শিশুরা ন্যায্যতা চায়, বড়রা দেয় অসত্য প্রতিশ্রুতি
রাস্তায় শিশু কিশোররা যা করে, তা তাদের করার কথা নয়। বড়দের যা করার কথা তা তারা করে না বলে, শিশুরা নিজেরাই দায়িত্ব তুলে নেয়। অনেকটা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো। একই কাজ তারা কয়েক মাস আগেও করেছিল। তখন বড়রা কিঞ্চিত লজ্জা পেয়েছিলেন। লজ্জার প্রকাশ ঘটেছিল দুই ভাবে। প্রথমে বলা হলো, তোমাদের ‘সব দাবি মেনে নিলাম’- ঘরে ফিরে যাও। শিশু মনেও তাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, এটা একটা ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বা ‘রাজনৈতিক কৌশল’। রাস্তা থেকে উঠে গেলেই প্রতিশ্রুতির কথা রাজনীতিবিদরা ভুলে যাবেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে, হেলমেট বাহিনী নামিয়ে শিশু-কিশোরদের নির্মমভাবে পেটানো হয়। সেই ছবি তুলতে গেলে, পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। কারা এই হেলমেট বাহিনী, গণমাধ্যম তাদের অনেকের পরিচয় প্রকাশ করেছিল। ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগ এনে প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তারসহ আরও বহু কিছু করা হয়েছিল। হেলমেট বাহিনী বিষয়ে কিছু করা হয়নি।
এবার আবার শিশু-কিশোরদের বলা হয়েছে, তোমরা রাস্তা থেকে ঘরে ফিরে যাও। তোমাদের দাবি মানা হবে, কমিটি করেছি, ‘সুপ্রভাত’ বাসের রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে, নিহত আবরারের নামে ফুটওভার ব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
গতবারের সব দাবি মেনে নেওয়া এবং এবারের প্রতিশ্রুতিকে কেন্দ্র করে কিছু কথা।
১. ক্ষমতাসীনরা বলেছিলেন, শিশু-কিশোররা আমাদের ‘চোখ খুলে’ দিয়েছে। সড়কে নৈরাজ্য সহ্য করা হবে না। বলা হলো, পনেরো বিশ বা তারও বেশি বছর বয়সী ভাঙাচোরা বাস রাস্তায় চলবে না। কয়েকদিন চলল না। তারপর এবড়ো-থেবড়ো বাসগুলো রঙ করে আবার রাস্তায় নামানো হলো। বলা হয়েছিল, ট্রিপ ভিত্তিক ভাড়ায় নয়, বেতন ভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ড্রাইভার-হেলপাররা গাড়ি চালাবেন। কিছুই করা হয়নি। ট্রিপ ভিত্তিক ভাড়ায়ই গাড়ি চলছে। বলা হয়েছিল, বৈধ লাইসেন্সধারী চালকরাই বাস চালাবেন। বৈধ লাইসেন্স নেই এমন কেউ বা হেলপাররা বাস চালাতে পারবেন না। আবরারকে যে ড্রাইভার চাপা দিয়ে হত্যা করল, তার কাছে পাওয়া গেল মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স।
বলা হয়েছিল, ঢাকায় লেগুনা নামক পরিবহনটি চলবে না। বলে রাখা দরকার, লেগুনা পরিবহনটি শতভাগ অবৈধ। রুট-পারমিট, চালকের লাইসেন্স কোনো কিছুই নেই। দু’দিন বন্ধ থাকার পর আবার লেগুনা চলতে শুরু করে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়, লেগুনা থেকে চাঁদা আদায়ের পরিমাণ আরও বেড়েছে। প্রতিদিন একটি লেগুনা থেকে আগে চাঁদা নেয়া হতো ৭০০ টাকা। এখন নাকি তা ৯০০ টাকায় ঠেকেছে। ঢাকায় ১০ হাজারের উপরে লেগুনা চলে।
রাস্তায় সামগ্রিক নৈরাজ্য একটুও কমেছে, একথা কেউ-ই বলতে পারছেন না। অগ্রগতি হয়েছে একটি, মোটরসাইকেল চালক ও পেছনের যাত্রী এখন হেলমেট ব্যবহার করেন। মোটরসাইকেলের বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল আগের মতোই আছে।
২. ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে, ছোটরা বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করবে। বড়রা ছোটদের প্রতি সংবেদনশীল হবেন। ছোটদের কাছে অসত্য কোনো কথা বলবেন না। যা বলবেন, তা করবেন। যা করতে পারবেন না, তা ছোটদের কাছে বলবেন না।
আমাদের শিশু-কিশোররা দেখলেন, বড়রা নীতি নির্ধারকরা তাদের কাছে অসত্য কথা বলেছেন। তাদেরকে হেলমেট বাহিনী নামিয়ে পেটানো হয়েছে।
এখন যখন বড়রা আবার বলছেন, তোমাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে, তা কি তাদের বিশ্বাস করার কথা?
