গাজা: রমজানে ধ্বংস ও মৃত্যুর নগরীতে জীবনের আয়োজন
ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন, 'এই যে আমরা হেঁটে যাই বোমার ভেতর দিয়ে/এতে কী তুমি মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ?/আমার তো এখনো জীবনের অভিলাষ আছে, আর আছে অনিঃশেষ বাসনা।'
আবার গত ৭ ডিসেম্বর ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ফিলিস্তিনের আরেক বিখ্যাত কবি রেফাত আলারির তার মৃত্যুর এক মাস আগে লিখে যান, 'যদি আমাকে মরতে হয়, তবু আশা থাকুক, তবু গল্প থাকুক।'
ইসারয়েলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের কাছে গত সাত দশক ধরে এভাবেই মৃত্যু হয়ে উঠেছে জীবনের উপলক্ষ।
এ দফায় অবরুদ্ধ গাজায় পাঁচ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি। অবিরাম হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ২২ লাখ মানুষের এই জনপদ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অধিকাংশই। তাদের পালানোর কোনো পথ নেই। নেই চিকিৎসার সুযোগ। এমনকি মৃত স্বজনকে সমাহিত করার জায়গাও এখন পাওয়া যাচ্ছে না।
এর ওপর খাবার ও পানির তীব্র সংকটে দুর্ভিক্ষের মুখে থাকা এ জনপদে না খেতে পেয়ে ও অপুষ্টিতে ভুগে শিশুসহ অন্তত ২৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এর ভেতরেও পবিত্র রমজানকে বরণ করে নিতে খোলা আকাশের নিচে থাকা ছেঁড়া তাঁবু সাজিয়ে চলছে সেখানকার শিশুরা। গাজার আশ্রয় শিবিরগুলোর সরু পথে তারা মেতে উঠছে বাজি পোড়ানোর উৎসবে, বানাচ্ছে কাগজের ফুল, শুভেচ্ছা কার্ড। এভাবে মৃত্যু আর ভয়ের আবহ ঘিরে থাকা এই জনপদ তারা ভরিয়ে দিচ্ছে জীবনের আয়োজনে।
গাজায় রমজান উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে আল জাজিরা। সেখানে সোয়াদ আজফর নামে বাস্তুচ্যুত এক কিশোরীকে বলতে শোনা যায়, 'আগে আমরা খেলতে খেলতে বাজি পুড়িয়ে রমজানকে স্বাগত জানাতাম। তার কিছুই এখন নেই।'
সোয়াদের মা আত্তাফ আজফর রমজান উপলক্ষে মলিন তাঁবুতে হালকা আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছেন। তার ভাষ্য, শিশুদের খুশি রাখতে, যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলিয়ে রাখতেই এই আয়োজন।
মধ্যবয়সী এই নারী বলেন, 'রমজানের এই দিনগুলোর জন্য আমরা সারাবছর অপেক্ষা করতাম। কিন্তু এবার কীভাবে তাঁবুর ভেতর রোজা কাটবে জানি না। খাবার নেই, পানি নেই। কখনো এখানে তীব্র গরম, কখনো বৃষ্টি, কখনো শীত। এমন রমজান আমাদের জীবনে আসেনি।'
গাজার বাসিন্দাদের ভাষ্য, রমজানে গাজার মসজিদগুলো নানা রঙের বাতিতে সেজে উঠত। নামাজ-ইফতারসহ সামাজিক অনেক কিছুর কেন্দ্রে ছিল এসব মসজিদ। কিন্তু চলমান ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫০০ মসজিদ পুরোপুরি ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আত্তাফ আজফর বলেন, 'এখন প্রতিদিন আমাদের ঘুম ভাঙে তীব্র অবসাদকে সঙ্গী করে। আমরা হয়তো জীবিত আছি। কিন্তু এটাকে বেঁচে থাকা বলা যাবে না।'
রমজান ঘিরে যে যুদ্ধবিরতির ক্ষীণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাতে আস্থা রাখতে পারছেন না গাজার আরেক বাসিন্দা হামাদা বিকা। তবু যাদের সামান্য সঙ্গতিও আছে, তারা সবাইকে নিয়ে রমজানের দিনগুলো উদযাপন করতে চাচ্ছেন বলে জানান তিনি। বলেন, 'সবাই তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া স্বজনদের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এই রমজান আমাদের সবার মিলন ঘটাক। এটা আমাদের শিশুদের প্রাপ্য।'
এদিকে আবুধাবিভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য ন্যাশনাল-এ প্রকাশিত এ সংক্রান্ত আরেক প্রতিবেদনে উত্তর গাজার আল শিফা হাসপাতালের কর্মী ফাখরি (৩২) বলেন, 'আমরা তো গত পাঁচ মাস ধরেই রোজা রাখছি। একবেলা খেয়ে বেঁচে আছি।'
গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার মধ্যে অন্তত ৫ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে আর এক পা দূরে আছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন ত্রাণ কর্মকর্তা নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া না হলে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ 'প্রায় অনিবার্য'।
রাফার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ওমর নেহাদ বলেন, 'আমি প্রতিদিন আলাদা আলাদা মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করতাম। এখন আর কোনো মসজিদ অবশিষ্ট নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে।'
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহ'র ৩৮ বছর বয়সী ইংরেজির শিক্ষক হাসান বলেন, 'এর আগেও যুদ্ধের সময় আমরা কঠিন রমজান কাটিয়েছি। কিন্তু এই প্রথম আমরা আমাদের বাড়িঘর ও শহর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছি। কিন্তু আমরা রোজা রাখব। এই ধরনের সংকট একজনকে খোদা ও তার ধর্মের কাছাকাছি নিয়ে আসে।'
আর অব্যাহত হামলার মুখেও গাজার শিশুরা রমজান উদযাপন করছে বলেও জানান হাসান।
দ্য ন্যাশনালের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে গাজার বাজারে নতুন মজুত আসেনি। এমন ঘাটতিতে জিনিসপত্রের দামও গাজাবাসীর নাগালের বাইরে চলে গেছে।
রাফাহ থেকে আসা ওম মোহাম্মদ বলেন, 'তবু আমরা আমাদের তাঁবুর বাইরে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখব।'
এ ছাড়া, এত কিছুর পরেও শিশুরা উদযাপনের জন্য একটা উপলক্ষ খুঁজে পাওয়ায় খুশি মোহাম্মদ।
নেদাল আবুলেনিন নামে গাজার আরেক বাসিন্দা বলেন, 'বিরূপ পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনি শিশুরা রমজানকে সামনে রেখে তাদের অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করছে। তারা খেলছে এবং আনন্দের উপলক্ষ তৈরির চেষ্টা করছে।'
আজ রোববারও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের অন্তত ১৩ জন নারী ও শিশু নিহত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে রাফার একটি আবাসিক ভবন।
এর আগে শুক্রবার পশ্চিম গাজার আল শাতি শরণার্থী শিবিরে বিমান থেকে ফেলা ত্রাণের ব্যাগের আঘাতে মারা যান পাঁচজন। তারও আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি গাজা নগরীর দক্ষিণে আল-রাশিদ স্ট্রিটে বিমান হামলা ও ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণে ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় থাকা ১১২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।
গত পাঁচ মাস ধরে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাড়ে ১২ হাজারই শিশু।
এখন রমজান সামনে রেখে সেই শিশুরাই জীবনের আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছে এই মৃত্যু উপত্যকায়।
Comments