সরকারি জায়গা দখল ও পাহাড় ধ্বংসে বেপরোয়া চসিক কাউন্সিলর

চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকার বেলতলীঘোনায় পাহাড় কাটার খবর পেয়ে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন সেখানে অভিযান চালায়। স্টার ফাইল ফটো

চট্টগ্রামের পাহাড় কাটায় সবচেয়ে বেশি যার নাম উচ্চারিত হয়েছে তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯নং পাহাড়লী ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে সরকারি খাস জায়গা ও বাংলাদেশ রেলওয়ের জায়গা দখলের অভিযোগও আছে।

পাহাড় সাবাড় করার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একের পর এক মামলা ও প্রশাসনের একাধিক অভিযান এবং পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনার পরও তাকে দমানো যায়নি। উল্টো নিজস্ব বাহিনী দিয়ে পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট তৈরির অভিযোগ আছে।

সব শেষ এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতির (বেলার) নির্বাহী প্রধান রিজওয়ানা হাসানের গাড়িতে হামলা ও হুমকির অভিযোগে হওয়া মামলায় আকবর শাহ থানার চার্জশিট গ্রহণ করেছে চট্টগ্রামের একটি আদালত।

জহুরুল আলম আওয়ামী লীগের উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবেই কাউন্সিলর নির্বাচিত হন সব শেষ চসিক নির্বাচনে।

জানা যায়, সরকারি পাহাড় ব্যবস্থাপনার কমিটির আন্তঃবিভাগীয় সভায় 'প্রভাবশালী' এই কাউন্সিলরের নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে চান না পরিবেশ ও রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

পরিবেশ, জেলা প্রশাসন এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে আকবর শাহ এলাকার বিশ্ব কলোনি, ফিরোজ শাহ, লেকসিটি এলাকা, ফয়েজলেক এলাকার-১নং ঝিল, ২ নং ঝিল এবং ৩নং ঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলওয়ে এবং খাসজমির পাহাড় কেটে প্লট গড়েছেন জসিম। আবার অন্যদেরও পাহাড় কাটতে সহায়তা দেন তিনি। এসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের আওতায় করেছেন রাস্তাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। স্থানীয় লোকজনদের সাথে নিয়ে প্রশাসন অভিযানে গেলে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

প্রশাসন ও রেলের পাহাড় দখলের বিরুদ্ধে অভিযান ঠেকাতে প্রকাশ্যে স্থানীয়দের একতাবদ্ধও হতে বলেছেন বিভিন্ন সময়ে।

এই প্রতিবেদকের হাতে আসা এক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে কাউন্সিলর জসিম এক সভায় বলছেন, 'আপনাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং সবাইকে এক সাথে থাকতে হবে। যারা এ বস্তিতে এবং বিভিন্ন সরকারি এলাকায় বসবাস করেন তাদের এসব এলাকার বিদ্যুৎ, পানির ব্যবস্থা করার জন্য আমি আমার রাজনীতিক জীবনে অনেক কাজ করেছি। বিভিন্ন এলাকায় পানির সমস্যা সমাধানের জন্য ডিপ টিউবওয়ল থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট করে দিয়েছি। সব ঝিলের রাস্তা হয়েছে। ২নং ঝিলের রাস্তা হয়নি। বিজয়নগর, জিয়ানগর, ৩নং ঝিল, ১নং ঝিল, আকবরশাহ বেলতলীঘোনার রাস্তাও এবার হবে। আপনারা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকেন আমাকে যদি বিশ্বাস করেন। আমার কথাকেও বিশ্বাস করতে হবে। কেন বিশ্বাস করতে হবে? আমি প্রথম বার বলেছি আপনাদের যে অংশটুকু ঝিলের রেলের জায়গায় এটাকে গড়ে নেন। এখানে রেল যখন উচ্ছেদ করতে আসে, ফয়েজ লেক যখন উচ্ছেদ করতে আসে, সরকার যখন উচ্ছেদ করতে আসে, তখন আমি চেষ্টা করি আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করতে উঠানোর জন্য না। এই যে এ বছর পাহাড় ধসে চার জন মারা গেছে তখনও চেষ্টা করা হয়েছে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করতে, আবারো চেষ্টা করা হবে, যেরকম ছিন্নমূল পুরোটাই উচ্ছেদ হবে।'

একপর্যায়ে জসিম বলেন, '১নং, ২নং, ৩নং বিজয় নগর জিয়ানগর লোকজন সবাই একসাথে থাকবেন, সাথে বেলতলীঘোনা আছে। সবাই এক সাথে মুভ করবেন। এখানে রেল উচ্ছেদ করলে সব এলাকাতেই করবে।'

খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, ফয়েজলেক ২নং ঝিলের কমিটির পরিচিতি সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন। তবে সভার নির্দিষ্ট তারিখ জানা যায়নি।

