পথচারীবান্ধব পারাপার নিশ্চিত না করে জরিমানা কতটা যৌক্তিক?
সকালে উঠেই দেখলাম বিআরটিএ-এর পৃথক সাতটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কে অভিযান চালিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া ২৮৭ জন পথচারীর কাছ থেকে ৪৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে। তিনদিনের এই অভিযানের প্রথম দিনেই ঢাকা এবং চট্টগ্রামে এভাবে যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া পথচারীদের তিন লাখেরও বেশি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
কিছুদিন আগেই আবার দেখলাম দেখলাম বনানীতে ফুটওভার ব্রিজের বদলে সড়ক দিয়ে যত্রতত্র বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পারাপারকারীদের ধরে ঘণ্টাব্যাপী কাউন্সিলিং ক্লাসে পাঠানো হয়েছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান নিয়ে তবেই একেকজন ছাড়া পেয়েছেন ক্লাস থেকে।
সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে জরিমানা, কিংবা লেকচারের আয়োজন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু দুইদিন পরপর এতো আয়োজন করে নিরীহ পথচারীদের হাইকোর্ট দেখাতে দেখলে দুঃখই লাগে। আজকে জরিমানা, কালকে ঘণ্টাব্যাপী লেকচার, আর পরশু দুর্ঘটনায় মারা গেলে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে একটা ফুটওভার ব্রিজ।
বুয়েটের একসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণাও বলছে, ঢাকা শহরে ২০১১-২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের ১৭৪০ জনই ছিলেন পথচারী। মৃতের সংখ্যা এবছর অবধি কত দাঁড়িয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। তারপর ও মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে, যাবার পথে জরিমানা দিলেও ফেরার পথে ঠিকই একইভাবে যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছে, কিংবা ঘণ্টাব্যাপী লেকচার নিলেও ক্যাম্পেইন শেষেই আবার আগের অভ্যাসে ফিরে যাচ্ছে। এতো কিছু করে তাতে কতটুকু লাভ হয়েছে বা মানুষের অভ্যাস কতটা পাল্টেছে, সেটা কি নিরূপণ করা গেছে? কিংবা আমরা কি কখনো খতিয়ে দেখেছি পথচারীদের এই ওভারব্রিজ ব্যবহারে এতো অনীহার পেছনের কারণ কী?
ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। আমরা সবাই জানি, লিফট অপেক্ষা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা আমাদের শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু তাও আমাদের অনেকেই কিন্তু লিফটই ব্যবহার করছি। এই সহজ যুক্তির কথা না হয় বাদই দিলাম। যাদের শারীরিক সামর্থ্য আছে, তাদের অবশ্য আলসেমি করা মানায় না। কিন্তু এই ২৫-৩০ ফুট উঁচু ফুট ওভারব্রিজ কতটা পথচারীবান্ধব সে বিষয়টি কি আমরা ভেবে দেখেছি?
দুনিয়াব্যাপী সড়কে পথচারীদের অগ্রাধিকার থাকলেও, এই দেশে গাড়ি আছে বলে একদল মানুষ বিরামহীনভাবে আরাম করে সাঁইসাঁই করে চলে যাবে, আর তাদের আরাম নিশ্চিত করার জন্য নিরীহ পথচারীদেরকে তিনতলা সমান উঁচু ওভারব্রিজে ওঠার জন্য বাধ্য করা হবে। কোমর বা হাঁটু ব্যথায় কাতর আমাদের বয়স্ক বাবা-মা, গর্ভবতী বা ছোট বাচ্চা নিয়ে চলাফেরা করা বোন-ভাবী, মাথায় এক মণ সমান বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া কোন মজুর কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধী-অসুস্থ রোগীর পারাপারের জন্য এদেশে আলাদা কোন উপায় নেই। কেউ হয়তো আবার জেব্রা ক্রসিং-এর কথা ভাবছেন। কিন্তু এই দেশে কোন সিগন্যালটি নিয়মমাফিক চলে আমার জানা নেই। আর, এদেশে তো জেব্রা ক্রসিং-এ ই পথচারী চাপা পড়ে মরে থাকে। আর মরে গেলেও যে পুরস্কার মিলে তা হলো— মৃতের নামে একটা ফুটওভার ব্রিজ।
যদিও সম্প্রতি কিছু কিছু ফুটওভার ব্রিজের সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে পথচারীদের আকৃষ্ট করার জন্য দুই সিটি করপোরেশন থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ২০১৫ সালের ডুয়েট-এর একটি সমীক্ষা বলছে পথচারীদের ওভারব্রিজ ব্যবহারের অনীহার পেছনে যে কারণ রয়েছে, তা হলো এগুলো ব্যবহার করা নিরাপদ নয়, সময় সাপেক্ষ, অনেক পথ ঘুরে এসে উঠতে হয়, অধিকাংশের পরিবেশ নোংরা, এবং হকারদের দখলদারিত্ব।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, পথচারীরা ওভারব্রিজ ব্যবহার অপেক্ষা আন্ডারপাস ব্যবহারে বেশি পক্ষপাতী এবং ওভারপাস-আন্ডারপাস যাই হোক তাতে এলিভেটর থাকা বাধ্যতামূলক। এতে করে, বয়স্ক নাগরিক, বোঝা বহনকারী ব্যক্তি কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পারাপার সহজ হয়। সরকার যে পরিমাণ অর্থ অপরিকল্পিতভাবে পথচারী পারাপার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যয় করছেন, সে অর্থ দিয়ে সহজেই সবার জন্য ব্যবহারোপযোগী আন্ডারপাস নির্মাণ করতে পারত। কিন্তু তা না করে, পথচারীদের হয়রানি করাটা অনৈতিক। কারণ পথচারীরা যাতে রাস্তায় অগ্রাধিকার পান, বা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলাফেরা করতে পারেন সে ব্যাপারে আইনেই বলা আছে।
তাছাড়া, পথচারীদের শাস্তির আওতায় আনার আগে ঢাকা শহরের সে সব অসংখ্য লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের শাস্তি নিশ্চিত করা উচিৎ, যারা দিনের পর দিন ঘুষের বিনিময়ে মামলা রুখে নিরীহ পথচারীদের চাপা দেন। অসাধু ট্রাফিক পুলিশদের নামেমাত্র ‘প্রত্যাহার’ না করে প্রকৃত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়ে দুদিন পর পর নিরীহ পথচারীদের হাইকোর্ট দেখানো নিদারুণ উপহাসেরই নামান্তর।
নীলিমা জাহান: রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments