ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ১ বছর

প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার গল্প

১ বছরের আগ্রাসনে ইউক্রেন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
১ বছরের আগ্রাসনে ইউক্রেন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

ঠিক ১ বছর আগে যখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে যুদ্ধ শুরু হল, তখন মেহেদি হাসান মোহন উপলব্ধি করলেন যে তার জীবন আর কখনো আগের মতো থাকবে না।

তিনি টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিয়েভে আমার নিজের বাড়ি ও গাড়ির ব্যবসা ছিল। এখন আমি শরণার্থী হিসেবে নেদারল্যান্ডসে বসবাস করছি'।

উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে ৩২ বছর আগে কিয়েভে যান মোহন। 'আমি তখন থেকে সেখানেই বসবাস করছি এবং আমি এক ইউক্রেনীয় নারীকে বিয়ে করি', যোগ করেন তিনি।

মোহন আরও বলেন, 'আমাকে থিতু হওয়ার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। নিজের ব্যবসা শুরুর আগে আমাকে বেশ কয়েক ধরনের কাজ করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি বেশ সুখী জীবন যাপন করছিলাম। তারপর যুদ্ধ এলো এবং আমার সব সুখ চলে গেলো'।

মোহন একজন প্রকৌশলী। তিনি এখন নেদারল্যান্ডসে রোবট অপারেটরের কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'আমাকে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। আমরা সঙ্গে করে কিছুই আনতে পারিনি। এমন কী, কোনো অর্থও আনিনি। এ কারণে বিদেশী রাষ্ট্রে নতুন জীবন শুরু করতে হচ্ছে।'

নিজেদের জীবন বাঁচাতে তিনি এবং তার বাংলাদেশি বন্ধু আবদুল আউয়াল একসঙ্গে ইউক্রেন ত্যাগ করেন। সব কিছু পেছনে ফেলে তারা প্রথমে পোল্যান্ডে যান। সেখানে কয়েক মাস থাকার পর ২ জন ২ ভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন।

মোহন বলেন, 'আমি নেদারল্যান্ডসে আর আউয়াল যুক্তরাজ্যে'। কতদিন নেদারল্যান্ডসে থাকবেন সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত নন বলে জানান।

যুদ্ধের আগে ইউক্রেনে ১ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি বসবাস করতেন। এখন মাত্র ২০ জন আছেন সেখানে।

ডেইলি স্টার ইউক্রেনে অবস্থানরত আহমেদ ফারুক মিঠুর সঙ্গে কথা বলে। গতকাল পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কিয়েভে ছিলেন।

ইউক্রেনে বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী মিঠু বলেন, 'আমি কোথায় যাব? এখানে ৩৪ বছর ধরে বসবাস করছি। আমার জীবনের সকল অর্জনের পেছনে এই দেশের অবদান রয়েছে। আমি এখানেই থাকবো আর এখানে মারা গেলেও আমার কোনো অনুশোচনা থাকবে না।'

তিনি বলেন, বৈধ কাগজপত্র থাকা বাংলাদেশিদের অধিকাংশই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছেন।

খালেদ হাসান খান হাঙ্গেরি সীমান্ত দিয়ে কিয়েভ থেকে পালিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যান। তিনি গত ১১ মাস ধরে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সেখানেই বসবাস করছেন।

খালেদ উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৮৪ সালে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে চলে আসেন। ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তার সঙ্গে ভবিষ্যৎ স্ত্রী রোখসানা আহমেদের পরিচয় হয়।

'আমরা বিয়ে করে ১৯৯৭ সালে কিয়েভে চলে যাই। সেখানে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে শুরু করি। আমরা আমাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট জমা দিয়ে ইউক্রেনের নাগরিক হয়েছি', যোগ করেন তিনি।

খালেদ আরও বলেন, 'কিন্তু যুদ্ধ আমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমার বয়স ৬০ হতে মাত্র কয়েক মাস বাকি। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, আমার বয়সের কাউকে জীবিকা উপার্জনের জন্য একটি নতুন ভাষা শিখতে হবে? আমার স্ত্রী এবং আমি, ২ জনই এখন সুইস ভাষা শিখতে বাধ্য হচ্ছি'।

খালেদ আরও যোগ করেন, 'আমরা প্রায় সব সময়ই বিষণ্ণ থাকি। আমার ব্যবসা, বন্ধু, বাড়ি সবই সেখানে (ইউক্রেনে)। হ্যাঁ, সুইজারল্যান্ড একটি সুন্দর দেশ এবং সুইস সরকার আমাদের জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আমরা এখনো এখানে শরণার্থী। একজন শরণার্থীর জীবন যাপন করা সম্পূর্ণ নতুন এবং খুব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা।'

যেহেতু ৬০ বছরের কম বয়সী পুরুষদের ইউক্রেন ছাড়তে দেওয়া হচ্ছে না, তাই পরিবারের কাছে সুইজারল্যান্ডে ফিরতে না পারার ভয়ে খালেদ তার কিয়েভের বাড়িতে যেতে পারছেন না।

'আমি যদি এখন সেখানে যাই, তাহলে আর ফিরে আসতে পারব না। আমি যদি ফিরে আসতে না পারি, তাহলে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমার বয়স যখন ৬০ হবে, তখন আমি সেখানে যাব', যোগ করেন খালেদ।

তার স্ত্রী রোখসানা এক মাস আগে কিয়েভ যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, কারণ মহিলাদের ওপর এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ নেই। তিনি সেখানে যেয়ে তাদের বাড়ি ও ব্যবসার পরিস্থিতি নিরীক্ষা করেন।

ফিরে আসার পর তার একটাই কথা ছিল, 'যুদ্ধ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ভোগান্তির অবসান ঘটাতে হবে'।

বাস্তুচ্যুতি সংকটের তীব্রতার দিক দিয়ে ইউক্রেন এখন সিরিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ৮১ লাখ শরণার্থী সীমান্ত পার হতে বাধ্য হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে ৫৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago