বাস থেকে সোশ্যাল মিডিয়া- কোথায় নেই আপনারা
আমি ঢাকা শহরের একজন নিয়মিত বাসযাত্রী। শিক্ষাজীবন থেকে কর্মজীবন- পুরোদস্তুর বাসযাত্রী। শিক্ষাজীবনে বাবার পাঠানো টাকায় প্রতিদিন চারশো টাকা সিএনজির পেছনে খরচ করার মতো অবস্থা আমার ছিলো না। কর্মজীবনে এসেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটামুটি দূরত্বের গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য বাসই ভরসা। কারণ, বেতনের তিনভাগের একভাগ টাকা প্রতিদিন সিএনজি কিংবা রাইড শেয়ারকে দিয়ে শৌখিনতা প্রদর্শন করার মতো আর্থিক অবস্থা এখনো আমার হয়ে উঠেনি।
আমার সঙ্গে যাদের প্রতিনিয়ত দেখা-কথা হয়, তারা হয়তো বা গত একমাসে ‘র্যাংগস-এর দোলনচাঁপা কিভাবে আমার জীবনকে সহজ করেছে’ শীর্ষক গল্পটি শুনেছেন। তবে আমার গণ্ডি যেহেতু খুব ছোট, তাই বাকিদের উদ্দেশ্যে একটু বলি- র্যাংগস মোটরস লি: মিরপুর ১২ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দোলনচাঁপা নামের দুটো মহিলা বাস চালু করেছে, যেগুলো আমি নিয়মিত ব্যবহার করছি। অ্যাপের মাধ্যমে বাসগুলোর অবস্থান জেনে এখন খুব সহজেই অফিসে যাতায়াত করতে পারছি। বাসগুলোতে চালকের সহকারীও মহিলা হওয়াতে, কেউ বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রা-এর হুক ছুঁয়ে দিলো কিনা, সেটা নিয়ে অন্ততঃ আমার দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কিংবা, ধাক্কাধাক্কি করে উঠার সময় কেউ আবার নিতম্বে আচমকা চাপ দিলো কী না, সেটিও ভাবতে হয় না।
কিন্তু সুদিনের গল্প এখন থাক। টি-শার্টে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ বলায় যাদের পুরুষত্বে আঘাত লাগলো, তাদের উদ্দেশেই বলছি, এই আপনাদের সঙ্গেই রোজ বাসে চড়তাম আমি। আপনাদের সঙ্গে আমার নিত্যদিনের পরিচয়। গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর কথা বাদ দেন, এই আপনারাই নারীযাত্রীর শরীরে শরীর লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পাবলিক বাসেই বিকৃত আনন্দ খোঁজেন। শরীরের ভার-ব্যাগ-ওড়না সামলাতে সামলাতে পড়ে যেতে নিলেও এই আপনারাই আবার নির্লজ্জের মতো হাসেন। ‘হার্ড ব্রেক’-এর অজুহাতে নারীর গায়ের উপর পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে কিংবা ভিড়ের মধ্যে নামার সময় বুকের উপর আলতো করে কনুই ছুঁয়ে দিয়ে এই আপনারাই পৈশাচিক আনন্দ পান।
আপনাদের পুরুষত্ব আপনাদের শক্তির আধার। নারী উঁচু গলায় প্রতিবাদ করলে এই আপনারাই বংশ-পরিচয় নিয়ে ছবক দেন, ঝগড়া করলে “তুই চিনোস আমি কে?” বলে হুংকার দেন। “মেয়ে মানুষ, এতো কথা বলার কী দরকার” বলে জ্ঞান দেন, কিংবা “বাসে চড়লে এমন একটু-আধটু ধাক্কা লাগবেই” বলে ঘটনাগুলোকে খুবই স্বাভাবিক বলে আখ্যায়িত করেন। পত্রিকায় নারী যাত্রীর ভোগান্তি নিয়ে ফিচার লিখলে এই আপনারাই আবার কমেন্টে লেখকসহ সমগ্র নারীজাতিকে হেনস্থা শুরু করেন। আপনার শক্তির কাছে নারীর আবার তুলনা হয় না কী?
নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত নয়টি সিটের দখল নিতেও আপনারা পিছপা হন না। এই আপনারাই উঁচু গলায় দাবি করেন, “আগে পুরুষের সিটে বসা সব মহিলা উঠান, তারপর উঠবো”। অথচ আপনারা জানেনই না (হয়তো জানতে চান না), পুরুষের আসন বলে কিছু নেই, সংরক্ষিত আসন ব্যতীত বাকি আসনগুলো নারী-পুরুষ সবার। আপনারাই বলে উঠেন, “যাদের এতো সমস্যা তারা বাসে না উঠে প্রাইভেটকারে চড়তে পারেন না?”
২০১৭ সালে যখন মন্ত্রিপরিষদে ‘রোড-ট্রান্সপোর্ট অ্যাক্ট-২০১৭’-এর খসড়া অনুমোদন হয়, যেখানে বলা হয় সংরক্ষিত আসনে পুরুষ বসলেই এক মাসের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, সেটিতেও আপনাদের ঘোর আপত্তি। অনেকেই ঠিক এই টি-শার্টের ঘটনার মতো ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে লিখেছেন, “একেবারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন, এই আইন শুনে হাসতে হাসতে ফাঁসিতে ঝুলে মরে যাবো” কিংবা “#সমঅধিকারের খ্যাতা পুড়ি”।
আচ্ছা আপনারা কি জানেন, আপনাদের কর্মজীবী মা-বোন-স্ত্রী-বন্ধুরাও এই হয়রানি সহ্য করেন? ব্র্যাকের ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী শতকরা ৯৪ ভাগ নারী গণপরিবহনে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার। কিন্তু, তাদের বেশিরভাগই প্রতিবাদ করেন না, প্রতিবাদ করার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম খুঁজে পান না কিংবা প্রতিবাদ করার পর উল্টো হেনস্থা হওয়ার ভয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করে যান। এই ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ টি-শার্টের বার্তাটুকু হয়তো আপনাদের কর্মজীবী মা-বোন-স্ত্রী-বন্ধুরাও দিতে চান, কিন্তু তাদের মুখে লাগাম দিয়ে রেখেছেন এই আপনারাই।
তাই কোনো নারীকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী চলাফেরা করতে দেখলেই আপনারা দিশাহারা হয়ে যান, কখনো আপনারা তাদের মুখ চেপে ধরেন, আর কখনো বা তিরস্কার করেন। মানুষ ভাবতে পারেন না, বোন-বন্ধু-মা... ভাবতে পারেন না।
লেখক: নীলিমা জাহান, সাংবাদিক
Comments