রক্তের রঙ এক, দেখছি আলাদা!
প্রাণহীন মানুষ প্রায় চারশ, আহত পাঁচশ মানুষের আর্তনাদ, যা শুধুই সংখ্যা। শ্রীলঙ্কাসহ সারা পৃথিবী স্তব্ধ। যা সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। রক্তের রঙ, অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি বা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহের বর্ণনা দেওয়া যায়। নিষ্পাপ জায়ানদের ছবির দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে থাকা যায়। পিঠে ‘বোমা-ব্যাগ’ নিয়ে যে দানবের এগিয়ে যাওয়া দেখা যায়, তার প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করা যায়। বেদনা-যন্ত্রণা, কষ্ট-অসহায়ত্ব বোঝানো যায় না। হয়ত কিছুটা অনুধাবন করা যায়।
বহু রক্তের বিনিময়ে ১৯৪৫ সালের পরের পৃথিবী, মোটামুটিভাবে মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিলো। মানুষ নিজেই নিজেকে সভ্য হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিলো। সেই পৃথিবী আবার বন্য-হিংস্র রক্ত পিপাসু হয়ে উঠেছে। আজ পৃথিবীতে কোনো নিরাপদ স্থান নেই, দেশ নেই। কেনো এমন হয়ে উঠলো পৃথিবী? অন্য গ্রহ থেকে কেউ এসে পৃথিবীর চরিত্র বদলে দেয়নি। পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষ নিজেই নিজের জীবন বিপন্ন করে তোলার বীজ বপন করেছে। নিউজিল্যান্ড থেকে শ্রীলঙ্কা, কোনো নৃশংসতাই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। আমরা তা বলতে চাই না, স্বীকার করতে চাই না। ‘ঘটনা বিচ্ছিন্ন’ নয়, কিন্তু আলোচনাটা ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ করতে পছন্দ করি। যার যার সুবিধা অনুযায়ী, লাভ-ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী তা বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করি।
১. শ্রীলঙ্কার এই দানবীয় তাণ্ডবের জন্যে প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয়েছে ইসলামী গোষ্ঠী ‘ন্যাশনাল তাওহিদ জামায়াত’কে (এনটিজে)। এনটিজের যে সাংগঠনিক শক্তি, তা দিয়ে এতো বড় অঘটন ঘটানো সম্ভব নয়। প্রথম তিনদিন বলা হয়েছে ‘বিদেশি শক্তি’র সহায়তা নিয়ে তারা এই আক্রমণ করেছে। তারপর আইএস দায় স্বীকার করেছে। জন্মস্থানে প্রায় বিলুপ্ত আইএস এতো দূরে শ্রীলঙ্কায় এসে এমন তাণ্ডব চালালো!
হয়তো এনটিজে আইএসের হয়ে সরাসরি আক্রমণ করেছে, হয়তো তারা ‘বিদেশি শক্তি’র সহায়তা নিয়েছে বা সহায়তা দিয়েছে।
প্রকৃত তদন্ত, রহস্য উন্মোচন হবে?
জোর দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলা যায় না।
ভারতের সমর্থনে তামিলদের সশস্ত্র সংগ্রাম, ভারতীয় সমর্থন প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তামিল বিদ্রোহ দমন। হাজার হাজার তামিল নারী-শিশু-যুবকের জীবন পাহাড়-জঙ্গলে হারিয়ে গেছে, সাগরে ভেসে গেছে। তামিল টাইগারদের কথা এখন আর শোনা যায় না। বাইরে থেকে জানি, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গেছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন, স্বজন হারানোর বেদনা, প্রতিশোধ স্পৃহা তামিলদের মন থেকেও গেছে?
এই অঞ্চলে চলছে চীন-ভারতের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে তাদের পছন্দের সরকার দেখতে চায় চীন-ভারত উভয়েই। নেপাল-মালদ্বীপ-শ্রীলংকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার পরিবর্তনে বারবার দৃশ্যমান হচ্ছে চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব। চীনের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার কথা জানা যায় না। শ্রীলঙ্কায় তাদের বিশাল স্বার্থ, প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। সুতরাং সেখানে তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা নেই, বিশ্বাস করা কঠিন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা যে এই অঞ্চলে তৎপর, তা খুব একটা গোপন কিছু নয়। ভারত নাকি আক্রমণের ঘণ্টা খানেক আগে শ্রীলঙ্কাকে সতর্কও করেছিলো। কিন্তু চীন-ভারতের শক্তিশালী গোয়েন্দা চোখ ফাঁকি দিয়ে, এনটিজেকে দিয়ে আইএস এই তাণ্ডব চালাতে সক্ষম হলো! বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। বলা হচ্ছে, নিউজিল্যান্ডের ঘটনার প্রতিশোধেই শ্রীলঙ্কায় আক্রমণ। আবার এই তথ্যও সামনে আসছে, সাত-আট বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তামিল টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে হত্যা করা হয়েছিলো নয় বছর আগে। যার মধ্য দিয়ে যবনিকা ঘটেছিলো তামিল সংগ্রামের।
শ্রীলঙ্কায় এই বোমা তাণ্ডবের এতো এতো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরও মনে হয়, অদৃশ্য কোনো সত্য হয়তো জানা গেলো না।
এনটিজের মতো ক্ষুদ্র শক্তিকে কোনো বৃহৎ শক্তি কীভাবে ব্যবহার করছে, কেনো করছে, তা কি কোনোদিন জানতে পারবেন শ্রীলংকার স্বজন হারানো জনগণ?
