কারফিউর প্রথম রাত এবং একটি অপহরণ
পরিষ্কার আকাশ। চাঁদনি রাত। হালকা বাতাস বইছে। পুরো রাস্তা জুড়ে এক ভৌতিক নীরবতা। ফাঁকা রাস্তায় আমাদের মোটরসাইকেলের শব্দ নিজেদের কানেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সারা দিন যেখানে গুলির আওয়াজ, টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধ, আর স্লোগানের গমগমে ভরে থাকে, সে তুলনায় ওই রাত ছিল পুরোই বিপরীত।
বলছি ১৯ জুলাই রাত ১২টার পরের কথা। সেদিন আমাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে আন্দোলনে ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর—দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একদিনে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। সরকার মধ্যরাত থেকে দেশজুড়ে কারফিউ ঘোষণা করে এবং পুলিশকে 'দেখামাত্র গুলি'র নির্দেশ দেয়। সেনাবাহিনী টহলে নামবে বলে ঘোষণা আসে।
এই রাত দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। আগে শুধু কারফিউয়ের কথা শুনেছি। এবার সুযোগ হলো কারফিউকালে ঢাকা দেখার। আহমেদ দীপ্ত আর আমি দুই মোটরসাইকেলে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরছিলাম। আশা ছিল লেখার মতো কোনো গল্প পাবো। হতে পারে সেটা আমরা ছাড়া কেউ পাবে না, কারণ দিনভর ব্যস্ততার শেষে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত বেশিরভাগ সাংবাদিক নিশ্চয়ই আজ রাতে বের হবে না।
চলতি পথের প্রথম বিরতি নিলাম খিলগাঁও ফ্লাইওভারের উপর। ফাঁকা রাস্তার ছবি তুললাম। কালো মেঘে ঢাকা এক পূর্নিমা। রাস্তায় সাঁইসাঁই করে অ্যাম্বুলেন্সের হর্ণ বাজছে মাঝেমধ্যে। গুটিকয়েক ট্রাকও চলছে। কিছু ব্যাটারিচালিত খালি রিকশাকে দেখলাম রেলগেট এলাকা দিয়ে তাড়াহুড়োয় চলছে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বেশ কয়েকটি ট্রেন দাঁড়িয়ে। আগের কয়েকদিনের আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচল।
খিলগাঁও থেকে যাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে—যেখান থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত। শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, জগন্নাথ হল আর নীলক্ষেত—সব প্রবেশপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড। একমাত্র উন্মুক্ত প্রবেশপথ পেলাম ফুলার রোড, যেখান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গুটিকয়েক পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন সে সময় পাহারায়। নিজেদের মধ্যে মজা করলাম, আজ রাতে উপাচার্য নিশ্চিত এখানে থাকছেন না।
মলচত্বরের পাশ দিয়ে 'হলপাড়া'র দিকে যাওয়ার সময় মনে পড়ছিল দুদিন আগের কথা। সেদিন সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়ার পর এই পুরো চত্বর এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। পুরো এলাকার রাস্তায় পরে থাকা ইটের টুকরোগুলো জুলাইয়ের শুরু থেকে এখানকার মিছিল, স্লোগান আর শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ের নীরব সাক্ষ্য দিচ্ছিল।
রাত আড়াইটার দিকে অফিসে যাই আমাদের আরেক সহকর্মী সুকান্ত হালদারকে সঙ্গী করতে। সেও এই অভিজ্ঞতা হাতছাড়া করতে চায়নি। অফিসে গিয়ে দেখি আমাদের চীফ রিপোর্টার পিনাকী রায় সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। ২০০৭ সালের কারফিউ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। বাসা দূরে হওয়ায় তাই বাসায় যাওয়ার ঝুঁকি নেননি। কারণ তিনি জানতেন, বাসায় গেলে আবার অফিসে আসাতে বাধার মুখে পরতে হবে।
