আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস: ভালোবাসা যেখানে এক ‘অমোঘ অস্ত্র’

আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস: ভালোবাসা যেখানে এক অমোঘ অস্ত্র
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। যুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো পৃথিবীজুড়ে। যুদ্ধে আহতদের সেবার জন্য কাজ করছে রেডক্রস। রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স চালকদের একজন হিসেবে আছে ১৭-১৮ বছর বয়সের এক কিশোর। নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। 

সে সময় সবে ইতালিতে পৌঁছেছেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তাপ প্রতিদিনই টের পাচ্ছিলেন, চোখের সামনে দেখছিলেন আঘাত, রক্তপাত আর মৃত্যু। ১০ দিনের মাথাই এলো সেই মুহূর্ত। যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে এক তাঁবুতে যোদ্ধাদের সঙ্গে বসে আছেন হেমিংওয়ে। অনতিদূরে চলছে তুমুল যুদ্ধ। হঠাৎ তাঁবুর একেবারে কাছে এসে পড়লো একটি মর্টার শেল। বিস্ফোরিত হলো তীব্র শব্দে। অ্যাম্বুলেন্স চালকদের ভেতর প্রায় সবাই মারা গেলেন। হেমিংওয়ে গুরুতর আহত হলেন। 

দীর্ঘদিন হেমিংওয়ের দিন কাটলো হাসপাতালে। হাসপাতালেই তার পরিচয় হয় সেবিকা অ্যাগনেস ফন কুরোস্কির সঙ্গে। হেমিংওয়ে তার সেবা-শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। আর তার সঙ্গে চলতে থাকে দুজনের মন দেওয়া-নেওয়া। হৃদয় বিনিময়ের পর তাদের প্রণয় আর পরিণয় লাভ করেনি। হেমিংওয়েকে সুস্থ হয়ে ফিরে যেতে হয় আমেরিকায়। অ্যাগনেসের উপায় ছিল না তার সঙ্গে যাবার। আবার, হেমিংওয়েরও উপায় ছিলো না ইতালিতে থেকে যাবার। 

নিজের জীবনের এই ঘটনাকে উপজীব্য করে একযুগ পর হেমিংওয়ে লিখলেন তার তৃতীয় উপন্যাস- 'আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস।' 

নিজের জীবনের এই ঘটনাকে উপজীব্য করে একযুগ পর হেমিংওয়ে লিখলেন তার তৃতীয় উপন্যাস- 'আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস।' 

উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র ফ্রেডরিক হেনরি আমেরিকান। আহত ফ্রেডরিকের সঙ্গে হাসপাতালে পরিচয় হয় ইংরেজ সেবিকা ক্যাথরিন বার্কলের। অনেকটা হেমিংওয়ের নিজ জীবনে ঘটা ঘটনাসমূহের আলোকেই উপন্যাসটির শুরু। তার সঙ্গে কল্পনার অনেক রং মিশে এটি পেয়েছে চূড়ান্ত রূপ। 

উপন্যাসের নায়ক ফ্রেডরিককেও হেমিংওয়ের মতোই সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়তে হয়। তবে বাস্তবের হেমিংওয়ে ফিরতে না পারলেও উপন্যাসে ফ্রেডরিক একপর্যায়ে ফেরে ক্যাথরিনের কাছে। ক্যাথরিন সন্তানসম্ভবা হয়।  পালিয়ে যায় তারা দূরদেশে। শেষপর্যন্ত কি সন্তানসহ তারা একসঙ্গে সুখে শান্তিতে থাকে? নাকি ফ্রেডরিককে শেষপর্যন্ত একা পা বাড়াতে হয় নিরুদ্দেশ যাত্রায়? সে উত্তর পাঠক পাবেন উপন্যাসটি পড়ে নিলেই। 

যুদ্ধ নিয়ে লেখা সাহিত্যের ইতিহাসে 'আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস' বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। অনেক সমালোচকের মতে এটি সর্বকালের সেরা যুদ্ধ উপন্যাস। দ্য নিউ ইয়র্ক সানের হেনরি হেলজিট যেমন বলেছেন, 'আমেরিকান সাহিত্যে স্মরণকালের সেরা কিছু হয়ে থাকলে, সেটি হেমিংওয়ের আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস।' 

তবে যুদ্ধ নিয়ে লেখা হলেও যুদ্ধের ভয়াবহতা ও সংকটের চেয়ে এখানে প্রাধান্য পেয়েছে দুজন মানুষের ভালোবাসা ও একে অপরের কাছে থাকতে চাওয়ার ব্যাপারটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ যতটা জড়িয়েছে, আমেরিকা ততটা নয়। যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা বলতে গেলে এরিক মারিয়া রেমার্কের 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' কিংবা 'থ্রি কমরেডস' এর মতো উপন্যাসগুলো অবিস্মরণীয়। তবে হেমিংওয়ের বিশেষত্ব, তিনি  উপন্যাসে দুজন তরুণ-তরুণীর আকাঙক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তাদের সম্পর্কের রসায়ন, অনুরাগ, যৌনতা ইত্যাদি এখানে হয়ে উঠেছে মুখ্য।  

