৭৫ বছরে আ. লীগ: আয়নায় নিজের মুখ দেখার সময় এসেছে
দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আজ ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে।
বাংলাদেশের জন্মের আগে ও পরে প্রায় সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল দলটি। জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের নেতৃত্বও দিয়েছে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক ও আতাউর রহমান খানের মতো নেতারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিকে আরও বহুত্ববাদী ও অসাম্প্রদায়িক করার জন্য ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং এর নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ।
দলটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা এবং ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং জনগণের বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে আওয়ামী লীগ সংকটের সম্মুখীন হয়। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ছাত্রদের মধ্যে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রতিশ্রুতিশীল নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে বিদেশ থেকে ফিরে দল পুনর্গঠন করেন।
তিনি ৪৩ বছর ধরে সংগঠনটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে দলটি পাঁচবার ক্ষমতায় এসেছে।
এছাড়াও, শেখ হাসিনা সরকারের অর্জন অন্য যে কোনো সরকারের তুলনায় অতুলনীয়।
তবে আজ আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তিতে বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে।
দল কি তার নামের প্রতি সুবিচার করছে? আওয়াম, একটি উর্দু শব্দ, যার অর্থ 'জনগণ'।
দলটি কি এখনও অতীতের মতো জনগণের 'কণ্ঠস্বর' হয়ে আছে? এটি কি আজও তার আদর্শের প্রতি অবিচল?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে দেখা যায়, দলটি তার মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত। যে দলটি একসময় নিজেকে কর্মী-ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে মনে করত, সেই দলটি আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা হয়ে পড়েছে। যে দল সব সময় জনগণের মৌলিক অধিকারের পক্ষে কথা বললেও এখন তা মূলত সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা এখন দলীয় পদে প্রভাব বিস্তার করছেন। যে দলটি জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করেছিল তারা এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন এবং বিপুল সংখ্যক বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কটের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৫ সময়কালে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় দুর্নীতিকে দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
কিন্তু সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশে আয় বৈষম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ। শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী পরিবারের দখলে এখন মোট আয়ের ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ।
সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ পেশাজীবীরা এখন দুর্নীতির অভিযোগে খবরের শিরোনাম হচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মধ্যে দলের আসল নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৬ সালে খেলাফত মজলিশের সঙ্গে চুক্তি, ইসলামপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে খুশি করার নীতি এবং হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু ও মুক্তমনা লেখকদের লেখা বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
দলের নেতারা সব সময় দাবি করেন, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারবে না। কিন্তু দলটি আসলে কতটা ঐক্যবদ্ধ তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিরোধী দলের তৎপরতার অভাবে আওয়ামী লীগ নিজেই তাদের প্রধান শত্রু হয়ে উঠেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের দুটি প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি পণ্যের দাম কমানো এবং তা সাশ্রয়ী মূল্যের মধ্যে রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু উদ্যোগ নিলেও তা অপ্রতুল বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২২ শতাংশ থেকে ৫৪ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যেখানে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এপ্রিলের ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে ১৫ বেসিস পয়েন্ট কমে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সাত মাসের মধ্যে ভোক্তা মূল্য সূচকে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
দুর্নীতি দমনে সরকারের পদক্ষেপ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। গত ১৫ বছর ধরে ঋণ কেলেঙ্কারি ও বিশৃঙ্খলা আর্থিক খাতে রাজত্ব করেছে।
২০০৮ সালের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর জনসম্মুখে প্রকাশের অঙ্গীকার করলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। পরবর্তী তিনটি নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়নি।
দলটি খেলাপি ঋণ আদায়ে আইন প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ সর্বকালের সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
জনগণকে নির্ভরযোগ্য একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক হয় তা নিশ্চিত করতে ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ডামি প্রার্থী দিতে হয়েছে। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে প্রার্থী দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হয়েছে।
দলের নির্বাচনী কৌশলের কারণে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকজন তাদের লোকজনের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছে।
আর যখনই আওয়ামী লীগের কোনো সদস্য কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত পাওয়া যায়, দলের নেতারা সেই একই পুরনো দাবি করেন – 'বিএনপি-জামায়াতের কিছু অনুপ্রবেশকারী আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে'।
আওয়ামী লীগ কি জানে তার পরীক্ষিত লোক কারা, তার কতজন সমর্থক মূল আদর্শের প্রতি অনুগত এবং তাদের মধ্যে কতজন সংকটের সময় দলের ডাকে সাড়া দেবে?
আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করার সময়, জনগণ আশা করে যে এটি তার নামের প্রতি সুবিচার করবে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে শক্তি অর্জন করবে।
Comments