ধর্ষণের সঙ্গে রাজনীতি, প্রশ্নবিদ্ধ মানবাধিকার কমিশন

অন্য আর দশটি ধর্ষণের ঘটনা থেকে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ধর্ষণের ঘটনার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। সংবাদটি সেভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ডেইলি স্টারের অনলাইনে। পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যমেও প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। পাঠকের মনে বিষয়টি এতোটাই নাড়া দেয় যে, ডেইলি স্টার অনলাইন থেকে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে লেখাটি শেয়ারই হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি। পড়েছেন কতো লক্ষ বা কোটি!
rape logo
প্রতীকীচিত্র: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

অন্য আর দশটি ধর্ষণের ঘটনা থেকে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ধর্ষণের ঘটনার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। সংবাদটি সেভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ডেইলি স্টারের অনলাইনে। পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যমেও প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। পাঠকের মনে বিষয়টি এতোটাই নাড়া দেয় যে, ডেইলি স্টার অনলাইন থেকে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে লেখাটি শেয়ারই হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি। পড়েছেন কতো লক্ষ বা কোটি!

আশা জাগানো সংবাদ ছিলো, প্রথমাবস্থায় টালবাহানা করলেও আসামিদের একে একে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তের উদ্যোগ নেওয়াও ছিলো একটি ইতিবাচক ঘটনা। আজকের লেখায় সেই ‘ইতিবাচক তদন্ত’র বিষয় নিয়েই দু-একটি কথা।

১. জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিলো জানুয়ারির ১ তারিখে। সেখানে তাদের নজরে আনা হয় ‘ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ৪ সন্তানের মাকে আওয়ামী লীগ কর্মীদের গণধর্ষণ’ দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সংবাদটি। তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা পরের দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিম ৪ সন্তানের জননী পারুল বেগম ও তার নিরক্ষর অটোরিকশা চালক স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল আজিম, পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ এবং জেলা প্রশাসক তন্ময় দাশের সঙ্গে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তার ভিত্তিতে গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে ‘সুবর্ণচরে ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক নেই: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’।

শুরু থেকে ঘটনাটি যেভাবে জানা গিয়েছিলো, ভিকটিম পারুল বেগম ঘটনার বর্ণনা গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সামনে যেভাবে দিয়েছিলেন, গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে যা বেরিয়েছিল, যে শিরোনামে দ্য ডেইলি স্টার সংবাদটি প্রকাশ করেছিলো, তার সঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টের বড় রকমের পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলো।

পারুল বেগম অসুস্থ, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আতঙ্ক কাটেনি। তারপরও কয়েক দফা সরাসরি যোগাযোগ করে কথা বলা হলো, পারুল বেগম ও তার স্বামী দু’জনের সঙ্গেই। পূর্বে যা বলেছিলেন, প্রতিবারই তারা একই কথা বলেন- ‘চর জুবিলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীনের লোকজন আমাকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেছিলো, কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছি’।

তারপর হুমকি এবং ধর্ষণ বিষয়ে পূর্বে যা বলেছিলেন, তা আবারও শুনতে চাইলাম না।

তবে এও বললেন, গতকাল (১৬ জানুয়ারি) পর্যন্ত যতোজন তাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন, সবাইকে তারা এই একই কথা বলেছেন। যা সত্য সেটাই বলেছেন।

২. এবার আসুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ছয় পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৪ সন্তানের জননী পারুল বেগম যা বলেছেন, আর মানবাধিকার কমিশন যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সে বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। তদন্ত প্রতিবেদনের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা’ অংশে লেখা হয়েছে, ‘ভিকটিম পারুল বেগম তার জবানবন্দিতে বলেন যে, রবিবার রাত ১২.০০টার সময় ঘটনা, তিনি ১৪ নম্বর ভোট কেন্দ্রে যান, তাকে নৌকায় ভোট দিতে বলে, তিনি বলেন তার ভোট তিনি দিবেন, তখন বলে যে যান বিকাল বেলা খবর আছে, সোহেল বলে রাইতে দেখা করবে, সন্ধ্যার পর তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েন, রাত ১২.৩০ মিনিটের দিকে দরজায় ঠাস ঠাস শব্দ করে, কে জানতে চাইলে বলে যে থানা থেকে লোক এসেছে, তিনি নিজে তখন দরজা খুলে দেন, তারা ১০ জন তার ঘরের ভেতরে ঢুকে, তখন ঘরে বাতি জ্বলছিল...।’