গত ৭ এপ্রিল এই বেলতলীঘোনাতেই অবৈধভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর সময় মাটি চাপা পড়ে মারা যান এক শ্রমিক। এই ঘটনায় আকবরশাহ থানায় পরিবেশ কাউন্সিলর জসিম এবং চসিক কর্মকর্তাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

এর আগে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর একই স্থানে ১৩ হাজার ৩০০ ফুট পাহাড় কাটার প্রমাণ পায় পরিবেশ অধিদপ্তর। এর দায়ে স্থানীয় কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) শুনানির জন্য নোটিশ দেয়া হয়।  এছাড়া এর আগে জানুয়ারির প্রথম দিকে সেখানে জেলা প্রশাসনের অভিযান চালিয়ে স্কেভেটর জব্দ করে পাহাড় কাটার দায়ে একজনকে কারাদণ্ড দেয় ভ্রামমাণ আদালত।

জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ফয়েজলেক এলাকার ১,২, এবং ৩নং ঝিলে অবৈধভাবে ৪৪৭৬টি পরিবার বসবাস করছেন। এদের মধ্যে অনেকেই জায়গা দখল করে ভবন ও আধা পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন।

আকবরশাহ এলাকায় বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দেওয়া কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি প্রভাবশালী পক্ষের নাম সব সময় সেখানে উঠে এসেছে সেই এলাকার পাহাড় দখল ও কাটায়। আমরা অভিযান পরিচালনা করি, আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমাদের তো আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে পাহাড় বাঁচাতে যদি এখনই চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে পাহাড় একটি সময় সেখানে হারিয়ে যাবে।'

পাহাড় ব্যবস্থাপনার কমিটির সভায় ক্ষোভ

গত ৮ আগস্ট চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৬তম সভায় পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল বন্ধে এবং পাহাড় কর্তন ও দখল ঠেকাতে নানা পদক্ষেপের কথা জানানো হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

সভা সূত্রে জানা যায়, সভায় আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় দখল ও কর্তন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল হোসেন এবং জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। পাহাড় কেটে মামলা হবার পরও কীভাবে জামিন ছাড়াই আসামিরা ঘুরে বেড়ায় সেই বিষয়ে পরিবেশ ও সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চান দুই কর্মকর্তা। সেই সভাতে রেলওয়ের প্রধান ভূমি কর্মকর্তা অভিযোগ করেন সরকারি অর্থায়নে সিটি করপোরেশন রেলকে না জানিয়েই রেলের দখল করা জমিতে পানির লাইন, ড্রেন ও রাস্তা বানাচ্ছে। সভাতে এক কাউন্সিলরের দিকে ইঙ্গিত করলেও ভূমি কর্মকর্তা তার নাম সরাসরি বলতে চাননি। বারবার চিঠি দিয়েও এর সদুত্তর না মেলায় তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন মামলা দিলেও জামিন নিয়ে আবার পাহাড় কাটছেন প্রভাবশালীরা।সভা শেষে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল হোসেন কে কাউন্সিলর জসিমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রভাবশালী বলতে আসলে কেউ নেই, কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। আমরা স্পটভাবে বলেছি পাহাড় কাটার বিষয়ে কোনো ছাড় নেই, ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।'

জামিনের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। এটি আইনের যারা তারা ভালো বলতে পারবেন, তিনি বলেন।

যা বললেন কাউন্সিলর জসিম

ভিডিওতে তার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর জসিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এই ধরনের কোনো কথা কোথাও বলিনি।'

'আমার জন্মের আগে থেকেই রেলওয়ের ওই এলাকায় অনেক লোক বসবাস করে এসেছেন এখনো করছেন। অনেকে এখানে জন্মগ্রহণ করে মরেও গেছেন। আমি কেন সেখানে রাস্তা করব। রাস্তা করছে চসিক, আমি তো টেন্ডার করি না ফাইল তো আমি প্রসেস করি না। আমি জনপ্রতিনিধি হিসাবে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে আমার যা যা করা দরকার আমি করেছি,' বলেন তিনি।

সরকারদলীয় লোক হয়ে এভাবে জায়গা দখল ধরে রাখতে লোকদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'রেল যদি উচ্ছেদ করে তাহলে আমি বাধা দেওয়ার কে। বাংলাদেশে যদি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হয় তাহলে এই দেশের নিজের মানুষেরও তো থাকার অধিকার রয়েছে। রেলওয়ে নিজেই তো একটি প্রতিষ্ঠানকে কর্নকর্ডকে লিজ দিয়েছে, ওরাই তো বড় দখলদার। আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল এখানে আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। আমি হাইব্রিড না। আমি পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

10h ago