খেলাপি ঋণ মাফ, নাজুক ব্যাংক খাত ও নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাজার
ক. দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে নেই।
খ. ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক এবং
গ. খেলাপি ঋণ মাফ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
গত ২৮ এপ্রিল এই কথাগুলো অর্থমন্ত্রী বলেছেন জাতীয় সংসদে।
ঘ. বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক সময় বিশ্বমানের ছিলো। এখন তা পিছিয়ে গেছে। পিছিয়ে যাওয়ার কারণ ৩টি:
১. পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ।
২. ঋণ পুনর্গঠনের শর্ত শিথিল করা এবং
৩. খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি আলোচনায় গত ২৮ এপ্রিল কথাগুলো বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ওয়াহেদউদ্দিন মাহমুদ।
এই বক্তব্যগুলো নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। বলে রাখা ভালো যে অর্থনীতি বিশ্লেষণ করছি না। অর্থমন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদদের থেকে পাওয়া এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু তথ্যের আলোকে আলোচনা করছি।
‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক সময় বিশ্বমানের ছিলো’- ‘এক সময়’ বলতে কোন সময় বুঝিয়েছেন তা বলা হয়নি। একটি তথ্যের আলোকে সময় সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যেতে পারে। ২০০৯ সালে সরকারি ‘বেসিক ব্যাংক’ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী লাভজনক ব্যাংক ছিলো।
রাজনৈতিক বিবেচনায় শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাংকটি রুগ্ন হয়ে যায়। প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের নামে জালিয়াত-লুটপাট হয়ে যায়। এর থেকে ধারণা করা যায়, ২০০৯ সালের আগের সময়টায় ব্যাংক খাত মোটামুটি ভালোভাবে চলছিলো। ২০০৯ সালে সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। যার পরিণতিতে সোনালী ব্যাংকের হলমার্কসহ বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটে।
২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। এর থেকে অবলোপন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। ‘অবলোপন’ মানে যে ঋণ আর কখনো পাওয়া যাবে না। আরও পরিষ্কার করে বললে, হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাফ করে দেওয়াও বলা যেতে পারে। কারণ যারা ঋণ নিয়েছিলেন তাদের আর এই ঋণ শোধ করতে হবে না। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের তুলনায় যা ৭১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা বেশি।
কেনো খেলাপি ঋণের পরিমাণ এতো বেশি হয়ে গেল? উত্তর রয়েছে অর্থনীতিবিদ ওয়াহেদউদ্দিন মাহমুদের কথায়।
‘ঋণ পুনর্গঠনের শর্ত শিথিল’ ও ‘খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন’ করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা ঋণ নিয়েছেন, তারা ফেরত না দেওয়ার পেছনে নীতিগত পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন।
‘ঋণ পুনর্গঠন’ ও ‘সংজ্ঞা শিথিল’ করার পর অর্থমন্ত্রী এখন উদ্যোগ নিচ্ছেন ‘খেলাপি ঋণ’ মাফ করে দেওয়ার। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার। মাফ করে দিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
এ প্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে।
খেলাপি ঋণ মাফ করে দিয়ে হিসাবে কম দেখানো, এটা ঠিক কোন প্রক্রিয়ার সমাধান?
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যারা ‘ইচ্ছে করে’ খেলাপি হয়েছে, তাদেরটা মাফ করা হবে না। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যিনি বা যারা সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত, তাদেরকে ‘ইচ্ছে করে খেলাপি’ প্রমাণ করা সম্ভব? বাস্তবতা তা বলে?
খেলাপি ঋণ মাফ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে না, তা কি বলা যায়?
যিনি বা যেসব শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে সুদসহ নিয়মিত তা পরিশোধ করছেন, তারা কী বার্তা পাবেন?
তারা যদি এমনটা ভাবেন যে, খেলাপি হওয়াটা তার বা তাদের জন্যে অনেক বেশি লাভজনক ছিলো? আজকের ভালো ‘ঋণগ্রহীতা’ কালকে ‘ঋণখেলাপি’ হয়ে যাবেন না- এই নীতিতে তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায়?
বাংলাদেশ কি ক্রমশ ‘খেলাপি ঋণ-বান্ধব’ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
‘পুঁজি বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই’ বুঝলাম। কার বা কাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে? যার বা যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তিনি বা তারা কি সরকারের বাইরের কেউ?
