই করার জন্য পাঠিয়ে দিতো লন্ড্রিতে। আব্বা মাঝে-মাঝে মৃদু স্বরে বলার চেষ্টা করতো, “এতো ধোয়াধুয়ির কি আছে? তুমি আবার ঈদ উপলক্ষে আমাকেও ধোয়ার জন্য লন্ড্রিতে পাঠিয়ে দিও না।” ঐ কয়েকটা দিন আমাদের বেশ আবরণহীন অবস্থায় থাকতে হতো। আম্মাকে অনেকবার এভাবে ধোয়ার কাজ বন্ধ করতে বলা হলেও আম্মা শুনতো না। সে সবকিছু ধুয়ে, কড়া করে মাড় দিবেই। ঈদের আগের রাতে আমরা বসে বসে ঘরের পর্দা লাগাতাম, সোফার কভার ভরতাম। সে এক অন্যরকম আনন্দ, পুরনো জিনিস নতুন করে সাজানো।
আমার বন্ধুর মা ছিলো আরো এককাঠি উপরে। উনিতো ঈদের ৪/৫ দিন আগে ঘরের কার্পেট পর্যন্ত আধা ধোয়া করে মেলে দিতেন বারান্দায়। সেসময়ে এভাবেই হতো ঈদের গৃহসজ্জা। পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে কিছু ফুল, পাতা এনে ঘর সাজাতাম। এমনও ছিলো ঈদ উপলক্ষে আম্মা কুরুসকাটার টেবিল ক্লথ, ড্রেসিং টেবিলের ঢাকনা- এসব বুনতে বসে যেতো। পুরনো চাদরে নতুন করে ফুল তুলতো, কাট ওয়ার্কের কাজ করতো। আমার মনে হয় ৭০/৮০ এর দশকে এরকম ঈদ অভিজ্ঞতা ঢাকা শহরের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেরই আছে।
ঘর সাজানোর পর শুরু হতো রান্নার আয়োজন। ঈদের দিন ভোর থেকে রান্নার গন্ধে ঘুম ভেঙে যেতো। সেমাই, জর্দা, পোলাও, কোরমার গন্ধে সকাল থেকেই বাসাটা মো মো করতো। আমরা ঘুম থেকে উঠার আগেই আম্মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলতো। আম্মার বহু শখের ক্রোকারিজগুলো সেদিনই শোকেস থেকে বের করা হতো। কারণ ঈদের দিন ভালো ভালো প্লেট-গ্লাসে খেতে হয়, এমনটাই নিয়ম।
এরপর আব্বা নামাজ থেকে ফিরে এলে সবাই একসঙ্গে বসে নাস্তা খাওয়া এবং তারপরই নতুন কাপড় পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়া। কোনো বাসা বাদ থাকতো না। কোনো বাসায় সেমাই, তো আরেক বাসায় ফিরনি। আবার কোনো খালাম্মার হাতের চটপটি ভালো তো, আরেক খালাম্মার হাতের ঝাল মাংস। সবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে যখন বাসায় ফিরে আসতাম, তখন আর পেটে একটুও জায়গাও থাকতো না। ঈদ বলে এই না খাওয়া আর ঘোরাঘুরির জন্য আম্মার বকাও খেতে হচ্ছে না। এও কি কম আনন্দের?
এই রোজার ঈদের আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিলো সালামির টাকা। ২/ ৫ /১০ টাকা করে পেতে পেতে প্রায় ১০০ টাকার মতো সালামি পেতাম। আমাদের আনন্দ আর দেখে কে। এই টাকা দিয়ে যে কতো কিছু কিনে খেতাম, তার ইয়ত্তা নেই। যা অন্যান্য দিন কিনে খেতে পারতাম না, তাই খেতাম বন্ধুদের সাথে নিয়ে- আচার-হজমি থেকে শুরু করে কোক-আইসক্রিম, বাটারবান, প্যাটিস এরকম অনেককিছু। যতোদিন এই টাকা হাতে থাকতো, ততোদিন নিজেকে রাজা রাজা মনে হতো।
রাতের খাবার বাসার সবাই একসাথে খেতাম। তারপরই বসে যেতাম বিটিভি’র সামনে ঈদের আনন্দমেলা ও নাটক দেখতে। আমাদের সময়ে বিটিভি ছিলো একটাই চ্যানেল এবং অসাধারণ ছিলো তাদের অনুষ্ঠান। এই যে আমাদের মেয়র ছিলেন আনিসুল হক, ওনার উত্থানও কিন্তু ছিলো বিটিভি’র এই আনন্দমেলা দিয়েই। কতো যে ভালো ভালো সব অনুষ্ঠান ছিলো! সে যাক আমাদের সেই স্বপ্নের বিটিভি নিয়ে অন্য কোনোদিন লিখবো।
আসলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের আজকালের ঈদ এবং আমাদের ছোটকালের ঈদের সবকিছুর মধ্যেই অনেক ফারাক। তখন ঐশ্বর্য ছিলো কম কিন্তু, আনন্দ ছিলো বেশি। আমরা অনেককিছু পেতাম না, কিন্তু, যা কিছু পেতাম তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতাম। আজকালকার শিশুরা এতো জামা-কাপড় পায়, এতো খেলনা, খাওয়া দাওয়া পায় বলে হয়তো ঈদের জামা-জুতো কেনার আনন্দটা তারা সেভাবে উপলব্ধিই করতে পারে না। আর ২/৫ টাকা সালামি পাওয়ার পর দোকানে গিয়ে নিজেদের মতো করে কোনোকিছু কিনে খাওয়ার সুযোগ এই দিনের বাচ্চাদের হয় না। আর পাড়ায় পাড়ায় দলবেঁধে ঘুরে এ বাড়ি, ও বাড়ি যে মণ্ডা-মিঠাই, জর্দা-সেমাই খাওয়া যায়, সেটাও আজকের শিশুরা ভাবতে পারে না।
এখন বুঝতে পারি ঈদটা আসলে ছোটদেরই জন্যই। এখনও যখন আমি ঈদের কথা ভাবি, আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার শৈশবের ঈদ। আসাদগেট নিউকলোনির সেই ঈদ, যে ঈদে আমাদের কোনো দায়িত্ব ছিলো না, ছিলো শুধু অপার আনন্দ। ঈদ মানে আমাদের কাছে ছিলো যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা। বড়দের ঈদ মানে তাহলে কী? বড়দের ঈদ মানে দায়িত্ব, আর এই দায়িত্ব পালন করার আনন্দ। কি জানি এটাই বোধহয় জীবনের ধরণ।
লেখক: যোগাযোগকর্মী
Comments