সুকান্তকে একটি মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে রওনা দিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। সেখানে মর্গে ঢুকলাম প্রিয়জনের মরদেহের অপেক্ষায় কেউ আছেন কি না, জানতে। ওই রাতে কেউ ছিলেন না। তবে নিরাপত্তারক্ষীরা জানালেন, দিনভরই এমন স্বজন হারানো মানুষের ভিড় লেগে ছিল মর্গের আশপাশে।
রাত ফিকে হয়ে আসতে শুরু করে। ফজরের আজান হচ্ছিল। সেইসময় আমরা ধানমন্ডি হয়ে মোহাম্মদপুরের দিকে যাচ্ছি। এ দুই এলাকা আগের দিন সমানতালে লড়েছে যাত্রাবাড়ি, উত্তরা আর রামপুরার মতোই। ফুটপাতের টাইলসগুলো সব ভাঙা; রাস্তাজুড়ে ইটের টুকরা, পোড়া গাড়ি, বাস আর পিকআপ ভ্যান। দু-একজনকে দেখলাম এসব গাড়ির 'ভাঙা টুকরোগুলো' খুলে নিচ্ছে।
প্রথম যখন জলপাই রঙের গাড়ির মুখোমুখি হলাম তখন সকাল ৬টা ৫ মিনিট। জাতীয় সংসদের সামনে লাইন দিয়ে সেনাবাহিনীর জিপ আর ভ্যানগুলো যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর গেটের দিকে যেতে যেতে বুঝলাম, মাত্রই গাড়িগুলো সৈন্যদের রাস্তায় মোতায়েন করতে করতে যাচ্ছে। বিজয় সরণি মোড়ে তাদের নিরাপত্তা চৌকির সামনে পড়লাম। কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দিল। বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আজকের মতো কারফিউ দেখা শেষ।
তখনই ফোনটা বেজে উঠল।
নাহিদ অপহৃত
পরিচিত একজন কল করে জানালেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে সবুজবাগের একটি বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম একজন। কল পাওয়ার পরই মনে হলো, এটাই সেই ব্রেকিং নিউজ, যার প্রত্যাশা নিয়ে সারা দিনের ক্লান্তি শেষেও রাতভর ঘুরে বেড়ালাম।
তখনও জানি না এই ফোনকলটি আমাদের দীর্ঘ অনিদ্রাকে আরও দীর্ঘতর করে তুলবে। যিনি কল করেছিলেন তার কাছে নাহিদের অপহৃত হওয়ার সুনির্দিষ্ট স্থানের তথ্য জানতে চাইলাম, যাতে সেখানে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে লিখতে পারি। যদিও ২৪ ঘণ্টার সংবাদের এই যুগে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। পাঠকদের হাতে খবর পৌঁছে দিতে অপেক্ষা করতে হতো পরদিনের পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার জন্য।
তবুও দ্রুত যাওয়ার তাড়া ছিল। ঠিকানা পেয়ে প্রথমে বিভ্রান্ত হই। কোন দিক দিয়ে সবুজবাগ যাব, বুঝতে পারছিলাম না। সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল হাতিরঝিল দিয়ে বনশ্রী হয়ে। কিন্তু আগের দিন ওই এলাকাতেই আন্দোলন কাভার করেছি। জানি যে, ওই রোডে মোটরসাইকেলে যাতায়াত প্রায় অসম্ভব। কেননা, রাস্তাজুড়ে গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছিল আন্দোলনকারীরা। তবুও দুর্গম পথই পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রওনা হলাম।
সকাল সাড়ে ৭টায় পৌঁছালাম সবুজবাগ। যে বাড়ি থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছে, খুঁজে বের করলাম। কিন্তু ওই বাড়ির দরজা কেউ খুলল না। বারবার নক করলাম; চিৎকার করে নিজেদের পরিচয় দিলাম; অভয় দিলাম—কাজ হলো না। বারান্দার কোণা থেকে কয়েকজন উঁকি দিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল। চোখেমুখে ভয়। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না।
এর মধ্যেই স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। সেখানে নৈশপ্রহরী এবং স্থানীয় মসজিদের ইমামের সঙ্গে কথা বললাম। তারা নিশ্চিত করল যে আগের রাতে ওই বাড়ি থেকেই কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রকমের চারটি গাড়িতে প্রায় ২৫-৩০ জন সাদা পোশাকের লোক সেখানে এসেছিলেন। একজন নারীও ছিলেন তাদের সঙ্গে। তাদের কয়েকজন দেয়াল বেয়ে ভেতরে ঢুকে মূল ফটকের তালা ভাঙেন।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন, ভেতরের কেঁচিগেটের তালা খুব শক্ত ছিল। সেটা ভাঙতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভারী সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হয়। আর সেই সরঞ্জাম আনার জন্য আরেকটি ইউনিটকে খবর পাঠানো হয়। প্রায় আধঘণ্টা পর ওরা আসলে তালা ভেঙে ভবনে ঢুকে তল্লাশি চালায় দলটি।