তারপরের ঘটনার বা ধর্ষণের মোটামুটি একটা বিস্তারিত বর্ণনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

পারুল বেগমের স্বামী, ডাক্তার, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের বক্তব্যও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনের পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠায় এসে মানবাধিকার কমিশন লিখেছে যে, ‘পারুল বেগম তদন্ত কমিটির সামনে প্রদত্ত জবানবন্দির কোথাও বলেননি যে, ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন বা তিনি ধানের শীষ প্রতীকের নেতা, কর্মী, সমর্থক বা আসামিরা ধানের শীষের বিপরীত দলের নেতা, কর্মী, সমর্থক বা পোলিং এজেন্ট।’

ছয় নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মতামত’ অংশে মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘এজাহারে উল্লেখিত আসামি (১) মো. সোহেল (২) হানিফ (৩) স্বপন (৪) চৌধুরী (৫) বেচু (৬) বাসু প্র: কুলাউড়া বাসু (৭) আবুল (৮) মোশারফ (৯) ছালাউদ্দিন ভিকটিম পারুল বেগমকে প্রচণ্ড মারপিট করে তার হাড়ভাঙা জখমসহ নীলা, ফুলা, ছিলা ও ফাটা জখম তথা ভোঁতা অস্ত্র দ্বারা গুরুতর আঘাত করার পর তাকে ধর্ষণ করার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে ভিকটিম পারুল বেগমের মারপিট ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার কোনো সম্পর্ক তদন্ত কমিটির সামনে উন্মোচিত হয়নি। বরং ভিকটিমের স্বামীর দায়েরকৃত এজাহারের ভাষ্যমতেই এটি আসামিদের সঙ্গে পারুল বেগমের পরিবারের পূর্ব শত্রুতার জের।’

৩. ভিকটিম পারুল বেগমের জবানবন্দি ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ‘মতামত’ বিষয়ে আরও একটু পর্যালোচনা করা যাক।

ক. পারুল বেগম বলেছেন, ‘ভোট দিতে’ গেছেন। ধর্ষণকারীরা তাকে ‘নৌকায় ভোট’ দিতে বলেছে। তিনি বলেছেন, ‘তার ভোট তিনি দিবেন’। তার প্রেক্ষিতে ‘রাতে দেখে’ নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং রাতে তারা ‘দেখে’ নিয়েছে।

তাহলে কীসের ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশন প্রতিবেদনে লিখল যে, ‘ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই’। আসামিরা তো তাকে ‘নৌকায়’ ভোট দিতে বলেছে। এই তথ্য তো মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেরই।

মানবাধিকার কমিশন প্রতিবেদনে লিখেছে, পারুল বেগম বলেননি যে, ‘আসামিরা ধানের শীষের বিপরীত দলের নেতা...’।

‘বিপরীত দল’ নামে তো কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তবে কেন মানবাধিকার কমিশন ‘বিপরীত দল’ লিখল?

ধর্ষণকারীরা পারুল বেগমকে ‘নৌকায় ভোট’ দিতে বলেছে, তিনি দিতে রাজি হননি, নিজের পছন্দে ভোট দিতে চেয়েছেন- দিয়েছেন, এটা নিয়েই তো ‘দেখে নেওয়ার হুমকি’। কারা পারুল বেগমকে ‘নৌকায় ভোট’ দিতে বললেন? গণমাধ্যমে তাদের পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। তদন্তকারীদের তা অজানা নয়, নিজেদেরও তদন্ত করে দেখার সুযোগ ছিলো। তদন্তকারীরা তা জানার চেষ্টা করেছেন, প্রতিবেদন তা বলে না। কেনো করলেন না?

মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘হুমকিদাতা ধর্ষণকারী’-দের পরিচয় উল্লেখ থাকলো না কেনো? বিষয়টি কেনো তদন্তকারী তিন সদস্যের কাছে গুরুত্ব পেলো না বা তারা কেনো এড়িয়ে গেলেন? কেনো তাদের কাছে ‘ভোটের সঙ্গে সম্পর্ক নেই’ এবং ‘পূর্ব শত্রুতার জের’ যা ভিকটিম বলেননি, বিষয়টি এতো গুরুত্ব পেলো?

