ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন হামলায় গাজার ৩ হাসপাতালের সব কার্যক্রম বন্ধ

বিদ্যুৎ না থাকায় আল-শিফা হাসপাতালের নবজাত শিশুদের ইনকিউবেটর থেকে বের করে বিছানার উপর রাখা হয়েছে। হাসপাতালের ৩৬ নবজাত শিশুর জীবন এখন ঝুঁকিতে। ছবি: রয়টার্স
বিদ্যুৎ না থাকায় আল-শিফা হাসপাতালের নবজাত শিশুদের ইনকিউবেটর থেকে বের করে বিছানার উপর রাখা হয়েছে। হাসপাতালের ৩৬ নবজাত শিশুর জীবন এখন ঝুঁকিতে। ছবি: রয়টার্স

গাজার সবচেয়ে বড় দুই হাসপাতালে নতুন করে আর কোনো রোগী ভর্তি হতে পারছে না। ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলার মধ্যে হাসপাতালগুলোতে ওষুধ ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া অন্য এক হাসপাতালের কার্যক্রমও বন্ধ হয়েছে। হাসপাতালগুলো বেশ কয়েকজন রোগী ও চিকিৎসাকর্মীও নিহত হয়েছেন।

আজ সোমবার আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

গাজার আল-শিফা ও আল-কুদস হাসপাতাল রোববার জানিয়েছে, কার্যক্রম বন্ধ করতে তারা বাধ্য হয়েছে। উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে।

কারণ হিসেবে জেনারেটরের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা জানান কামাল আদওয়ান হাসপাতালের পরিচালক আহমেদ আল-কাহলৌত।

আল-শিফা হাসপাতালের নিউরোসার্জন ড. নিদাল আবু হাদ্রৌস জানান, হাসপাতালে কোনো বিদ্যুৎ বা পানি নেই এবং এখান থেকে নিরাপদে বের হয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। যার ফলে রোগী ও কর্মীরা 'বিপর্যয়ের' মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

'এই পরিস্থিতি বেশি সময় ধরে চলা উচিত নয়। হাসপাতালের কর্মী ও রোগীদের বাঁচাতে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন', হাদ্রৌস আল জাজিরাকে বলেন।

গাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিগগির যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস জানান, আল-শিফা হাসপাতালের পরিস্থিতি 'ভয়াবহ ও বিপদজনক'।

আল-শিফা হাসপাতাল ও এর আশেপাশের এলাকায় চলছে নিরবচ্ছিন্ন হামলা। ছবি: রয়টার্স
আল-শিফা হাসপাতাল ও এর আশেপাশের এলাকায় চলছে নিরবচ্ছিন্ন হামলা। ছবি: রয়টার্স

তিনি সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পোস্ট করে বলেন, 'হাসপাতাল সবার জন্য নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা। যখন এগুলো মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাশার প্রতীকে রূপান্তরিত হয়, তখন বিশ্ববাসী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।'

তিনি আরও বলেন, 'আল-শিফা হাসপাতাল হিসেবে কার্যকর রয়েছে, এমনটা আর বলা যাচ্ছে না।'

শুক্রবার থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত ইসরায়েলের বোমাহামলায় আল-শিফার তিন নার্স নিহত হয়েছেন। হাসপাতাল কমপ্লেক্সের কাছাকাছি জায়গাগুলোতে এসব হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিয়োজিত জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা।

জাতিসংঘের সংস্থাটি রোববার আরও জানায়, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও জেনারেটরের জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার পর থেকে দুই অপরিণত শিশুসহ মোট ১২ জন রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালের হৃদরোগ নিরাময়কেন্দ্র ও গাইনি ওয়ার্ড বোমা হামলায় বড় আকারে ক্ষতির শিকার হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, হাসপাতালে প্রায় ৬০০ থেকে ৬৫০ রোগী, ২০০ থেকে ৫০০ স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও প্রায় দেড় হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ আটকে আছেন। তাদের বের হয়ে আসার জন্য কোনো নিরাপদ পথ নেই।

রোগীদের মধ্যে আছে ৩৬টি শিশু, যাদের ইনকিউবেটরে রাখা আছে। কিন্তু ইনকিউবেটরগুলো এখন বিদ্যুতের অভাবে কাজ করছে না। ফলে এই শিশুগুলো যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। এমনটাই জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

