এক সময়ের বামদুর্গে এখন লড়াই ত্রিমুখী
শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী। টালিগঞ্জে সকাল-সন্ধ্যা সেটের ব্যস্ততার বাইরে এখন তার নতুন ব্যস্ততা নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো হুড খোলা জিপে চড়ে, নইলে কোনো পথসভায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তৃণমূল কংগ্রেসের উন্নয়নমূলক কাজ, মমতা ব্যানার্জির সততা ইত্যাদি বলে যাওয়া।
মিমি এবার প্রার্থী কলকাতার অদূরে যাদবপুর কেন্দ্রের। যাদবপুর কেন্দ্রটি ঐতিহাসিক। কেননা ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালে এই আসন ছিল বামফ্রন্টের। কিন্তু ইন্দিরা হত্যার পটভূমিকার কারণে ১৯৮৪ সালে রাজনীতিতে নবাগতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ী হন। তিনি আবার হেরে যান ১৯৮৯ সালে সিপিএম প্রার্থী মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে। ৯১ সালেও জয়ী হন ওই বাম প্রার্থীই।
আবার ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পরিবারের কৃষ্ণা বসু জয়ী হন। এরপর ৯৮ এবং ৯৯ সালেও জয়ী হন কৃষ্ণা বসু। যদিও পরের দুবার তিনি ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী।
২০০৪ সালে আসন ফিরে পায় বামেরা। সুজন চক্রবর্তী জয়ী হন। ২০০৯ সালে সুজন চক্রবর্তী হেরে যান আবার তৃণমূল কংগ্রেসের কবির সুমনের কাছে। ২০১৪ সালে কৃষ্ণা বসুর ছেলে সুগত বসু জয়ী হন তৃণমূলের হয়ে।
ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে যাদবপুর আসন বামদুর্গ হিসাবে পরিচিত পেলেও আস্তে আস্তে অ-বাম এলাকা হিসাবে রূপান্তর ঘটে এবং ডানপন্থী রাজনীতিকদের জন্য একটা উর্বর ভূমি হিসেবে রূপ লাভ করে।
সেই জায়গা থেকেই লড়ছে এবার রাজনীতিতে নবাগতা জলপাইগুড়ির মেয়ে মিমি চক্রবর্তী।
শুক্রবার কলকাতা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে সোনারপুর এক নম্বর ব্লকের বহিরাহাটার একটি পথসভায় যোগ দেওয়ার সময় কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
মিমি জানান, অভিনেত্রী হওয়ার ইচ্ছা থেকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। অভিনেত্রী হিসাবে মানুষের মন জয় করেছেন এবং তিনি মমতা ব্যানার্জির একজন সৈনিক হতে চান, নেত্রী নন। কাজ করতে চান মানুষের জন্য। তাই তিনি তৃণমূলের পক্ষে ভোট চাইছেন। মিমি মনে করেন, তৃণমূল ছাড়া রাজ্যে উন্নয়ন হবে না। শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকতে অবশ্যই মমতার হাত শক্তিশালী করতে হবে।
বাংলাদেশের তার অনেক অনেক ফ্যান আছেন, যারা প্রতিনিয়ত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, সবাই খুব খুশি যে আমি রাজনীতিতে এসেছি, যোগ করেন মিমি চক্রবর্তী।
মিমি বলেন, দেখুন আমি মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করি মানে মানব ধর্মে। আমার কেন্দ্রে যেদিন ভোট হবে ১৯ মে সেদিন পবিত্র রমজান চলবে। তাই সেদিন অনেকেই রোজা রেখে ভোট দেবেন। আমি তাই সেদিন কিছু মুখে তুলবো না। রোজা রাখবো। ভগবান-আল্লাহ যাই বলুন, আমাকে আশীর্বাদ করবেন, নিশ্চয় আমি এইভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।
সোনারপুরের ওই সভায় দেখা গেছে যেমন ১৮ বছর বা তারও কম বয়সের দর্শনার্থী যারা ভোটারই নন আবার দেখা গেছে আশি বছর ছুঁইছুঁই করে এমন ভোটারদেরও।
এমন একজন প্রিয়া মণ্ডল (ভোটার নন) দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মিমিকে তার ভীষণ পছন্দ। মিমির অনেক সিনেমা দেখেছেন। এবার তাকে মঞ্চে দেখতে এসেছেন। ভোটার হলে ভোটও দিতেন।
