হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ শহর ইসরায়েলের স্থল হামলার সবচেয়ে বড় বাধা

হামাসের ভূগর্ভস্থ সুবিশাল সুড়ঙ্গ। ছবি: রয়টার্স

প্রায় তিন সপ্তাহ নির্বিচার বিমানহামলা চালানোর পর হামাসের বিরুদ্ধে স্থল হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। তবে, এখনো তা চলছে সীমিত আকারে।

বিশ্লেষকদের মতে, স্থল হামলায় ইসরায়েলি সেনাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হামাসের ভূগর্ভস্থ সুবিশাল সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে নিহত হন এক হাজার ৪০০ মানুষ, আহত হন পাঁচ হাজারেরও বেশি। এ ছাড়া, হামাস জিম্মি করে দুই জনেরও বেশি মানুষকে, যাদের মধ্যে ইসরায়েলি ছাড়াও অন্যান্য দেশের নাগরিক রয়েছেন।

মুক্ত হওয়া জিম্মিদের একজন হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ককে মাকড়সার জালের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ভিয়েতনামের গেরিলা কমিউনিস্ট সংগঠন 'ভিয়েতকং'র সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের চেয়ে ১০ গুণ বেশি বিস্তৃত হামাসের নেটওয়ার্ক।

সুড়ঙ্গের বিষয়ে জানেন এমন সূত্রদের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল ও সীমান্তে বিভিন্ন কাজের জন্য সুড়ঙ্গ নির্মাণ করেছে হামাস। হামলা চালানো, প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন ও মজুদসহ আরও নানা কাজে ব্যবহার হয় এসব সুড়ঙ্গ।

ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল অভিযোগ তুলেছে, গাজার মূল হাসপাতাল আল-শিফার নিচে সুড়ঙ্গ তৈরি করে সেখানে কার্যক্রম চালাচ্ছে সংগঠনটি। তারা এই গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক স্থাপনাটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, 'হামাস হাসপাতালগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও লুকিয়ে থাকার জায়গায় রূপান্তরিত করেছে।'

তিনি কিছু ছবি ও অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করে বিষয়টি প্রমাণের চেষ্টা করেন। তবে, রয়টার্স হাগারির এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।

হামাস কর্মকর্তা এজ্জাত এল-রেশিক বলেছেন, 'শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের বক্তব্যে কোনো সত্যতা নেই, ভিত্তি নেই।'

যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, ইসরায়েলি বাহিনী স্থল হামলায় নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখে পড়বে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা মনে করেন, মাটির নিচে আটকে রাখা জিম্মিদের ক্ষতি না করে হামাসকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ইসরায়েলিদের জন্য হামাসের সুড়ঙ্গে অসংখ্য 'ঘরে বানানো বিস্ফোরক', নানান ফাঁদ এবং একটি ক্লান্তিকর ও কঠিন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে।

তার মতে, এরচেয়ে ইরাকের মসুল শহরকে আইএসের দখল মুক্ত করতে নয় মাসের অভিযান অনেক সহজ ছিল।

হামাসের সুড়ঙ্গের সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করতে প্রযুক্তির জন্য অনেক অর্থ বিনিয়োগ করেছে ইসরায়েল। এর মধ্যে রয়েছে 'আয়রন ওয়াল' নামের বিশেষ সেনসর। তারপরও সুড়ঙ্গগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি দেশটি।

২০২১ সালের আক্রমণের পর হামাসের নেতা ইয়াহিয়া আল সিনওয়ার বলেছিলেন, 'ইসরায়েল বলছে, তারা নাকি হামাসের সুড়ঙ্গের ১০০ কিলোমিটার জায়গা ধ্বংস করেছে। আমি বলছি, গাজা উপত্যকায় আমাদের সুড়ঙ্গের বিস্তার ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি। কাজেই তারা যদি সত্য বলেও থাকে, তা মোট সুড়ঙ্গের ২০ শতাংশ মাত্র।'

ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। ছবি: রয়টার্স

প্রত্যক্ষদর্শী জিম্মির বয়ান

সিনওয়ারের দাবির শক্ত প্রমাণ না পেলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সেটাকেই সত্য বলে মানছেন। গাজা উপত্যকা মাত্র ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের হলেও সুড়ঙ্গগুলো আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গাজার আকাশ ও নৌপথের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। স্থল সীমানার ৭২ কিলোমিটারের মধ্যে ৫৯ কিলোমিটারই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। সঙ্গে আছে দক্ষিণে মিশরের সঙ্গে থাকা ১৩ কিলোমিটার সীমানা।

হামাস তাদের সুড়ঙ্গ নিয়ে তেমন কোনো তথ্য প্রকাশ করে না। তবে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া ৮৫ বছর বয়সী জিম্মি ইয়োশেভেদ লিফশিৎজ বলেন, 'এটা মাকড়শার জালের মতো। অসংখ্য সুড়ঙ্গ রয়েছে। আমরা মাটির নিচে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটেছি।'

হামাস বিশ্বাস করে, সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে ইসরায়েল অনেক এগিয়ে থাকলেও, সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কে এগুলো খুব একটা কাজে আসবে না। হামাস চায় ইসরায়েলি সেনারা সুড়ঙ্গে এসে তাদের মোকাবিলা করুক। ইসরায়েলের কাছে অপরিচিত সেই পরিবেশে হামাস বাড়তি সুবিধা পাবে।

সম্প্রতি ইসরায়েলের এক মুখপাত্র বলেছেন, 'সুড়ঙ্গগুলো কত কিলোমিটার জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে, তা স্পষ্ট করে বলতে পারছি না, তবে এটা কোনো দিক দিয়েই ছোট নয়। স্কুল ও আবাসিক এলাকার নিচে এই নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হয়েছে।'

ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। ছবি: রয়টার্স

ভূগর্ভস্থ শহর

ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের বিমানহামলায় সুড়ঙ্গের অবকাঠামোর খুব কমই ক্ষতি হয়েছে।

ইসরায়েলি বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আমির আলভি পেয়েছিলেন সুড়ঙ্গ মোকাবিলার দায়িত্ব৷ সুড়ঙ্গপথে হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'দিনের পর দিন আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েও হামাসকে টলাতে পারিনি। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং চাইলেই তারা পাল্টা হামলা চালাতে পেরেছে।'

'গাজার মাটির নিচে ৪০-৫০ মিটার গভীরতার আস্ত একটি শহরই রয়েছে৷ সেখানে হামাসের বাংকার, নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ও গুদাম রয়েছে। এবং সঙ্গে আছে হাজারো রকেট নিক্ষেপের অবস্থান', বলেন আলভি।

অপর এক সূত্রের দাবি, সুড়ঙ্গগুলো মাইলের পর মাইল চলেছে। এগুলো কনক্রিটের তৈরি, খুব টেকসই। ভিয়েতকংয়ের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী।

ইসরায়েলের প্রতিবেশী একটি দেশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানিয়েছে, 'মিশরের নিচেও হামাসের সক্রিয় সুড়ঙ্গপথ রয়েছে।'

সূত্রটি জানায়, 'এখনো তাদের সরবরাহ শৃঙ্খল অক্ষত রয়েছে। নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে কয়েকজন মিশরীয় সেনা রয়েছেন। তবে মিশরের সেনাবাহিনী এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত কিনা, জানি না।'

মিশরের নিরাপত্তা বাহিনী সূত্র ও এল আরিশ শহরের এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, মিশর ও গাজার মধ্যে এখনো স্বল্প সংখ্যক সংকীর্ণ ও গভীর সুড়ঙ্গ সক্রিয় রয়েছে। এগুলো দিয়ে পণ্য পরিবহন অব্যাহত থাকলেও যুদ্ধ শুরুর পর এই কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেন, মিশরীয় সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব দেশটির সেনাবাহিনীর।

ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। ছবি: রয়টার্স

দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল সুড়ঙ্গ

হামাসের প্রতিষ্ঠা ১৯৮৭ সালে। ধারণা করা হয়, নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে সুড়ঙ্গ তৈরি করছে তারা। তখন ইয়াসির আরাফাতের পিএলওকে গাজায় কিছুটা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয় ইসরায়েল।