ইসরায়েলি বাহিনী উত্তর গাজার মোটামুটি সব প্রধান চিকিৎসা অবকাঠামোকে ঘিরে রেখেছে, যার মধ্যে আল-শিফা অন্যতম।

গাজার ৩ হাসপাতালে আর নতুন করে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। ছবি: রয়টার্স
গাজার ৩ হাসপাতালে আর নতুন করে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের দাবি, আল-শিফা হাসপাতালের নিচেই হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের অবস্থান।

হামাস ও হাসপাতালের কর্মকর্তারা এই দাবি অস্বীকার করেছে। তাদের মতে, হাসপাতালের আশেপাশে হামাসের কোনো সামরিক অবকাঠামো নেই।

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ও হাসপাতালের ভেতরে আটকে থাকা মানুষ জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী সরাসরি হাসপাতাল কমপ্লেক্স লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি মুনির আল-বুর্শ জানান, স্নাইপাররা কমপাউন্ডের ভেতরে কাউকে নড়তে দেখলেই তাদের লক্ষ্য করে বাছবিচারহীনভাবে গুলি ছুড়ছেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'ভবনের বিভিন্ন অংশে আহতরা আছেন, কিন্তু আমরা তাদের কাছে যেতে পারছি না। এমন কী, আমরা জানালা দিয়ে মাথাও বের করতে পারছি না'।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী রোববার দাবি করে, তারা হাসপাতাল থেকে নবজাত শিশুদের বের করে আনার চেষ্টা করেছিল এবং তারা হাসপাতালের প্রবেশপথে ৩০০ লিটার জ্বালানি তেলও রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু হামাসের বাধার কারণে এই উদ্যোগ সফল হয়নি।

আল-শিফা হাসপাতালের ভেতর মরদেহের সারি। কবর দেওয়ার জায়গা ফুরিয়ে এসেছে। ছবি: রয়টার্স
আল-শিফা হাসপাতালের ভেতর মরদেহের সারি। কবর দেওয়ার জায়গা ফুরিয়ে এসেছে। ছবি: রয়টার্স

প্রমাণ হিসেবে ইসরায়েল একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায় সেনারা হাসপাতালের গেটের সামনে তেলের কনটেইনার রাখছেন।

হামাস জানিয়েছে, জ্বালানি গ্রহণ করা বা না করা হাসপাতালের এখতিয়ার। হাসপাতালটি হামাস নয়, বরং গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক আবু সালমিয়া এই পুরো ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করে বলেন, 'এটা ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডা'।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'ইসরায়েল সারা বিশ্বকে দেখাতে চায়, তারা শিশুদের হত্যা করছে না। তারা সামান্য ৩০০ লিটার তেল দান করে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চায়। এইটুকু তেলে ৩০ মিনিটও (হাসপাতালের কার্যক্রম) চলে না।'

হাসপাতালের গেটের সামনে ৩০০ লিটার তেল রেখে যাওয়ার দাবি করেছে ইসরায়েল। দাবি প্রমাণে একটি ভিডিও প্রকাশ করে তারা। ছবি: রয়টার্স (ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিণশট)
হাসপাতালের গেটের সামনে ৩০০ লিটার তেল রেখে যাওয়ার দাবি করেছে ইসরায়েল। দাবি প্রমাণে একটি ভিডিও প্রকাশ করে তারা। ছবি: রয়টার্স (ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিণশট)

গাজায় মোট ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি এখন অকার্যকর অবস্থায় আছে।

৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস হামলা চালালে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। হামাসের হাতে জিম্মি হন প্রায় ২০০ ইসরায়েলি ও বিদেশী নাগরিক। এর পর থেকে প্রায় ৩৬ দিন ধরে গাজা ভূখণ্ডে নির্বিচার ও প্রতিশোধমূলক বিমান ও স্থল হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।

এসব হামলায় প্রায় ১১ হাজার ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের ৪০ শতাংশই শিশু।

শুক্রবারের পর মৃতের সংখ্যার হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেশিরভাগ হাসপাতালের যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বসে যাওয়ায় সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

 

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

11h ago