‘জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা-পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা হচ্ছে না’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সংবাদ সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত

গুম-কারখানা 'আয়নাঘরে' এর রহস্য উন্মোচনে আরও বেশি রহস্য তৈরি হয়েছে এবং এর কুশীলবদের রক্ষার পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।  

আজ মঙ্গলবার 'অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস: কেমন আছে দেশ ও শিক্ষাঙ্গন?' শীর্ষক একটি সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

এই সংবাদ সম্মেলন নিয়ে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টার 'আয়নাঘর' পরিদর্শনের সময় 'দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম' সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও কেবল দুটি গণমাধ্যম ও কয়েকজন ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে না নেওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

বিবৃতিতে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে লালন মেলা বন্ধ করে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার উত্তরাতে বসন্ত উৎসব পণ্ড করেছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মহিলা সমিতি মিলনায়তনের নাট্যোৎসব।

এসব সহিংসতা থামাতে ব্যর্থ বর্তমান প্রশাসনকে উগ্রপন্থীদের 'সরকারি প্রতিনিধি' বলে আখ্যা দেয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উগ্রপন্থীদের দাবি অনুযায়ী প্রশাসন এসব আয়োজন থামিয়ে দিয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার ভাস্কর্য ও সুনামগঞ্জে কৃষকের ভাস্কর্যসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি ভাঙা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

'বিগত আমলের মতো নতুন বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদী প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে' মন্তব্য করে বিবৃতিতে বলা হয়, 'বঞ্চিতরা দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে এলে সেই একইরকম মারমুখী পুলিশকে দেখতে পাচ্ছি। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আমলে না নিয়ে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করেছে পুলিশ। পাহাড়ে সেনা সমর্থিত আক্রমণে নিহত হয়েছেন আদিবাসীদের সন্তান। ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ করেছে পুলিশ। সরকার যেকোনো আন্দোলনে ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছে। অথচ আন্দোলনকারীদের রাস্তায় নামার কারণটি বিবেচনা করছে না। বিগত সময়ের মতোই জুলুমবাজি করছে। এ ধরনের পুলিশী হামলা প্রমাণ করে বাংলাদেশ এখনো একটি দমনমূলক পুলিশী রাষ্ট্রই রয়ে গেছে।'

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'অভূতপূর্ব জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা ও ব্যাধিগুলোকে চিহ্নিত ও শনাক্ত করে, যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একটি সফল ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ আমাদের সামনে এনেছিল। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা দুঃশাসনের পর যখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি, ঠিক তখন ট্যাগিংয়ের বিভেদমূলক রাজনীতিকে ব্যবহার করে দেশব্যাপী সহিংসতা, বল প্রয়োগ, মব-সন্ত্রাস, তথ্য গোপন ও কণ্ঠরোধ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হেফাজতে নেওয়াসহ বহুবিধ উপায়ে নতুন ধরনের স্বৈরতন্ত্রের আশঙ্কা রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসেছে।'

শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতিতে বলা হয়, 'জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হচ্ছে না। দুঃখজনক হলো, তারা আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ, জুলাই হত্যাকাণ্ডের হোতা এবং জড়িতদের বিচারের তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।'

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার হয়নি বলেও হতাশা ব্যক্ত করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

'জুলাই জাগরণের অন্যতম বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল সর্বত্র ভেঙে পড়া প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার ও পুনর্জাগরিত করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আমরা সেই সংস্কারের বিন্দুমাত্র কোনো লক্ষণ দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনা-পদ্ধতি এখনো ফ্যাসিবাদী আমলের মতোই অগণতান্ত্রিক রয়ে গেছে,' বলা হয় বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, 'বর্তমান সরকার নির্দলীয় হলেও, উপাচার্য, ডিন, হল প্রভোস্ট, প্রক্টরের মতো প্রশাসনিক পদগুলোতে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দলীয় নিয়োগ দেওয়া চলছে। শিক্ষক সমিতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া, নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের বন্দোবস্ত না করার কারণে ক্যাম্পাসগুলোতে একমুখী স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র তীব্র হুমকির মধ্যে পড়েছে আরও একবার।' 

'প্রতিটি অঙ্গন থেকে একই প্রক্রিয়ায় দলমত নির্বিশেষে যারা সবসময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ তাদের কণ্ঠরোধের সব ধরনের আয়োজন চলছে। এমন একটি ভয়াবহ নারীবিদ্বেষী সমাজ গঠনের আয়োজনে সরকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তা এই ধরনের চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি নীরব সম্মতি বলে আমরা মনে করছি,' বলা হয় বিবৃতিতে।

প্রশাসন ৬ মাস পর্যবেক্ষণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে ১৩ দফা প্রস্তাব ও দাবিও উপস্থাপন করেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এর মধ্যে রয়েছে–মব সংস্কৃতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বিচারিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে বাতিল করা, বিভেদের রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে সব মত ও বিশ্বাসের অধিকার প্রতিষ্ঠা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক নেটওয়ার্কের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে– ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সকল ফোরামকে গণতান্ত্রিক পন্থায় সক্রিয় করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বপ্রভাবমুক্ত সার্চ কমিটি গঠন করা, শিক্ষা-বাজেট বৃদ্ধি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থী রাজনীতি বন্ধের সকল পাঁয়তারা বন্ধ করা।

Comments

The Daily Star  | English

Advisory council set to hold emergency meeting this evening

Sources from the CA office confirmed that the meeting will take place at the State Guest House, Jamuna

30m ago