তৈমুর লংয়ের অভিশাপ

তৈমুর লংয়ের কবর ঘিরে আছে এক রহস্যময় অভিশাপের গল্প। ছবি: এপ্রিমিজিম

'আমার কবরের শান্তি বিঘ্নিত কোরো না। এর অন্যথা হলে তোমরা পাবে আমার চেয়েও নৃশংস এক দখলদার।' লেখাটা পড়লেন জোসেফ স্তালিন। তারপর হেসে উড়িয়ে দিলেন। 

১৯৪১ সালের ২০ জুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তাল সমগ্র বিশ্ব। এর ভেতর উজবেকিস্তানের সমরখন্দ দখলে এসেছে সোভিয়েত প্রধান জোসেফ স্তালিনের। সমরখন্দ দখল করেই একটি খবর খুঁড়ে লাশটা বের করতে বললেন স্তালিন। 

কবরের ফলকে লেখা কথাগুলো তাকে কোনোভাবেই বিচলিত করতে পারলো না। স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে জানালেন, এটি যে-সে কোনো লোকের কবর নয়। কবরটি কুখ্যাত শাসক তামেরলিন এর। নামটা অবশ্য আদিতে ছিলো 'তৈমুর লং'। কুখ্যাত সেই বিকৃতমস্তিষ্কের শাসক। উচ্চারণ বিকৃতিতে হয়ে গিয়েছিল তামেরলিন। 

স্তালিন নিজেও বেশ প্রতাপশালী শাসক। এসব কথাকে তার মনে হলো কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। সবই মনের ভয়। ভয় থেকে জন্মানো কুসংস্কার। স্তালিনের নির্দেশে খোলা হলো কফিন। ৫৩৬ বছরের ঘুম ভেঙে কি আবার জেগে উঠলো তৈমুরের নৃশংসতা? 

এর ঠিক দুদিন পরেই কাকতালীয়ভাবে সেখানে আগমন ঘটে হিটলারের। সোভিয়েত রাশিয়ার সৈন্যরা একের পর এক মারা পড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় মিত্রশক্তি। তবে, নৃশংসতার বিচারে হিটলার তখনো তৈমুরের ধারে-কাছে পৌঁছায়নি। 

তৈমুর লং কে ছিলেন আর কী কারণে তার কুখ্যাতি সেসব একটু জেনে আসা যাক। 

তৈমুরের কবর থেকে লাশ ওঠানোর প্রাক্কালে সোভিয়েত প্রত্নতত্ত্ববিদেরা (জুন ২০, ১৯৪১), ছবি: অ্যাডভেঞ্চার.কম

প্রথম জীবনে ডাকাতদলের সঙ্গে থাকা তৈমুর শস্য, মালামাল, সোনা-দানা থেকে গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল কিছুই ডাকাতি করতে বাদ রাখেননি। পরে একদিন একটি ভেড়া চুরি করতে গিয়েই দুটো তীরের আঘাতে তার শরীরের ডানদিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ডান পা হয়ে যায় প্রায় অচল। খুঁড়িয়ে হাঁটতে হতো তাকে। আর ডান হাতের দুটো আঙুলও হারান তিনি। খুঁড়িয়ে হাঁটা থেকেই তার নাম হয়ে যায় ল্যাংড়া তৈমুর ওরফে তৈমুর লং। পরে বিকৃত উচ্চারণে বাইরে তা হয় তামেরলিন। 

তৈমুর অবশ্য থেমে থাকেননি। তার ধূর্ততাকে ব্যবহার করে তিনি একসময় তুর্কি সেনাবাহিনীর প্রধান হন। ঘোড়ায় চেপে ১০ হাজার সৈন্যসহ চাগাতাই দখলে নেন। তারপর খোয়ারিজম ও উরগেঞ্চও দখলে নেন। 

এরপর চেঙ্গিস খানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ট্রানসোজানিয়াও পেয়ে যান উপহার। এরপর আরও ধ্বংসযজ্ঞ শেষে তিনি মনোযোগী হন অটোমান সাম্রাজ্য দখলে। 

এরপর তৈমূর তার নৃশংসতার চূড়ান্ত করেন। 

১৪০২ সালে প্রথম বায়েজিদকে পরাস্ত করে তৈমুর অটোমান সাম্রাজ্য দখলে নেন। এরপর প্রথম বায়েজিদকে খাঁচায় বন্দি রাখা হয় আমৃত্যু। ঘোড়ার পা রাখার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে তার পিঠ। তার স্ত্রী ডেসপিনাকে রক্ষিতা বানানো হয় ও অতিথিদের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ননৃত্যের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়।

অনেকে ভাবতে পারেন, এমন তো মধ্যযুগে অনেক হয়েছে। রাজ্য দখল, সঙ্গে নারী দখল। কিন্তু তৈমুর তো আর গ্যাস চেম্বার করে ৬০ লাখ মানুষ মারেননি! 

