টিউলিপের বিকল্প খুঁজছে ডাউনিং স্ট্রিট
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মিত্রদের থেকে লন্ডনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিককে পদত্যাগে বাধ্য করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার বিকল্প কে হবেন, সে বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের ঘনিষ্ঠরা।
আজ শুক্রবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসের এক প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের ঘনিষ্ঠ সূত্রদের বরাত দিয়ে এই কথা জানানো হয়েছে।
তারা ইতোমধ্যে সিটি মিনিস্টার টিউলিপের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে কয়েকজন প্রার্থীর সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছেন বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে দুর্নীতিবিরোধী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি।
সোমবার টিউলিপ সিদ্দিক নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানানোর আগে সপ্তাহান্তে (শনি ও রোববার) এই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
স্টারমার জানিয়েছেন, টিউলিপের প্রতি তার সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এ বিষয়ে ডাউনিং স্ট্রিটের মুখপাত্র জানান, টিউলিপের বিকল্প প্রার্থীদের তালিকা তৈরির বিষয়টি 'একেবারেই সত্য নয়।'
তবে দ্য টাইমসকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সূত্র জানিয়েছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে টিউলিপের বিকল্প কে হতে পারেন, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা (ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাডভাইজার অব মিনিস্ট্রিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস) লউরি ম্যাগনাসকে চিঠি লিখেছেন টিউলিপ। চিঠিতে মন্ত্রী পর্যায়ের কোনো আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন কি না তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন তিনি। টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া একাধিক সম্পত্তিতে বসবাস করেছেন।
ইতোমধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক ও তার পরিবারের সাত সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পাশাপাশি, রুশ অর্থায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
টিউলিপের বিকল্প হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভসের দুই সহযোগী অ্যালিস্টেয়ার স্ট্র্যাথার্ন ও ইমোজেন ওয়াকার।
আরও যাদের নাম বিবেচনা করা হচ্ছে, তারা হলেন মন্ত্রিসভার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের ব্যক্তিগত সচিব (পিপিএস) ক্যালাম অ্যান্ডারসন, কনিষ্ক নারায়ণ, পরিবেশ বিভাগের পিপিএস জশ সায়মন্স ও র্যাচেল ব্লেক।
অ্যাটর্নি জেনারেল লুসি রিগবি, মন্ত্রিসভার সহযোগী ও অর্থনীতিবিদ টরস্টেন বেলের নামও শোনা গেছে।
লেবার পার্টির এক সূত্র গণমাধ্যমটিকে জানান, টিউলিপ নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে এটাই ইঙ্গিত করছেন যে তিনি 'নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়ে সম্মানজনক বিদায়ের' পথ খুঁজছেন।
সম্প্রতি ব্রিটেনের সানডে টাইমসের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, টিউলিপকে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় সাত লাখ পাউন্ড মূল্যের একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক আবাসন ব্যবসায়ী। একইভাবে তার বোন আজমিনা সাড়ে ছয় লাখ পাউন্ডের একটি ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন। টিউলিপ নিজেও ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করেছেন। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় চাপের মুখে পড়েন টিউলিপ।
তবে লন্ডনে ফ্ল্যাট উপহার নিয়ে টিউলিপ কোনো অন্যায় করেনি বলে দাবি করেছেন তার একজন মুখপাত্র। তিনি বলেছেন, টিউলিপের ওই ফ্ল্যাট পাওয়া বা অন্য কোনো সম্পত্তি অর্জনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার খবর 'ভুল'।
তিনি লউরি ম্যাগনাসকে লিখেছেন, 'গত কয়েক সপ্তাহে আমি গণমাধ্যমে খবরের বিষয়বস্তু হয়েছি। আমার আর্থিক বিষয় ও বাংলাদেশের সাবেক সরকারের সঙ্গে আমার পরিবারের যোগসূত্র নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার বেশিরভাগই ভুল।'
তিনি আরও লেখেন, 'আমি স্পষ্টভাবে বলছি, কোনো ভুল করিনি। তবে সন্দেহ এড়ানোর জন্য আমি চাই, আপনি স্বাধীনভাবে এগুলো তদন্ত করে সত্য উদ্ঘাটন করুন।'
অপরদিকে, বাংলাদেশে গুম থাকার পর ফিরে আসা আইনজীবী আহমদ বিন কাসেম দাবি করেছেন, লন্ডনে টিউলিপকে সাংবাদিকরা দুর্নীতি বিষয়ে প্রশ্ন করার পর বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যরা তার পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল।
সে সময় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না টিউলিপ। চ্যানেল ফোরের সাংবাদিকরা তাকে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষিত বিরোধী দলের আইনজীবী আহমদ বিন কাসেমকে আটক রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করেন।
কাসেমের মা টিউলিপকে চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়টির দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, 'আমি দেখেছি, আপনি বাংলাদেশ সফরের সময় দেওয়া বক্তব্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন।'
পরবর্তীতে টিউলিপ দাবি করেন, তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মিনিস্টারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়টির দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান। জবাবে ওই মিনিস্টার জানান তিনি বিষয়টি ঢাকার হাই কমিশনে উত্থাপন করবেন।
এই সাক্ষাৎকারটি টিভিতে প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগে র্যাবের সদস্যরা ঢাকায় কাসেমের পারিবারিক বাড়িতে উপস্থিত হন। উল্লেখ্য, র্যাবের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
গত বছর হাসিনার পতনের পর মুক্তি পান কাসেম। তিনি দ্য টাইমসকে বলেন, 'আমার স্ত্রী, মা ও সন্তানরা দীর্ঘ আট বছর ধরে জানতে পারেনি আমি বেঁচে আছি না মারা গেছি। কারো এ ধরনের কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত নয়। চাইলে তিনি (টিউলিপ) এটা থামাতে পারতেন। আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, তা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। এটা ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও সুপরিকল্পিত নির্যাতন।'
টিউলিপ এ বিষয়ে কী করতে পারতেন, এ প্রশ্নের জবাবে কাসেম বলেন, 'অন্তত তিনি বিষয়টা তার পরিবারের কাছে উত্থাপন করতে পারতেন এবং এর কোনো সুরাহা করা যায় কী না, সেটার বিষয়ে খোঁজখবর করতে পারতেন। এতে আমার পরিবার অন্তত এটুকু জানতে পারতো যে আমি বেঁচে আছি না মারা গেছি।'
কাসেম বলেন, 'যদি টিউলিপের মন্ত্রিত্ব থাকে, তাহলে তা যুক্তরাজ্য ও সার্বিকভাবে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্যদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে। যুক্তরাজ্যে মানবাধিকার রক্ষা, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বৈশ্বিকভাবে মানদণ্ড হিশেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের আইনও যুক্তরাজ্যের আইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এসব মূল্যবোধ ধরে রাখতে না পারলে তা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যুক্তরাজ্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
টিউলিপের এক মিত্র জানান, বাংলাদেশে কাসেমের বাড়িতে অভিযান বা এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি জড়িত বা অবগত নন।
টিউলিপের মুখপাত্র জানান, 'এসব অভিযোগের বিপরীতে কোনো প্রমাণ নেই। টিউলিপের সঙ্গে কেউ এ বিষয়ে যোগাযোগ করেননি এবং তিনি এ সংক্রান্ত সব দাবি অস্বীকার করছেন।'
Comments