‘আমি তোমাদের জনপ্রতিনিধি’ ‘কয়েক মাসের মধ্যে নিহত আবরারের নামে ফুটওভার ব্রিজ বানিয়ে দেব’- এ কেমন প্রতিশ্রুতি, কেমন সান্ত্বনা? শিশু-কিশোরদের যে আবেগ-ক্ষোভ, তার সামনে গিয়ে বলছেন ‘আমি জনপ্রতিনিধি’! ‘ফুটওভার ব্রিজ’ এসব ছেলে-ভোলানো কথা বলে শিশু-কিশোরদের বুঝ দেওয়া যাবে? এমনটাই ভেবেছেন? এরা শিশু-কিশোর হলেও, বড়দের যে তারা চিনে ফেলেছেন, তা বুঝতে পারছেন না। কংক্রিটের এই জঙ্গল শিশুদের শিশু হিসেবে বেড়ে উঠতে দিচ্ছে না। সহপাঠীর রক্তাক্ত দেহ দেখতে দেখতে, ক্ষুব্ধ- বিক্ষুব্ধ হয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছেন। শিশুদের জীবন-শৈশব কেড়ে নিচ্ছে দূষণ- অনিয়মের স্বর্গ নগর ঢাকা।
৩. বাংলাদেশের রাস্তায় যে নৈরাজ্য তা একদিনে তৈরি হয়নি। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে, বহু দিনেও তা দূর করা কঠিন। এক একটি সংকট তৈরি হচ্ছে, আর আপনারা বলছেন ‘এখন থেকে আর কিছু ঘটবে না’। তা যে সম্ভব না, আপনারাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
সড়ক ও পরিবহন খাতে গত আট বছরে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি প্রকল্পের সঙ্গে আরেকটি প্রকল্পের সমন্বয় নেই। একটি পরিকল্পনার সঙ্গে আরেকটি পরিকল্পনা সাংঘর্ষিক। যেমন, মেয়র মোহম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের কারণে মেট্রোরেল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গিয়ে আটকে যাবে। মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ-রামপুরা- তেজগাঁও মেট্রোরেলের আওতায় আনার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে নির্মাণ হয়ে যাওয়া ফ্লাইওভার। ফ্রাইওভারে যে যানজট সমস্যার সমাধান মিলছে না, তা দৃশ্যমান।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে ৩০টি সংস্থা জড়িত। এক সংস্থা কী প্রকল্প নিচ্ছে, কোন ‘উন্নয়ন’র সুফল কারা পাবেন, কতটা পাবেন, আদৌ কিছু পাবেন কিনা, গবেষণা-যাচাই হয় তা বোঝা যায় না। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল দৃশ্যমান হচ্ছে, এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। কোনটা কবে শেষ হওয়ার কথা, তা যেন সবাই ভুলে গেছেন। কাজ শুরু হয়েছে, চলবে যেন অনন্তকাল। বাজেট বাড়ছে তিন চার পাঁচ ছয় গুণ।
দশ, পনেরো বা বিশ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে সংকেত বাতির আধুনিকায়ন করা হয়। বাস্তবে ট্রাফিক ব্যবস্থা চলে বাঁশ, রশি আর ইশারা ভাষায়। সংকেত বাতির পেছনে ১২ কোটি টাকার আরও একটি প্রকল্প এখন চলমান!
