বিএনপি নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবিতে প্রধান বিচারপতির কাছে স্বজনদের স্মারকলিপি

স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে কারাবন্দি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন।
মির্জা ফখরুলের জামিন
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফাইল ছবি

বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও গ্রেপ্তার বিএনপির নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন স্বজনরা।

কারাবন্দিদের স্বজনদের পক্ষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের সই করা এ স্মারকলিপি প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে কারাবন্দি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন।

এতে আরও বলা হয়, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের ৪-৫ দিন আগে থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ৪৩৫টির বেশি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭ হাজার ১০ জনের বেশি নেতাকর্মী।

এছাড়া, ২৯টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও প্রায় ৫২৬ জনের বেশি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে স্মারকলিপিতে।

এ অবস্থায় স্মারকলিপিতে বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে প্রধান বিচারপতিকে কয়েকটি বিষয়ে নজর দেওয়ার অনুরোধ করেছেন কারাবন্দি নেতাকর্মীদের স্বজনরা।

তারা বলেন-

১। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব নাগরিক সমান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য এ অধিকারটি যেন প্রযোজ্য নয়, যার প্রমাণ আমরা সবক্ষেত্রে দৃশ্যমান দেখতে পাচ্ছি। 

বর্তমান সরকার হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা গায়েবি মামলাকে বিরোধী দল দমনের প্রধান অবলম্বনে পরিণত করেছে। এই কাজে তারা রাষ্ট্রের পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। 

২। মিথ্যা, ভুয়া, গায়েবি মামলায় আমাদের স্বজনদের দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ আছেন। গ্রেপ্তারের পর তাদের অনেকের ওপর চালানো হয়েছে নির্যাতন। অনেককে আটকের পর দীর্ঘদিন অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রাখা হয়েছে। 

সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার আইন থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। পুলিশি হেফাজতে চালানো হচ্ছে নির্যাতন। আবার অজ্ঞাত স্থান থেকে আদালতে হাজির করার পর পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে এবং রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে। রিমান্ডে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে পরিবারের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা দাবি করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃত অনেককে নির্যাতন করে মিডিয়ার সামনে তথাকথিত স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ সংবিধান ও প্রচলিত আইন এটি কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।

৩। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এজাহার বহির্ভূতদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মধ্যরাতের পর বাড়ি বাড়ি হঠাৎ হানা দেওয়া হচ্ছে। এসব পুলিশি তাণ্ডবে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটক করতে না পেরে তাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য ও নাবালক সন্তানদের পর্যন্ত আটক করা হচ্ছে। 

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর মহাসমাবেশে সরকার ও সরকারি দলের পরিকল্পিত সহিংসতা ও নাশকতার নজিরবিহীন দুঃখজনক ঘটনার পর এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৮১৫টির বেশি হয়রানিমূলক গায়েবি মামলায় ১৯ হাজার ৬০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৭০ হাজার ৫০৮ জন বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে, আহত হয়েছেন ৮ হাজার ১৭৯ জনের বেশি নেতাকর্মী। নিহত হয়েছেন এক সাংবাদিকসহ বিএনপির ১৭ কর্মী। এছাড়া ২৯টি মিথ্যা মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এক লাখ ৫০ হাজার মামলায় বিএনপি ও বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলোর ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মী-সমর্থকদের আসামি করা হয়েছে।

৪। গ্রেপ্তারকৃতদের জামিন লাভের অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ বিরোধী নেতাকর্মীদের জামিনের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। কোনো অভিযুক্তের এজাহারে নাম না থাকা, এজাহারে নাম থাকলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকা, বয়োজ্যেষ্ঠতা, ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারার আইনমতে অভিযুক্তের নিজের ও অন্য সহ-অভিযুক্তের কোনো জবানবন্দী না থাকা, এজাহার দৃষ্টে মামলাটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক হওয়া, অভিযুক্তের কাছ থেকে কোনো আলামত উদ্ধার না হওয়ার বিষয়গুলো জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ বিবেচিত হলেও বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতিগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে নিম্ন আদালত থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা জামিন পাচ্ছেন না। বয়োজ্যেষ্ঠ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও জামিন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার তিনগুণ বন্দি রাখা হয়েছে। যারা সবাই বিরোধী দলীয় কর্মী-সমর্থক। অনেকক্ষেত্রে কারাগারগুলোতে বিরোধী নেতাকর্মীদের নানাভাবে নাজেহাল ও হয়রানি করা হচ্ছে।

৫। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় ইতোপূর্বে আগাম জামিন দেওয়া হলেও বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধিকাংশ ফৌজদারি আদালত আগাম জামিনের দরখাস্ত শুনানি করতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। ফলে রাজনৈতিক হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলেছে।

৬। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আগে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলাগুলো অবিশ্বাস্য দ্রুততায় নিষ্পত্তি করে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হচ্ছে।

আদালতের নির্ধারিত বিচারিক সময়ের বাইরে রাত ৯টা পর্যন্ত সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। নিরপেক্ষ সাক্ষী না ডেকে পুলিশ সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে প্রহসনমূলকভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে।

৭। অবস্থা এমন হচ্ছে যে, আমাদের আদালত স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারছে না। বিচারকাজ পরিচালনায় সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন দৃশ্যমান। জাতি হিসেবে বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা, গায়েবি, হয়রানিমূলক মামলা দায়ের, গৃহহারা করা, অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখা, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, জামিন না দেওয়া, গণহারে সাজা দেওয়ার মতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে হতাশ করছে। এর ফলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সমালোচিত হচ্ছে।

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে স্মারকলিপিতে বলা হয়, ' আমাদের বিশ্বাস বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে দেশের বিচার বিভাগকে রক্ষা করা, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনি অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান দমন-নিপীড়ন, মিথ্যা, গায়েবি, হয়রানিমূলক মামলায় গণগ্রেপ্তার, পুলিশ রিমান্ডে নির্যাতন, ঢালাও সাজা দেওয়া, জামিন না দেওয়ার বিষয়ে আপনার উদ্যোগী ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। আমাদের অনুরোধ গণ গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি ও বিরোধী মতাবলম্বী রাজনৈতিক বন্দিদের দ্রুত মুক্তির জন্য আপনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন ও আদালতগুলোর প্রতি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।'

স্মারকলিপিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ ৮৯ কারাবন্দি ও সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের তালিকাও দেওয়া হয়।

 

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

17h ago