ক্রিমিয়ার সেতু হামলা ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে

রাশিয়া ও ক্রিমিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ কের্চ সেতুতে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। ছবি: এএফপি
রাশিয়া ও ক্রিমিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ কের্চ সেতুতে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। ছবি: এএফপি

ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে রাশিয়ার সড়ক সংযোগকারী কের্চ সেতুতে হামলার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, ইউক্রেনের কোনো অংশেই পরাশক্তি রাশিয়া অপ্রতিরোধ্য নয়। এই ঘটনার প্রতিশোধে রাশিয়া প্রায় ৭ মাস পর আবারও বড় আকারের হামলা শুরু করেছে। ফলে অনেক বিশ্লেষক মত প্রকাশ করছেন, কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুর ওপর হামলায় ঘুরে গেছে যুদ্ধের মোড়। 

সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, অভিনব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও হামলার পর প্রতিশোধের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের দীর্ঘতম এই সেতুটির (১৯ কিলোমিটার) ট্রাক বোমা হামলায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।

সরাসরি হামলার দায় স্বীকার না করলেও ইউক্রেন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিতে থাকেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের দাবি, এটি ইউক্রেনের 'সন্ত্রাসী হামলা'।

আজ মঙ্গলবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে চলমান সংঘর্ষে সেতুটির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা

রাশিয়ার গৌরব ও উন্নত প্রকৌশলবিদ্যার উজ্জ্বল নিদর্শন এই সেতুটি কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র ক্রিমিয়া নয় বরং ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে রুশ বাহিনীর জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম আনা-নেওয়ার একমাত্র পথ।

সেতুটি সার্বিকভাবে চলমান যুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ কারণেই কিয়েভের যুদ্ধ পরিকল্পনায় এই হামলা স্থান পায়।

প্রায় অসাধ্য সাধন করেছে কিয়েভ

৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার খরচে নির্মিত এই ইস্পাত ও কংক্রিটের সেতুর ক্ষতি করার মতো শক্তিশালী দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের কাছে নেই। বিমান হামলা চালাতে গেলেও রাশিয়ার বিমানবিধ্বংসী এস-৩০০ ও এস-৪০০ কামানের মুখোমুখি হতে হবে। এমনকি, ইউক্রেনের টিবি২ ড্রোনও এমন হামলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই ড্রোনগুলো হালকা অস্ত্র বহন ও প্রহরা চৌকি ধ্বংসে যথেষ্ট হলেও শক্ত কংক্রিটের সেতু ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট নয়।

বিমান হামলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি সেতুর আশেপাশে রুশ বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। সমুদ্র বা ভূমি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কায় সেতুর ২ পাশে বেশ কয়েকটি ফেরিতে রাডার প্রতিফলক যন্ত্র বসানো হয়।

সেতুর আগুন নেভাতে হেলিকপ্টার থেকে পানি ফেলা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
সেতুর আগুন নেভাতে হেলিকপ্টার থেকে পানি ফেলা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষের রাডারে সেতুর সঠিক অবস্থান ধরা পড়ে না। ফলে সমুদ্র থেকে আসা ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সমস্যায় পড়ে।

এ ছাড়াও, সেতুর আশেপাশে প্রয়োজনে ঘন ধোঁয়া তৈরি করেও রাডার ব্যবস্থা ও অত্যাধুনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রকে ধোঁকা দেওয়ার বিষয়গুলো পরীক্ষা করেছে রাশিয়া।

এতসব অভিনব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যোগ হয় রুশ বাহিনীর সবচেয়ে সুপ্রশিক্ষিত ও উচ্চ পর্যায়ের সদস্যদের টহল, যুদ্ধ বিমানের টহল, কাছাকাছি জায়গায় অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টারের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে কের্চ সেতু রাশিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থাপনাগুলোর অন্যতম।

তারপরও সেতুর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করে কিয়েভ প্রায় অসাধ্য সাধন করেছে।

হামলার প্রভাব

এত সতর্কতার পরও গত ৮ অক্টোবর বিস্ফোরণে সেতুর অংশবিশেষ ধ্বংসের পাশাপাশি রেল লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্রুত মেরামতের কাজ শুরু হলেও রুশদের ওপর এই হামলার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলার ফলে খেরসন শহরে রুশ বাহিনীর জন্য ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ সামলানো খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। এ মুহূর্তে তাদের কাছে নতুন করে গোলাবারুদ, অস্ত্র ও সরঞ্জাম পাঠানোর কোনো উপায় নেই।

এটি ইউক্রেনীয়দের মনোবল চাঙ্গা করার বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেতু ধ্বংসের সংবাদ জানিয়ে উল্লাস করেছেন।

সেতু হামলার পর প্রতিশোধ নিতে কিয়েভে হামলা চালায় রাশিয়া। ছবি: এপি
সেতু হামলার পর প্রতিশোধ নিতে কিয়েভে হামলা চালায় রাশিয়া। ছবি: এপি

ইতোমধ্যে সেনা সমাবেশ ও রিজার্ভ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে বিব্রত রুশ নাগরিকরাও এ ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন বলে দাবি পশ্চিমের দেশগুলোর।

এই ঘটনায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৮ সালে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সেতুটি উদ্বোধন করেন পুতিন। তার এক ঘনিষ্ঠ মিত্র সেতু নির্মাণকাজের তদারকি করেছিলেন।

পশ্চিমের গণমাধ্যমের মতে, প্রেসিডেন্টের ৭০তম জন্মদিনের ঠিক ১ দিন পর এই হামলার ঘটনায় অনেক রুশ যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুতিনের যোগ্যতা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন।

রাশিয়ার প্রতিশোধ

পুতিন ইতোমধ্যে নির্দয় ও নিষ্ঠুর হিসেবে পরিচিত জেনারেল সের্গেই সরোভিকিনকে ইউক্রেন অভিযানের দায়িত্ব দিয়েছেন।

সেতুতে বিস্ফোরণের পর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহরে গতকাল সোমবার ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ইউক্রেনে সবচেয়ে তীব্র রুশ হামলা। এতদিন ধরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চললেও সেগুলোর মাত্রা এত বেশি ছিল না। এই হামলাগুলোকে প্রতিশোধমূলক বলা হচ্ছে।

গতকাল স্থানীয় সময় সকাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশজুড়ে ৮৩টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে বলে ইউক্রেন জানিয়েছে। কিয়েভ ছাড়াও লিভিভ, দিনিপ্রো, ঝাপোরিঝঝিয়ায় ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে।

সেতু হামলার পর প্রতিশোধ নিতে কিয়েভে হামলা চালায় রাশিয়া। ছবি: এপি
সেতু হামলার পর প্রতিশোধ নিতে কিয়েভে হামলা চালায় রাশিয়া। ছবি: এপি

ইউক্রেনের পুলিশের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। হামলায় কিয়েভের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

রুশ বাহিনী ইউক্রেনের কাছে কয়েকটি ফ্রন্টে পরাস্ত হলেও ক্রিমিয়ার সেতু হামলার আগে এ ধরনের প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া মস্কোর পক্ষ থেকে দেখা যায়নি।

নিঃসন্দেহে, সেতু হামলায় 'রেগে গেছেন' পুতিন। সময়ই বলে দেবে যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হবে।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

2h ago