দেড় দুই কোটি মানুষের নগরে গড়ে ওঠেনি গণপরিবহন ব্যবস্থা। সরকারি উদ্যোগে বাস কেনা হয়। পনেরো বছর যেসব বাস চলার কথা, দুই থেকে তিন বছরে তা অকেজো হয়ে যায়। মেরামত করা হয় না। আবার নতুন বাস কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মেরামতে অল্প ব্যয়, কম লাভ। নতুন কেনায় বেশি অর্থ, অনেক লাভ। কিছুদিন পর পর গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সরকারি বিআরটিসি দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। বেসরকারি মাফিয়া চক্রের হাতে পরিবহন খাত। যদিও বেসরকারি পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক নেতারা প্রায় সবাই সরকারের অংশ।
৪. যে নৈরাজ্য রাস্তায় দৃশ্যমান, তা আসলে মগজের নৈরাজ্য। মগজে যদি ক্ষত তৈরি হয়, আশাবাদের সুযোগ কমে যায়। ছাত্রদের ভোট কারচুপি করে ছাত্রদের হাতে ধরা পড়েন শিক্ষক। এমন সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি। ভোট কারচুপির কথা যারা বললেন, দল বেঁধে তাদেরই বিচার চাওয়া হলো।
সাবেক মন্ত্রী ও পরিবহন খাতের প্রধান ব্যক্তি শাজাহান খান আবারও বললেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে শুধু ড্রাইভাররা দায়ী নয়।’ কথাটার সঙ্গে একমত পোষণ না করার সুযোগ নেই। সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে প্রধানত দায়ী, মালিক এবং শ্রমিক নেতারা (মালিকও)। লাইসেন্স ছাড়া ‘সুপ্রভাত’ বাসটি যিনি চালাচ্ছিলেন, সেই চালকের লাইসেন্স নেই, ২৭ টি মামলা ছিল বাসটির বিরুদ্ধে।
মেয়র, পুলিশ কমিশনার এই তথ্য জানাচ্ছেন। কী করে এমন বাস রাস্তায় চলছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিচ্ছেন না। ২৭ টি মামলা যে বাসের বিরুদ্ধে, সেই বাস রাস্তায় নামানোর দায় কি ড্রাইভারের না মালিকের? লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারকে মালিক বাস চালাতে দিলেন কেন? দায় ড্রাইভারের চেয়ে বেশি কি মালিকের নয়?
একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পর একশ্রেণির লেখাপড়া জানা মানুষও বলতে শুরু করেন ‘জনগণেরও দোষ আছে। তারা সতর্ক নন, দেখে রাস্তা পার হন না।’
এমন তর্কের অবতারণা করে রাস্তার নৈরাজ্য, দুর্ঘটনা, হত্যা... সবকিছুর একটা যৌক্তিক ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পৃথিবীর অমুক দেশের মানুষ আইন মেনে চলেন, আমাদেরও তেমন চলতে হবে। কিছু মানুষ আছেন যারা হয়ত জানেন না, অমুক দেশ কেমন করে এমন হয়েছে। আর কিছু মানুষ আছেন, জেনে বুঝে অন্ধ রাজনৈতিক আনুগত্যের থেকে বলতে শুরু করেন, মানুষের দোষেই দুর্ঘটনা ঘটে। শুধু ড্রাইভারদের দায়ী করে লাভ নেই।
দায়ী করে লাভ নেই, তা তো বুঝলাম। আরও একটা বিষয় বোঝা দরকার, আইন মেনে চলা দেশগুলোর মানুষ কবে থেকে, কীভাবে আইন মানা শিখলেন। উদাহরণ হিসেবে জাপানের কথা বলা যায়। জাপানের প্রতিটি মানুষ আইন মেনে চলেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটা, ট্রেনে ওঠা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইন মেনে চলেন। জাপানের এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। জাপান, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, কাছের সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর সব দেশে মানুষকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রথমে আইনের শাসন বিষয়টি দৃশ্যমান করতে হয়েছে। নীতি-নির্ধারকদের তা মানতে হয়েছে। জনগণকে মানতে বলা হয়েছে। না মানলে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। শাস্তির ভয়ে মানুষ আইন মানতে শুরু করেছে। একসময় তা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আইন তার সামনে সব সময় দৃশ্যমান আছে। জানা আছে আইন অমান্য করলেই শাস্তি নিশ্চিত।
পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষ নিজে থেকে আইন মানতে চায়নি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা আইন অমান্য করা।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে, সবাই আইন মেনে চলেন।
৫. ফিরে আসি ‘সুপ্রভাত’ প্রসঙ্গে।
‘লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভার, ২৭টি মামলা নিয়ে বাসটি কীভাবে রাস্তায় চলছিল’-প্রশ্ন যিনি করছেন, সেই পুলিশ কমিশনারেরই উত্তর দেওয়ার কথা। ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে এক ধরণের উত্তর তিনি দিয়েছেন। সঙ্গে ‘সুপ্রভাত’ বাস সম্পর্কে আরও কয়েকটি তথ্য জানাই। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
‘সুপ্রভাত’ নামে প্রায় ৩৫০টি বাস চলে। বিআরটিএ রাস্তায় চলার অনুমতি দিয়েছে ৭৫টি বাস। প্রায় ২৭৫টি বাস চলে বেআইনিভাবে। জানা যায় ‘সুপ্রভাত’ সমিতি জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠান। ৩৫০টি বাসের মালিক প্রায় ৪০০ জন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি বাসের মালিক দুই থেকে চার জন। প্রায় সব বাস কেনা হয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। প্রতিটি বস থেকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই টাকা কে তোলেন, টাকার ভাগ কারা কারা পান, এসব তথ্য অজানা কিছু নয়।
‘এই রুটে বাসের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে’-এজাতীয় যুক্তি দেখিয়ে বিআরটিএ ২৭৫টি বাস চলার অনুমতি দেয়নি। অথচ বাসগুলো চলছে।
জানি না, পুলিশ কমিশনার বা বিআরটিএ এক্ষেত্রে কী বলবেন!
যাত্রী পাওয়া না গেলে বা বাসের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে, মালিকরা এই রুটে এতগুলো বাস চালাতে পারতেন না। চাঁদা দিতেন না, আয় থেকে ব্যাংক ঋণ শোধ করতে পারতেন না।
পরিবহন খাতের অনিয়ম-নৈরাজ্য-দুর্নীতি-মাস্তানি-চাঁদাবাজির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি যে কতটা শক্তিশালী, তার অতি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত ‘সুপ্রভাত’ বা ‘জাবালে নূর’।
সুপ্রভাতের রোড পারমিট বাতিল করে দেওয়া হলো, জাবালে নূর সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছিল। রুট পারমিট বাতিল করে দেওয়া কেমন শাস্তি? দেখা দরকার, বাসগুলো চলার উপযুক্ত কিনা। উপযুক্ত হলে, আইন মেনে চলতে বাধ্য করা দরকার। তা না করে, লোক দেখানো ‘রুট পারমিট’ বাতিলের ঘোষণা কেন?