গত ২২ এপ্রিল বললেন, পুঁজিবাজার ঠিকই আছে। এ বাজার খারাপ অবস্থানে নেই। সাংবাদিকরা বাজার নিয়ে নানাভাবে ভয় দেখাচ্ছেন। সাতদিন পরে (২৯ এপ্রিল) বলছেন, ‘পুঁজিবাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই’।
অর্থমন্ত্রীর এই দুই বক্তব্যের তাৎপর্য কী?
ঋণ খেলাপির পেছনে ১৩-১৪ শতাংশ সুদের হার একটি বড় কারণ, বলছেন অর্থমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন সুদের হার ৬ ও ৯ শতাংশ নির্ধারণের। ব্যাংক মালিকরা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু, ব্যাংক পরিচালনাকারী সিইও বা এমডিরা বলছেন তা সম্ভব নয়। ফলে কার্যকর হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। আর্থিক খাতের এই জটিল টানাপড়েন থেকে বের হয়ে আসার জন্যে প্রয়োজন ছিলো একটি কার্যকর কমিশন গঠন। সে উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছে বিতর্ক।
অর্থমন্ত্রী বলছেন, দেশের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো। এডিবিও বাংলাদেশের নীতি অন্যদের অনুসরণ করতে বলছে।
প্রশ্ন হলো এতো ভালো আর্থিক অবস্থায়, ব্যাংক খাতের অবস্থা এতো নাজুক কেনো?
দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো মানে, ব্যবসার বা ব্যবসায়ীদের অবস্থাও ভালো হওয়ার কথা। তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এতো বাড়ল কেনো? মাফ করে দেওয়ার প্রসঙ্গই বা আসছে কেনো?
বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক, এডিবি, চীন, ভারতসহ বহু দেশ-সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কোনো প্রকল্প সঠিক সময়ে ও বাজেটে শেষ করতে পারছে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিন-চারগুণ খরচ বাড়ছে।
এসব প্রকল্পের ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার, শর্ত অনেক কিছুই অপ্রকাশিত। ফলে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বড় প্রকল্পগুলো নিয়ে আশার পাশাপাশি, বড় শঙ্কারও জন্ম দেয়। কেনিয়া চীনের থেকে ঋণ নিয়েছিলো রেলখাতে। শোধ করতে না পারায় চীনের কাছে সমুদ্রবন্দর লিজ দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় চীনের ঋণ-বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার। রাস্তা, ফ্লাইওভার, ব্রিজ, পাঁচ তারা হোটেল, স্টেডিয়াম, এয়ারপোর্ট... নির্মিত হয়েছে চীনের ঋণে। সমুদ্র ভরাট করে শ্রীলঙ্কাকে দুবাই বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন রাজা পাকসে। তার নিজের এলাকা হামবানতোতাকে একটি আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত করেছেন। একাধিক ফাইভস্টার হোটেল, আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর তৈরি করেছেন।
বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়েছে এর পেছনে। একটা আন্তর্জাতিকমানের দৃষ্টিনন্দন শহরে পরিণত করেছেন তার এলাকাকে। এসব কাজ হয়েছে চীনের ঋণ এবং বুদ্ধিতে। আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরটিকে এখন বলা হয় ‘এম্পটি এয়ারপোর্ট’। খালি পড়ে থাকে এয়ারপোর্ট, ব্যবহার নেই কিন্তু, পরিচালনার বিপুল খরচ আছে। পাঁচতারা হোটেলগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। ঋণের অর্থ সঠিক পথে বা পরিকল্পনায় ব্যবহার করা হয়নি। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর লিজ দিয়ে দিতে হয়েছে চীনের কাছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কা বা কেনিয়ার চেয়ে শক্তিশালী। ফলে কেনিয়া বা শ্রীলঙ্কার উদাহরণ হয়তো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না।
কিন্তু, ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার যদি শক্তিশালী না হয়, নাজুক, বা নিয়ন্ত্রণে না থাকে- তাহলে পরিণতি নিয়ে কী একটা শঙ্কা তৈরি হয় না? ঋণের অর্থে কর্ণফুলীর নিচে দিয়ে টানেল না উপর দিয়ে ব্রিজ, খরচ বিবেচনায় কোনটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিলো? গবেষণা ছাড়া নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। লক্ষাধিক কোটি টাকা ঋণ ও প্রায় সম্পূর্ণ বিদেশি লোকবল দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কতোটা লাভজনক হবে? নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণা তথ্য কোথাও নেই। সময় এবং খরচ তিন-চারগুণ বৃদ্ধির ফলে মেগা প্রকল্পগুলো যদি ভায়াবল না হয়?
সুদসহ ঋণ ফেরত দেওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা কী উড়িয়ে দেওয়া যায়?
Comments