খ. পারুল বেগমের স্বামী, ডাক্তার, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক, যাদের সঙ্গে কথা বলে মানবাধিকার কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাদের কেউ বলেননি যে ‘ভোটের সঙ্গে এই ধর্ষণের ঘটনার সম্পর্ক আছে বা নেই’। প্রথমাবস্থায় বলার কথাও নয়। বলেছেন পারুল বেগম নিজে। তারই বলার কথা। কারণ ঘটনার উৎপত্তিস্থল ‘ভোট দিতে’ যাওয়ার সেই ঘটনার সময় এরা কেউ উপস্থিত ছিলেন না। যিনি ধর্ষিত হলেন, সেই পারুল বেগম যা বললেন, তা গুরুত্ব পেলো না বা বিশ্বাসযোগ্য হলো না মানবাধিকার কমিশনের কাছে? পারুল বেগম যা বললেন, তা প্রতিবেদনে লিখলেন কিন্তু ‘মতামতে’ এসে ‘অস্বীকার’ করল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন!

গ. আগেই উল্লেখ করেছি, পারুল বেগমের স্বামী নিরক্ষর। পুলিশ মামলার এজাহার লিখে তার স্বাক্ষর নিয়েছে। সেখানে কী লেখা হয়েছে তিনি তা বোঝেননি। সেই এজাহারে মূল অভিযুক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীনের নামও লেখা হয়নি। পুলিশ ইচ্ছে করে রুহুল আমীনের নাম বাদ দিয়েছে। পারুল বেগমের স্বামীর ‘নিরক্ষরতা’র সুযোগ নিয়েছে পুলিশ। পারুল বেগমের ভোট দিতে যাওয়া, নৌকায় ভোট দিতে বলা, না দিলে হুমকির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে পুলিশ। এজাহারে উল্লেখ করেছে ‘পূর্ব শত্রুতার জের’। মানবাধিকার কমিশন পুলিশের সেই এজাহারেই ‘বিশ্বাস’ করেছে, নির্যাতিত-গণধর্ষণের শিকার পারুল বেগমের বক্তব্য ‘বিশ্বাস’ করেনি!

ঘ. এজাহারে পুলিশ মূল অভিযুক্ত রুহুল আমীনের নাম না লিখলেও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপে তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তিতে তার নাম আসে। আওয়ামী লীগ দল থেকে রুহুল আমীনকে বহিষ্কার করে। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনের কোথাও মূল অভিযুক্ত, পারুল বেগমের বক্তব্য অনুযায়ী যার নির্দেশে যার লোকজন ধর্ষণ করে, সেই রুহুল আমীন বিষয়ে কোনো কিছু লেখা হয়নি। পুলিশ যে কৌশলে তার নাম এজাহারে উল্লেখ করেনি, তাও বলা হয়নি প্রতিবেদনে। যা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।

অথচ পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ এজাহারকে ভিত্তি ধরে, পারুল বেগমের বক্তব্যের উল্টো ‘মতামত’ দেওয়া হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

৪. নির্বাচন বা ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এটা প্রমাণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উদ্দেশ্যও এটা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে, প্রমাণ করতে হবে ‘ভোটের সঙ্গে’ ধর্ষণের সম্পর্ক নেই। গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করা, প্রত্যাশা মানবাধিকার রক্ষা, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার। মানবাধিকার কমিশন আধা বিচারিক কেয়াসি জুডিয়াল সংস্থা। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তার বিচার পাওয়ার অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাই তার দায়িত্ব-কর্তব্য। পারুল বেগমের জীবনে ধর্ষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের সর্বোচ্চটাই ঘটেছে। সেই ঘটনার তদন্তের উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করলেও, ভিকটিমের বক্তব্য আমলে না নিয়ে পারুল বেগমের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তিন সদস্যের তদন্তকারীদের প্রাপ্ত ‘জবানবন্দী-তথ্য’ আর তাদের ‘মতামত’ দৃশ্যমানভাবে সাংঘর্ষিক। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যে যা চরম অসম্মানজনক।

আরও পড়ুন:

নোয়াখালীতে ‘গণধর্ষণ’: ‘নির্দেশদাতাকে’ বাদ দিয়ে ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নোয়াখালীতে ‘গণধর্ষণ’: আ. লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ আরও ২ আটক

সুবর্ণচরে গণধর্ষণ: রিমান্ডে ৭ জন

Comments

The Daily Star  | English
classes resume in Dhaka University

Classes resume in DU after over 3 months

Classes and exams began around 10:00am, with students from dormitories and off-campus locations returning to participate

1h ago