‘জাবালে নূর’ রাস্তায় চলছে। গাড়ির মান তখনো যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভাররা পুলিশের সামনে দিয়ে কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে বাস চালাচ্ছেন। ‘সুপ্রভাত’ নাম পরিবর্তন করে ‘সম্রাট’ নামে রাস্তায় চলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চক্রাকার এই অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ বা হ্রাস করার কাছাকাছি কোনো উদ্যোগও কেউ নিচ্ছেন না।
৬. প্রধানমন্ত্রী বললে কাজটি হয়, তিনি না বললে বা না দেখলে হয় না, সাধারণভাবে একথা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরিবহন খাতে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন বা নির্দেশনা দেন, তাও হয় না। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন-
ক. চালক ও হেলপারদের (সহকারী) প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
খ. দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখতে হবে। এক্ষেত্রে পাঁচ ঘণ্টা পর পর চালক পরিবর্তন করতে হবে।
গ. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ঘ. চালকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার রাখতে হবে।
ঙ. এবং অবশ্যই সিগন্যাল মেনে চলতে হবে।
নির্মোহভাবে বলেন তো, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?
এখন আবার ১১১ দফা প্রস্তাবনা সামনে আনা হয়েছে। পরিবহন খাতের সবচেয়ে আলোচিত শাহজাহান খানের নেতৃত্বাধীন কমিটি এনেছে ১১১ দফা। সেখানে শুধু ‘করতে হবে’ ‘করতে হবে’...। গল্পের সেই ‘ঢাল আনো তলোয়ার আনো...’- কিন্তু আনবেটা কে?
৭. পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ১১১ দফার যে দফাগুলো ব্যাপক উদ্যোগ ও উদ্যমে শুরু হতে পারে বলে ধারণা করি-
‘ফুটপাত দখলমুক্ত করে রেলিং তৈরি, ফুটপাতহীন স্থানে ফুটপাত নির্মাণ ও রাস্তা থেকে ফুটপাত ৮ ইঞ্চি উঁচু রাখতে হবে।’
ফুটপাতে রেলিং বানানো, ফুটপাত নির্মাণ এবং আট ইঞ্চির চেয়ে উঁচু বা নিচু ফুটপাত নতুন করে ভাঙ্গাগড়া শুরু হতে পারে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যে ফুটপাত তৈরি করে গেছেন, সেই নতুন ফুটপাত সম্ভবত আবার নতুন করা শুরু হবে!
‘দেশের সব সড়কে প্রয়োজনীয় সাইন, মার্কিং ও স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনও প্রকার গতিরোধক স্থাপন করা যাবে না।’
সাইন, মার্কিং, লাইট ‘লাভজনক’ নতুন প্রকল্প আলোর গতিতে শুরু হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। শুরু হতে পারে গতিরোধক ভাঙ্গাগড়ার কাজটিও। সারা দেশের রাস্তায় অগণিত গতিরোধক আছে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্যে যা খুবই লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা।
‘রাস্তার সংযোগস্থলগুলোর ১৫০ ফুট পর্যন্ত কোনও ধরনের গাছপালা থাকতে পারবে না।’
আশা করা যায়, এই কাজটি সর্বপ্রথমে সম্পন্ন হবে। সারা দেশে রাস্তার পাশে এখনো যে সব বড় বড় গাছ আছে, আগে উদ্যোগ নিয়েও প্রতিবাদের কারণে যা কাটা যায়নি, এবার সেগুলো কাটা যাবে। সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে এসব গাছের কতটা সম্পর্ক, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, গাছ কাটা আমাদের জাতীয় শখের পর্যায়ে পড়ে।
৮. বড়দের কোনো বিষয়ের প্রতিবাদ দৃশ্যমান নয়। সরকার তাদেরকে বিবেচনায় নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না। শিশু-কিশোররা মারা যাবে, ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় আসবে। ‘সব দাবি মেনে নিলাম’ ‘ফুটওভার ব্রিজ করে দিলাম’ বলা হবে ‘হাতি-ঘোড়া’ সব দেব। তারা তো শিশু, রাজনীতির সত্য-অসত্য প্রতিশ্রুতির তারা কী বোঝে! গত বছর যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এবারও একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, আগামীতেও...।
Comments