মোবাশ্বের হোসেন: আমাদের রূপালি আগুন

বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

শীতের সকালের মিষ্টি হাওয়া ছুঁয়ে সকালের হাঁটা শেষে ঘরে ফিরেছি কেবল। খেয়াল করলাম আমার মোবাইল ফোন রাতে যে সাইলেন্ট করে রেখেছি, তখনো সেভাবেই আছে। ভোগান্তি টের পেলাম। মোবাইল খুলে দেখি অনেকগুলো কল। ভয় পেয়ে গেলাম। একেকটা ফোন রিডায়াল করছি আর নানারকম উৎকণ্ঠার আশঙ্কা করছি। কেননা এত সকালে তো এতগুলো কল আসার কথা নয়। সেসব ফোনেই চূড়ান্ত খারাপ সংবাদটা পেলাম। ১ জানুয়ারি দিনগত রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন।

মোবাশ্বের ভাই অনেকদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নানারকম শারীরিক জটিলতার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে চিরতরে, এই আশঙ্কা কখনো করিনি। তার মৃত্যুর খবর শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। তারপর বুঝলাম, আমার চোখ-বুক ফেটে জলধারা শব্দ করেই নামছে। আমি কাঁদছি প্রচণ্ড শব্দে। কিন্তু কেন? মোবাশ্বের ভাই আমার কে ছিলেন? তিনি তো আমার আত্মীয় নন। বয়সেও আমার অনেক বড়। তার মৃত্যু আমাকে এভাবে বেদনামগ্ন করছে কেন? এভাবে ভেঙ্গে পড়ছি কেন?...

মনে পড়ল ২০১২ সালের জুলাইয়ের কথা। আমি তখন নিউজ ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক-এ নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও উৎসাহে তখন নেশার ঘোর লাগা মানুষের মতো, বিভিন্ন কৃতি মানুষের আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নিয়ে, তা প্রকাশ করছি। কাজটার প্রেমে পড়ে গেছি।

সম্পাদকীয় বৈঠকে ঠিক হলো সেবারের ঈদ সংখ্যায় আমরা মোবাশ্বের ভাইর মুখে শুনে তার জীবনের গল্প ছাপাব। মোবাশ্বের ভাইর সঙ্গে তার আগেই আমার পরিচয় ঘটেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের এক জনস্বার্থ মামলার কাজে জড়িয়ে। জনস্বার্থ মামলায় কীভাবে মোবাশ্বের ভাই বাদী হতেন, যুক্ত থাকতেন, সেটা এক অসাধারণ প্রেরণাদায়ক ঘটনা। সময় পেলে ভবিষ্যতে এ নিয়ে লিখব। তখন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আদালতে মামলা করেছে, সংসদ ভবন এলাকায় খেলার মাঠে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণের কাজ ঠেকাতে। সেই মামলার আরেক পিটিশনার মোবাশ্বের ভাই, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের সভাপতি হিসেবে। আমি বাপার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু নাসের খানের সহযোগী হিসেবে এই কাজে জড়িয়ে গেছি। আদালতে সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। সেই সূত্রে মোবাশ্বের ভাইর সঙ্গে কিছুটা জানা-শোনা হয়েছে। তার রেশ টেনে ফোন করলাম সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। সময় দিলেন।

গেলাম মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় তার স্থাপত্য ফার্মের অফিসে। সাক্ষাৎকার শুরু করতে চাই। মোবাশ্বের ভাই নারাজি। তার যুক্তি হচ্ছে, আমার সাক্ষাৎকার কেন? আমার কথা কে শুনবে? কেনই বা শুনবে? আমি পড়লাম মহাফ্যাসাদে। আমার মনে হলো আমাকেই বোধ হয় তার পছন্দ হচ্ছে না। তিনি তখন টকশোর সুবাদে টিভি স্টার। বড় বড় সাংবাদিকরা তার কাছের মানুষ। টিভি ক্যামেরায় হয়তো তার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। সে কারণেই কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন? আমিও নাছোড়বান্দা।