এই সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কারণেই ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের তুলনায় গাজায় হামাসের অবস্থান শক্তিশালী। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের শক্ত অবস্থানের কারণে জর্ডান থেকে পণ্য পরিবহন হামাসের জন্য অনেক কঠিন।

২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিলে সুড়ঙ্গ তৈরি আরও সহজ হয়। ২০০৬ এ নির্বাচনের মাধ্যমে হামাস গাজার ক্ষমতায় আসে।

অল্প সময়ের মধ্যেই হামাসের আল-কাসাম ব্রিগেড ৬০০ মিটার সুড়ঙ্গ খুঁড়ে গাজা সীমান্তের কেরেম শালম ঘাঁটি দখল করে নেয়।

এক বছর পর ইয়াসির আরাফাতের উত্তরসূরি মাহমুদ আব্বাসের বিরুদ্ধে এই সুড়ঙ্গপথ ব্যবহার করে সফল সামরিক হামলা চালায় হামাস।

সে সময়ে সুড়ঙ্গগুলোর ব্যাপারটি তেমন জানাজানি হয়নি, তবে গাজা থেকে রাফাহ সীমান্তে পণ্য পরিবহনে এগুলো ব্যবহার হতো।

বালুময় সুড়ঙ্গ থেকে বিশেষায়িত উইঞ্চ মটর ব্যবহার করে পেট্রোলের ব্যারেল বের করে আনা হতো।

রাফাহর সুড়ঙ্গ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত আবু কুসেই রয়টার্সকে জানান, হাফ মাইল দূরত্বের একটি সুড়ঙ্গ খনন করতে তিন থেকে ছয় মাস লাগে। এসব সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে প্রতিদিন সর্বোচ্চ এক লাখ ডলার মুনাফা আসে। সবচেয়ে লাভজনক পণ্য হলো গুলি। মিশর থেকে প্রতিটি গুলি ১ ডলারে কিনে গাজায় বিক্রি করা হয় ৬ ডলারে। মিশর থেকে কালাশনিকভ রাইফেল বা একে-৪৭ কেনা হয় ৮০০ ডলারে, বিক্রি করা হয় দ্বিগুণ দামে।

প্রচলিত আছে, ২০০৭ সালে হামাসের সামরিক শাখা তাদের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফকে মিশর থেকে গাজায় নিয়ে আসে এমনই এক সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে। অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাসের আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন দেইফ।

ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। ছবি: রয়টার্স

সুড়ঙ্গে সম্ভাব্য অভিযানের পরিণতি

ইসরায়েলের বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক জোয়েল রাসকিনের মতে, সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ঠিকভাবে শনাক্ত করা কঠিন। থ্রিডি ম্যাপিং ও সচিত্র দৃশ্যায়নের জন্য আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন।

এ কাজে নিয়োজিত আছে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো ইউনিট 'ইয়াহালোম'। কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পস শাখার এই দলটি মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁজে ধ্বংস করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছে।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইয়াহালোম যোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, 'আমি তোমাদের ওপর নির্ভর করি। ইসরায়েলের মানুষ তোমাদের ওপর নির্ভর করে।'

ইসরায়েলের কমব্যাট ইন্টেলিজেন্স কর্পসের সাবেক কমান্ডার ও মোসাদের সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আমনোন সফরিন বলেন, 'সুড়ঙ্গে প্রচুর ফাঁদ থাকবে। হামাসের কাছে থার্মোবারিক বোমা ও অস্ত্র থাকবে। ২০২১ সালে তাদের কাছে এই মারাত্মক অস্ত্র ছিল না। আমার বিশ্বাস, তাদের কাছে প্রচুর ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা আমাদের সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাংকে হামলা চালাতে পারে। হামাস সেনাদের অপহরণেরও চেষ্টা চালাবে।'

ইসরায়েলের রাইখমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যাফনে রিখমন্ড-বারাক বলেন, 'সিরিয়া ও ইরাকের সংঘাত পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে।'

তিনি বলেন, 'ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী খুব সম্ভবত সুড়ঙ্গপথে এমন কিছুর মুখোমুখি হবে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আইএসের মতো সংগঠনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান—যা তারা হামাসের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে।'

তথ্যসূত্র: রয়টার্স

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago