ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন

দুর্নীতির অভিযোগে দুইবার আবেদন করেও মাল্টার নাগরিকত্ব পায়নি তারিক সিদ্দিকের পরিবার

তারিক আহমেদ সিদ্দিক। ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের পরিবারের সদস্যদের করা আবেদন দুইবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের আজ শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত 'অর্থপাচার, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ঘুষের' অভিযোগের বিভিন্ন প্রতিবেদনের কারণে তাদের নাগরিকত্বের আবেদন খারিজ করা হয়েছে বলে ফাঁস হওয়া কিছু নথির বরাতে জানানো হয়েছে।

তারিক আহমেদ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের চাচা। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপের চাচি শাহীন সিদ্দিকের আবেদন ২০১৩ সালে খারিজ করে দেয় মাল্টায় বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের কাছে থাকা নথির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অবৈধভাবে জমি দখলের একটি অভিযোগের সঙ্গে শাহীন সিদ্দিকের সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ করে তার মাল্টার নাগরিকত্বের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।

প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি তারিকের পরিবার কীভাবে ওই অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারও বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স।

প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০১২ সালে ঢাকায় জমি দখলের অভিযোগ ওঠে প্রচ্ছায়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রচ্ছায়ার চেয়ারম্যান ছিলেন শাহীন সিদ্দিক। ২০১৩ সালে শাহীনের করা পাসপোর্টর আবেদনে প্রচ্ছায়ার কথা উল্লেখ আছে।

শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচকদের দাবি, ২০০৯ সাল থেকে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রচ্ছায়ার জন্য জমি দখল করেন। 

নথিপত্রে দেখা গেছে, শাহীন ২০১৩ ও ২০১৫ সালে মাল্টার পাসপোর্টের জন্য দুটি আবেদন করেন। দ্বিতীয় আবেদন ছিল লন্ডনে থাকা মেয়ে বুশরা সিদ্দিকের সঙ্গে যৌথভাবে। বুশরাও প্রচ্ছায়ার একজন পরিচালক ছিলেন।

২০১৫ সালের মার্চে করা যৌথ আবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য শাহীনকে ৬ লাখ ৫০ হাজার ইউরো ও বুশরার জন্য ২৫ হাজার ইউরোর পাশাপাশি হেনলির ফি হিসেবে ৭০ হাজার ইউরো দিতে হতো।

আবেদনের অংশ হিসেবে শাহীন কুয়ালালামপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণী জমা দেন। এতে দেখা যায়, অ্যাকাউন্টে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৪০৯ ডলার ডলার জমা দেওয়া হয়েছে। আগের দুই মাসে মোট ১১টি লেনদেনের মাধ্যমে ওই অংকের নগদ অর্থ জমা দেওয়া হয়েছে। নথিতে অবশ্য ওই অর্থের উৎস নির্দিষ্ট করা নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এক বছরে কেউ বাংলাদেশ থেকে ১২ হাজার ডলারের বেশি বাইরে নিতে পারে না।'

বুশরা সেসময় লন্ডনে পড়াশোনা করছিলেন। পাসপোর্ট আবেদনে তার ঠিকানা দেওয়া ছিল সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনের কাছের একটি বাড়ির, যেখান থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে কিংস ক্রস এলাকায় শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে ও যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের ফ্ল্যাট।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ সালে টিউলিপকে ওই ফ্ল্যাটটি বিনামূল্যে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট এক আবাসন ব্যবসায়ী।

২০১৩ সালে শাহীনের মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়ে করা আবেদন হেনলি সরাসরি বাতিল করে দিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট একটি ইমেইলের তথ্য অনুযায়ী, প্রকাশিত সংবাদে প্রচ্ছায়ার 'অর্থপাচার, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ঘুষের সঙ্গে' তিনিও জড়িত ছিলেন।

দুই বছর পর মেয়ে বুশরাত সঙ্গে যৌথভাবে করা আবেদনে শাহীন সিদ্দিক প্রচ্ছায়ার কোনো উল্লেখ করেননি। এবার তিনি তার প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রামে 'দ্য আর্ট প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড' নাম ব্যবহার করেন।

এই আবেদনের বিষয়ে হেনলির এক কর্মী একটি অভ্যন্তরীণ ইমেইলে বলেন, 'যদিও কোনো নেতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়নি', মাল্টার কর্তৃপক্ষের জন্য ওই কোম্পানি সম্পর্কে আরও তথ্যের প্রয়োজন।

ইমেইলের জবাবে আরেক কর্মী লিখেছেন, আর্ট প্রেস '১৯২৬ সালে মিসেস শাহীন সিদ্দিকের দাদার শুরু করা ব্যবসা'। মিসেস শাহীন এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (২০১৩ সাল থেকে)।

ফাঁস হওয়া ২০১৫ সালের শেষদিকের একটি নথিতে শাহীনের নাম 'আবেদন বাতিল এবং/অথবা প্রত্যাখ্যাত' আবেদনকারীদের তালিকায় দেখা গেছে। মাল্টার সরকারি গেজেট নিশ্চিত করছে যে, শাহীন বা বুশরা কেউই মাল্টার পাসপোর্ট পাননি।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, বুশরা সিদ্দিক পড়াশোনার পর যুক্তরাজ্যেই থেকে যান। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে স্নাতক করার পরপর তিনি বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগানে যোগ দেন এবং ২০১৮ সালে তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে 'লাইফস্টাইল, ফ্যাশন ও ভ্রমণ' বিষয়ক ইনফ্লুয়েন্সার হন।

গত বছর ইউটিউবে এক সাক্ষাৎকারে বুশরা বলেন, তিনি কিছুদিন 'কষ্ট' করার পর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তার বাবা তারিক সিদ্দিক মেয়ের স্বনামধন্য আমেরিকান ব্যাংকে চাকরির জন্য গর্বিত ছিলেন। এরপরেও তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।

তিনি বলেন, 'আমি এসেছি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত জায়গা থেকে। আমি আসলে তখন বিবাহিত ছিলাম, আমার স্বামী ছিল। মাথার উপরে ছাদ ছিল এবং তার ভাড়া দেওয়ার জন্য আমাকে চিন্তা করতে হতো না।'

২০১৮ সালে বুশরা তার স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনে ১০ লাখ পাউন্ডে পাঁচ বেডরুমের একটি বাড়ি কেনেন। ল্যান্ড রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওই সম্পত্তিটির বিপরীতে কোনো কিছু বন্ধক রাখা হয়নি।

ইউটিউব সাক্ষাৎকারে বুশরা বলেন, 'আমার সঞ্চয় ছিল এবং আমি জানতাম যদি আমার সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় তবে আমার বাবা-মা তো আছেন।'

মাল্টার নাগরিকত্বের আবেদনের বিষয়ে বুশরা সিদ্দিক ও শাহীন সিদ্দিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের মন্তব্যের অনুরোধের জবাব দেননি।

তবে, হেনলি নিশ্চিত করেছে তাদের পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি। 

এদিকে, তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমের অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Poll irregularities: Sedition among 3 new charges added against three ex-CECs

BNP filed a case against 24 individuals, including three former chief election commissioners, 10 election commissioners, and top government and police officials, for their alleged role in irregularities and biasness during the national elections in 2014, 2018, and 2024.

12m ago