দেখি তার বসার টেবিলের পাশে একটা ছোট ফ্রেমে স্টেনগান হাতে বড় চুলের এক যুবকের ছবি। ছবিটা দেখেই মাথায় আইডিয়া খেলে গেল। জানতে চাইলাম ছবিটা কার? হেঁয়ালি করলেন কিছুক্ষণ। তারপর জানালেন স্টেনগান হাতে এই যুবক মুক্তিযোদ্ধাই আসলে আজকের স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। আমি তো মওকা পেয়ে গেলাম। শিহরিতও হচ্ছিলাম। একে একে তার জীবনের অসাধারণ সব গল্পের ঝাঁপি খুলে গেল। ঢাকা শহরে আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যা তৎকালে ইউসিস নামে পরিচিত ছিল, ১৯৭১ সালে সেটাতেই হামলা করেছিলেন যে বীর গেরিলারা, তাদের সম্মুখসারিতে ছিলেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রুম ছিল দেশের সেরা রাজনীতিবিদদের গোপন আস্তানা। শিশুপুত্র আর স্ত্রীকে ঢাকার ওয়ারীর বাসায় একা রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, মাঝে মাঝে রাতে এসে সেখানে আশ্রয় নেওয়া— এসব সংগ্রামীদিনের গল্প বলতে বলতে মোবাশ্বের ভাই তখন এক ঘোরলাগা মানুষ।

একজন সেল্ফমেইড মানুষ তিনি। ট্রাকে করে সবজির ব্যবসা দিয়ে জীবন শুরু করে একটা আর্থিক সামর্থ্যবান জীবন গড়েছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংক, প্রশিকা ভবনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। এসব গল্প ছাপা হলো সাপ্তাহিক-এ। আমরা বিপুল সাড়া পেলাম। তিনিও অভিভূত হলেন। দেশের সাংবাদিক মহলে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো মোবাশ্বের হোসেনের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা জীবন। তিনি কখনো এ বিষয়ে বলতে চাইতেন না। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলাদা কোনো অগ্রাধিকার নিতে চাইতেন না। সবসময় বলতেন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই, দেশটা স্বাধীন হয়েছিল বলেই, আমি আজকের এই মোবাশ্বের। নইলে তো পাকিস্তানিদের একটা কেরানি হয়েই কাটাতে হতো! এর চাইতে বড় গৌরব আর কী হতে পারে!

মোবাশ্বের ভাই অনন্য মানুষ ছিলেন। পরে বহুভাবে বহুকর্মে তার সঙ্গে জড়িয়েছি। তাকে কাছ থেকে দেখেছি। কতভাবে যে কত মানুষকে গোপনে সাহায্য করেছেন তিনি, তার সাক্ষী আমি ও সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা।

স্পষ্টভাষী ছিলেন। ক্রীড়াসংগঠক ছিলেন। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট তার হাতে গড়া সংগঠন। আবেগি ছিলেন। বাপা, ক্যাবসহ বহু সংগঠনের প্রাণভোমরা ছিলেন। হার্টে অনেকগুলো রিং পরাতে হয়েছিল। কিন্তু থামতেন না। ছুটতেন। এ বিষয়ে সাবধান করলে বলতেন, ১৯৭১ সালেই তো এক্সপায়ার করার কথা। এখন তো এক্সটেনশন জীবন যাপন করছি। তাই তার সাহসের কমতি ছিল না। কথা বলতে ভালোবাসতেন। টকশোতে মাঝরাত্রিতে কথা বলা তার স্বাস্থ্যের জন্য সুখকর ছিল না। কিন্তু কথা বলার পর উজ্জীবিত ফিল করতেন।

শিশুর মতো ভালোবাসার একটা মন ছিল। কোথাও কোনো কথা বলার পর কিংবা কারও সম্পর্কে কোনো কিছু বলার পর যদি বুঝতেন সেটা ভুল হয়েছে, অবলীলায় তার কাছে যেয়ে ক্ষমা চাইতেন। এরকম ঘটনার বহুবার সাক্ষী হয়েছি।

নানামুখী চড়াই-উৎরাই পেরোনো মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবাদী, স্পষ্টভাষী, বৈচিত্র্যময়, সংবেদনশীল, ক্রীড়া সংগঠক, বহুবর্ণা মানুষ মোবাশ্বের ভাই জীবনের শেষবেলায় তার পেশাজীবী বন্ধুদের অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। সেই বেদনা তাকে ভীষণভাবে আহত করেছিল। তা নিয়ে আক্ষেপ করতেন।

জীবন সম্ভবত এরকমই। আনন্দ-বেদনার মিশেল। তবুও মোবাশ্বের ভাই আমাদের অনেকের হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকবেন। তাকে আমরা স্মরণ করব। ভালোবাসবো। রূপালি আগুন হিসেবেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

5h ago