এ ক্ষেত্রে সময়টাও বিবেচনা কর‍তে হবে। আর সঙ্গে তৈমুরের বিষয়ে আর দুয়েকটা কথা জানতে হবে। যেমন- ১৩৯৮ সালে দিল্লি দখল করে ১০ হাজার বন্দিকে এক নিমিষে হত্যা করে তার সৈন্যরা। ১৪০১ সালে বাগদাদ আক্রমণ করে প্রতি সৈন্যকে নির্দেশ দেন দুটো করে মাথা তুলতে। না পারলে তাদের নিজেরটা দিয়ে তা পূরণ হবে! 
১২০টি টাওয়ার গড়ে উঠেছিল খুলি দিয়ে। প্রতিটিতে ছিলো ৯০ হাজার খুলি। এককোটি ৮ লাখ মৃত মানুষের মাথা চোখের সামনে স্তুপ হয়ে টাওয়ার গড়েছে! ভাবতেই হয়তো গায়ে কাঁটা দেবে। 

১৩৮৭ তে পারস্যের ইস্পাহান শহরেও করগ্রহীতাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য পুরো শহরের সব মানুষকে হত্যা করেন তিনি। ঘোড়া ছুটিয়ে ঘোড়ার পায়ের নিচে জীবন্ত শিশুদের পিষে মারা হয়। এই দৃশ্য দেখার জন্য তাদের মায়েদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়৷ তারপর তাদেরও পরিণতি মৃত্যু৷ 

তৈমুর লংয়ের কবর। ছবি: সংগৃহীত

স্তালিন সবকিছুই জানতেন। তবে মৃত ব্যক্তির কোনো ক্ষমতায় বা ভূতে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। তাই দুদিন পরই ২২ জুন যখন হিটলার সোভিয়েত আক্রমণ করলেন, স্টালিন ওসব কবর ফলকের লেখাকে কোনো গুরুত্ব দেননি। 

তবে, এরপর থেকে ক্রমাগত পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। হিটলারের চৌকস বাহিনী সোভিয়েতের বড় একটা অংশ দখল করে ফেলে। ৫০ লাখের বেশি সৈন্যকে আটক করে ও ৩৩ লাখের বেশি মানুষকে অনাহারে মরতে বাধ্য করে হিটলার সোভিয়েতের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেন। হিটলারের এই অভিযানের নাম ছিলো 'অপারেশন বারবারোসা।'
 
হিটলার দিনে দিনে ব্যাপকভাবে সফল হতে থাকেন। সোভিয়েত ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পোড়ানো হয়। যেন তৈমুর লংয়ের কবর ফলকের লেখাকে সত্যি করেই হিটলার মৃত্যুর প্রতিভূ হিসেবে হাজির হন।

প্রায় দেড় বছর পর ১৯৪২ সালের নভেম্বরে স্তালিন নির্দেশ দেন তৈমুরের লাশ আবারও কবরস্থ করতে। আতর, গোলাপজল ও সব আবরণ ঠিকভাবে ব্যবহার করে তৈমুরকে আবারও শোয়ানো হয় তার কবরে। বন্ধ করে দেওয়া হয় কফিন। 

বলা হয়ে থাকে, এরপর থেকেই আবার জয় শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়ার! ১৯৪২ এর ৭ জানুয়ারি সোভিয়েত জয় পায় 'কেস ব্লু' তে। মূলত এখান থেকেই হিটলারের দুর্বল হয়ে পড়ার শুরু৷ ১৯৪৩ সালে 'অপারেশন সিটাডেলেও' হার নিশ্চিত হয় জার্মানির। পোলান্ডে রেড আর্মির বিপরীতে অপ্রত্যাশিতভাবে শোচনীয় পরাজয় ঘটে হিটলারের নাজি বাহিনীর। 

তবে, কি সত্যি কফিন খোলার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়ানো আতর আর গোলাপ জলের ঘ্রাণ সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তৈমুরের নৃশংসতাকেও? তার অভিশাপকে সত্যি করে হিটলারকে করে তুলেছিল তার চেয়েও নৃশংস? আবার কবরটিকে বদ্ধ করবার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতে লাগলো হিটলারের জয়রথ! যেন তৈমুরের শাপমুক্ত হলেন স্টালিন, আশীর্বাদ বঞ্চিত হলেন হিটলার! 

কবর ফলকের আরেকপাশে লেখা কথাটারই যেন প্রতিফলন দেখা গেলো পুরো ঘটনায়- 
'যখন আমি মৃত্যু থেকে জেগে উঠবো, পৃথিবীটা আবারও কাঁপবে'

 

তথ্যসূত্র: অ্যানসিয়েন্টঅরিজিন.কম, অ্যাডভেঞ্চার.কম
 

Comments