২. ফ্রান্স বা নিউজিল্যান্ডের আক্রমণ দেখে পৃথিবীর মানুষ স্তম্ভিত। ফ্রান্সের রাস্তায় গাড়ি চাপা দিয়ে, ভবনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ডের মসজিদে ঢুকে মানুষ হত্যা! এটা কি অবাক বা বিস্মিত হওয়ার মতোই ঘটনা? প্রথম উত্তর ‘হ্যাঁ’। একটু পেছন ফিরে বিশ্লেষণ করলে কী দাঁড়ায় বিষয়টি?
পুরো ইউরোপে বহু মানুষের দেখা মিলবে, যারা এসেছেন সিরিয়া-লিবিয়া-ইরাক থেকে। ইউরোপের একজন নাগরিক যে জীবনযাপন করেন, সিরিয়া-লিবিয়া-ইরাকের জনগণ তার চেয়ে খারাপ ছিলেন না। শুধু কথা বলার অধিকারের জায়গাটি ছাড়া। তারা এখন ইউরোপের ‘রিফিউজি’। জার্মানির রাস্তায় বোরখা পরিহিত যে মধ্য বয়সী রমণী আপনার কাছে সাহায্য চাইবেন, তিনি হয়তো এসেছেন সিরিয়া থেকে। হয়তো আপনার চেয়েও তার বিলাসী জীবন ছিলো দামাস্কে। উত্তাল সমুদ্র হয়ত কেড়ে নিয়েছে তার শিশু সন্তান, স্বামীকে।
তিনি এখন রিফিউজি পরিচয়ে ‘ভিখারি’।
আমেরিকা-ইউরোপ মিলে ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার সময় কল্পনা করেনি যে, ভয়াবহ উত্তাল সমুদ্র অতিক্রম করে তারা ইউরোপে চলে আসবেন!
সভ্যতা ধ্বংসের দায়ভার আমেরিকা-ইউরোপকে, পৃথিবীকে বহন করতে হবে না?
আইএস কারা তৈরি করলো, কীভাবে শতশত নতুন মডেলের জিপ গাড়ি আইএসের হাতে গেলো, কীভাবে-কাদের সহায়তায় আইএস ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করলো, কোনো কিছুই তো অজানা নয়। আইএসের হাতে ইসরাইলি-আমেরিকান-ফ্রান্সের সর্বাধুনিক অস্ত্র, জাপানি-আমেরিকান জিপ, কারা তুলে দিলো?
আমেরিকা-ইউরোপ নিজেদের স্বার্থে বোমা মেরেছে সিরিয়া-লিবিয়া-ইরাকে। রাশিয়াও সিরিয়ায় বোমা মারতে এসেছে নিজেদের স্বার্থে। আসাদ-সাদ্দাম-গাদ্দাফির পতন চাওয়া হয়েছে, দেশগুলো দখল করে সম্পদ লুট করার স্বার্থে। দেশগুলোর সাধারণ জনগণের কথা কেউ ভাবেনি।
৩. তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে এসেছিলো আফগানিস্তান। তার বিপরীতে আমেরিকা তৈরি করেছিলো মুজাহিদ, আল-কায়েদা, তালেবান। পুরো পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যে জঙ্গিবাদে পরিণত হয়ে গেলো, তার পেছনেও আমেরিকা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আল-কায়েদা, তালেবান, আফগান মুজাহিদদের অস্ত্র-অর্থ দিয়েছে আমেরিকা। সেই আমেরিকাই তালেবান-আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে এসেছে, ইউরোপের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে। বছরের পর বছর ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর আবার ‘আমেরিকা-তালেবান’ বৈঠক চলছে কাতারে! কতো শত-হাজার আফগান শিশু-নারী-যুবকের প্রাণ গেলো এই যুদ্ধে? জবাব কারো কাছে নেই, দিবেও না কেউ!