হেমিংওয়ে নিজে ছিলেন অ্যাম্বুলেন্স চালকের ভূমিকায়। তবে উপন্যাসের ফ্রেডরিক একজন লেফটেন্যান্ট। অর্থাৎ, যুদ্ধে তার সংশ্লিষ্টতার জায়গা হেমিংওয়ে থেকে বেশি। 

উপন্যাসে যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে মূখ্য চরিত্র দুটোর (ফ্রেডরিক ও ক্যাথরিন) সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রেখে ও মূল ঘটনাপ্রবাহ (যা মূলত প্রণয় সম্পর্কিত) থেকে আলাদা হয়ে। ছোট ছোট ঘটনাও বিবৃত হয়েছে অত্যন্ত বিস্তারে, যাতে করে দুটো চরিত্রের আবেগিক অবস্থা হয়ে উঠেছে মূর্ত। 

তীব্র সংকটের ভেতরও এক মুহূর্তের কোনো উপলক্ষ মানুষের মুখে এনে দিতে পারে হাসি। এখানে ফ্রেডরিক ও ক্যাথরিনের ভালোবাসার ব্যাপারটি তেমনই। 

হেমিংওয়ে বাস্তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাননি। দেশে ফিরে পেয়েছিলেন বীরের সম্মান। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে সম্পর্ককেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই আমরা দেখি যুদ্ধ থেকে ফ্রেডরিককে পালাতে। তবে অন্যান্য উপন্যাসে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কার্যকারণ থাকলেও এখানে মূল চরিত্র দুটোর প্রেমে পড়ার তেমন কোনো কারণ তিনি দেখাননি। হয়তো নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাটাই এ ক্ষেত্রে নিয়ামক ছিলো।  

হেমিংওয়ে যুদ্ধে জিতেছিলেন, হারিয়েছিলেন প্রথম প্রেমকে। যা নিজের জীবনে ঘটেনি, তাই হয়তো করতে চেয়েছিলেন উপন্যাসের পাতায়। তাই উপন্যাসে ফ্রেডরিক যুদ্ধজয়ী বীর নয়, বরং হতে পারলো সাহসী প্রেমিক। উপন্যাসের নামকরণেই যুদ্ধ বা অস্ত্রকে জানানো হয়েছে বিদায়। যুদ্ধে যে  জিতুক আর যে হারুক, দুপক্ষের মানুষই তাতে মানুষ হারায়। 

উপন্যাসের পাতায় লেখকের জন্য থাকে না যুদ্ধক্ষেত্রের বাধ্যতা। তাই বাহিনী, দেশপ্রেম, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ- সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখানে একজন মানুষ বা বলা ভালো, মুখ্যচরিত্রটি তার ভালোবাসার মানুষকেই গুরুত্ব দেয়। তাকে নিয়ে পা বাড়ায় অজানার পথে। 

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা। এজন্য প্রয়োজন নেই কোনো যুক্তি বা প্রমাণের। হেমিংওয়ের কাছে 'পলিটিকাল কারেক্টনেস' তাই মুখ্য নয়। তার কাছে মূল্য রেখেছে চরিত্র দুটোর পরস্পরের প্রতি অনুভূতি, দুটো মানুষ একসঙ্গে যা ধারণ করে, বিনিময় করে বাঁচতে চায়। 

'মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কিছু বলার থাকে না। অনুভবের জন্য থাকে একমাত্র ব্যথা, যা বলে বোঝানো যায়না।'- বইয়ের শেষদিকে ফ্রেডরিকের বয়ানে আসা এই কথাটি যেন হেমিংওয়ের নিজের জীবনেরই কথা। তিনি নিজের ভালোবাসাকে হারিয়েছিলেন দেশের জন্য কর্তব্যে নিয়োজিত হয়ে; উপন্যাসের নায়ককে তাই মুক্তি দিলেন সেখান থেকে, তবে তারপরও অন্যভাবে টানলেন করুণ সমাপ্তি। সবকিছুর পর হারানোটাই হয়ে থাকলো মুখ্য। তাই যুদ্ধক্ষেত্র ও অস্ত্রকে বিদায় জানানো ফ্রেডরিকের শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরা হলো না কিছুই। তাকে নামতে হলো নিরুদ্দেশ যাত্রার পথে, একা।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

14h ago