রুচিবালা রায় নামের একজন প্রবীণ নাগরিক বললেন, “আমি টেলিভিশনের মাঝে মাঝে মিমিকে দেখি। ভালো লাগে। বাড়ির পাশে মিমি এসেছে তাই দেখতে এসেছি।”
মিমি কে কি ভোট দেবেন? এই প্রশ্নের জবাবে “ভোট কাকে দেবো সেটা বলবো না। তবে মিমি কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। আমার নাত বউয়ের মতো..” বলেই হেসে দিলেন তিনি।
স্থানীয় তৃণমূল নেতা বিপ্লব মণ্ডল জানালেন, আগের প্রার্থী সুগত বসু প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এবার সেই ব্যবধান তিন লাখে গিয়ে ঠেকবে।
তবে মিমি যাই বলুন, যাদবপুর কেন্দ্রে এবার লড়াই হবে হাড্ডাহাডি। দাবি করলেন সোনারপুর অঞ্চলের একজন লাইব্রেরিয়ান অমিয় সাহা। বললেন, এখানে বিজেপির প্রার্থী অনুপম হাজারা এবং পিএম প্রার্থী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য দুজনই খুব শক্তিশালী প্রার্থী। তাই জয় নিয়ে আশাবাদ হওয়ার কোনও কারণ নেই মিমির।
এই কথা শুনে বারাইপুর পুরনো বাজার বিজেপির পার্টি অফিসে যান দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি। কথা হয় বিজেপির তরুণ প্রার্থী অনুপম হাজরার সঙ্গে। ২০১৪ সালে বোলপুর আসন থেকে তৃণমূলের হয়ে তিন লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপনাও করেন অনুপম হাজরা। বললেন, দেখুন বিজেপির প্রতি মানুষের যে সমর্থনের ঢেউ তা দেখে অনুমান করা যায় যে বিজেপি যাদবপুরে জয় পাবে। তৃণমূল যেভাবে সন্ত্রাস, দখল সিন্ডিকেট রাজত্ব করেছে তাতে মানুষ দলটির প্রতি বীতশ্রদ্ধ।
মিমির রোজা রাখার নিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিমিকে বলুন এটা অভিনয় জগত নয়। রাজনীতি। এখানে এইভাবে ডায়লগ আওড়ে ভোট পাওয়া যাবে না। মানুষের কাছে যেতে হবে সততা নিয়ে।
অনুপম হাজারা বলেন, যাদবপুর অঞ্চলের বহু মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছেন। বিজেপিকে এবার তারাও সমর্থন করবেন বলে বিশ্বাস রাখছি।
বিজেপির প্রার্থীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে খানিকটা রসিকতা করেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, তৃণমূল আর বিজেপি তো সিট ভাগাভাগি করেছে। তাই ওরা বলতেই পারে কে কোনটা পাবে। তবে এটা আমরা বলতে পারি বিজেপি এবং তৃণমূল যেভাবে বিভাজনের রাজনীতি করেছে। ধর্ম, জাত-পাত নিয়ে তাতে এখনই সময় ওদের রুখে দেবার। তাই গণতন্ত্র প্রিয় শান্তিপ্রিয় মানুষদের বলবো তৃণমূল এবং বিজেপিকে ভোট দেবেন না।
সুজন চক্রবর্তী এর আগে দুই বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন এই কেন্দ্র থেকে। তাই তিনি এই কেন্দ্রের মানুষের অনুভূতির খবর রাখেন বলেও জানান।
এবার এই কেন্দ্র থেকে লড়ছেন বামফ্রন্টের বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি এক সময় কলকাতার মেয়র ছিলেন। এখন তিনি কলকাতা হাইকোর্টের একজন বর্ষীয়ান আইনজীবীও।
আগামী ১৯ মে এই কেন্দ্রে ভোট হবে। প্রায় সাত লক্ষ ভোটার রয়েছে কেন্দ্রটিতে। যার প্রায় অর্ধেক ভোটার নারী।
সেই নারী ভোটারদের অনেকেই বলছেন, আমরা গত পাঁচ বছর যা দেখেছি সেই মূল্যায়নে যেমন ভোট দেবো আবার নতুন কিছু রাজনীতিক সমীকরণও তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে, সেসবই মাথায় থাকবে। তবে ভোট কাকে কে দেবেন সেটা কোনও নারী বা পুরুষ ভোটাররাই আগে বলবেন না বলে জানান।
Comments