৪. পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। খাদ্য-শিক্ষা-পানি-চিকিৎসা নেই। ইসরায়েল অবাধে মাদক সরবরাহ করছে, তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে। ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের গাজায় লোকসংখ্যা ১৭ লাখ।
২০১৮ সালেও ইসরায়েল লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করেছে ১৭ লাখ অসহায় গাজাবাসীর উপর।
গাজার দুই দিকে ইসরাইল, একদিকে মিসর, অন্যদিকে সাগর।
ইসরায়েল এবং মিশরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ, সাগরেও চলাচল করতে দেয় না ইসরায়েল।
বেঁচে থাকা, টিকে থাকার প্রয়োজনে তারা ইসরাইল ও মিসরের থেকে গোপনে খাদ্য-অস্ত্র আনার জন্যে শত-শত সুরঙ্গ তৈরি করেছে। পিরামিডের চেয়ে কম বিস্ময়কর নয় এসব সুরঙ্গ। ইসরাইল প্রায় প্রতিদিন গাজায় আক্রমণ করে ফিলিস্তিনি নারী-শিশু হত্যা করছে। ৬ হাজারেরও বেশি শিশু ইসরাইলের কারাগারে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ফিলিস্তিনি শিশুর প্রশ্ন ‘কোথায় আজ বিশ্ব বিবেক?’ উত্তর মেলেনি। শ্রীলঙ্কান শিশুর প্রশ্ন ‘হোয়ার ইজ গড’? উত্তর মেলেনি। সৌদি আরব শত-শত ইয়েমেনি নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ হত্যা করছে বোমা মেরে। শুধুমাত্র শাসক পছন্দ নয় বলে চলছে এই হত্যাকাণ্ড। ইয়েমেনি শিশুর কান্না সভ্য জগতের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না।
ফিলিস্তিনি হাজার হাজার নারী-শিশু-যুবকের রক্তের যে রঙ, ফ্রান্স-নিউজিল্যান্ড-ইয়েমেন-আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কায় নিহতদের রক্তের রঙও একই রকম। কিন্তু বিশ্ববিবেক কি একভাবে দেখছে, একভাবে কাঁদছে?
৫. শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন দুর্ভিক্ষের যে চিত্র এঁকে গেছেন তার তুলিতে, তা বোঝার জন্যে শিল্পবোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন হয় না। শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ প্রশ্ন করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে, আপনি দুর্ভিক্ষের উপর ছবি আঁকলেন অথচ বন্যার ছবি আঁকলেন না কেনো?
উত্তরে জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন, ‘বন্যা প্রকৃতির। তাই এর বিরুদ্ধে করার কিছুই নেই। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। মানবতার অপমান আমাকে ব্যথিত করেছিলো। তাই দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছি।’
পৃথিবীর এই রক্ত ঝরানো আর্তনাদ তো মানুষের সৃষ্টি। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের পরিচিতি জঙ্গি-সন্ত্রাসী। শ্রীলঙ্কায় যারা আক্রমণ করলো, ধর্মীয় পরিচয়ে তারাও মুসলিম। তাদের কেউ কেউ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াতেও পড়াশোনা করেছে।
গলদটা কোথায়? ইংল্যান্ড-ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা থেকে শত-শত তরুণ-তরুণীরা কেনো আইএসে যোগ দিলো?
বেশ কয়েক বছর আগে কথাটা বলেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। ‘ইসরায়েল আকাশ থেকে বোমা মেরে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধ বিমান নেই, তারা নিজেরাই হয়ে যাচ্ছে এক একটি মানব বোমা।’
জাতিসংঘ-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম-বিশ্বনেতারা ফিলিস্তিনিদের বলছে জঙ্গি-সন্ত্রাসী। তাদের অবস্থান দখলদার হত্যাকারী ইসরায়েলের পক্ষে, মানবতার বিপক্ষে। বর্তমান পৃথিবীর এই পরিচয়ে, এর কী কোনো প্রভাব নেই?
৬. পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ উন্মাদ শাসকেরা মানবতার অপমান করছেন। তাদের তৈরি করা জঙ্গিবাদ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের জীবন পরিণত হচ্ছে সংখ্যায়। অপকর্মের গোপনীয়তা যখন ফাঁস করে দিচ্ছেন একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, তখন মত প্রকাশের নীতিবাক্য শেখানোওয়ালারা গ্রেপ্তার করছেন তাকে।
পৃথিবীব্যাপী যে হানাহানি, রক্তপাত, তার নেপথ্যে অন্যায্যতা-মানবতার অসম্মান-অপমান। জাতি-গোষ্ঠী বা ধর্ম দেখে খোঁজা হচ্ছে সমাধানের পথ। অন্যায্যতার অবসান ঘটাতে নির্মোহ-সামগ্রিক চেষ্টা নেই। যার সম্ভাবনাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান নয়। শ্রীলঙ্কা থেকে ফিলিস্তিন, ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়া-ইয়েমেন থেকে ফ্রান্স-নিউজিল্যান্ড-আফগানিস্তান বৈশ্বিক সন্ত্রাসের শিকার। অথচ বিশ্ব মিডিয়া এখন বলছে ‘এ ব্রান্ড নিউ টেররিজম ইন শ্রীলঙ্কা’! আসলে কী তাই, পৃথিবী এমন সন্ত্রাস দেখেনি আগে?
একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পৃক্ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমাধান, বিচ্ছিন্ন চেষ্টা বা উদ্যোগে সম্ভব নয়। রক্ত, সব মানুষের রক্তের রঙ তো একই রকম। দেখছি কেনো আলাদা চোখে!
s.mortoza@gmail.com
Comments