আর নাহিদ সম্ভবত ছাদে ছিলেন এবং সেখান থেকেই তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
নাহিদ বিভিন্ন সময় ছাত্র আন্দোলনকারীদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ফলে এটা ওইদিনের একটা বড় খবর ছিল।
দুটি কালো গাড়ি
আমরা বাসায় ফিরি একটু বিশ্রাম নিতে। বিকেলে নাহিদের বাবা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করেন, পাননি। খিলগাঁও থানায় জিডি করতে গিয়েও পারেননি। দুপুরে অফিসে এসে লিখি, 'নাহিদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ'।
কিন্তু ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজনের একটা কথা মাথা থেকে ফেলতে পারছিলাম না। এক নৈশপ্রহরীর ভাষ্যমতে, রাতে ওই অভিযানের সময় একটি এসইউভি ও একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে দুটি কালো গাড়িও ছিল। যেহেতু এই সমন্বয়ককে আটকের কথা কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বীকার করেনি, তাই তাকে তুলে নেওয়া সংস্থাকে শনাক্ত করাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল।
পরের দিন কারফিউর কারণে পরিস্থিতি শান্ত থাকায় আমি আবার সেই বাড়ির আশেপাশের রাস্তাগুলো ঘুরে দেখতে যাই। নাহিদকে যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তার আশপাশের ভবনগুলোর মধ্যে কোথাও সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কি না, সেটা খুঁজতে থাকি। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পেলে নাহিদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
তিনটি সম্ভাব্য জায়গা থেকে নাহিদকে তুলে নিয়ে যাওয়া গাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া সম্ভব ছিল—একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার ওয়ার্কশপ, একটি ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিক্রয়কেন্দ্র এবং একটি ফার্মেসি।
প্রথমেই আমি ওয়ার্কশপের এক কর্মচারীর কাছে গিয়ে বলি, গত রাতে এই এলাকা থেকে আমার ভাইয়ের মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। আমি তাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাই। তিনি আমার কথার খুব একটা গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলো না। বললেন, 'দুপুরের পর আসেন, মালিকের সাথে কথা বইলেন।'
সেখান থেকে গেলাম ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকানে। সেখানেও একই গল্প ফাঁদলাম। বুঝলাম ফুটেজ দেখাতে আগ্রহী না। মালিক ও কর্মচারী একে অপরের দিকে তাকালেন। একজন বললেন, তারা এই মনিটর চালাতে পারেন না এবং ফুটেজগুলো একেবারেই অস্পষ্ট।
কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছিল তাদের যদি সত্যটা বলি, তাহলে হয়তো সহযোগিতা করবে। কারণ, এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রতিটা অলিগলির মানুষ একাত্মতা পোষণ করছিল। কোটা সংস্কারের দাবি থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে যাচ্ছিল আন্দোলন। একপর্যায়ে সত্যিটা বললাম তাদের—'আমি জানার চেষ্টা করছি কারা এই আন্দোলনের অন্যতম এক সংগঠককে তুলে নিয়ে গেছে।' যখন বললাম, তালা ভেঙে চোরের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাচ্চা ছেলেদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ, তখন তাদের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারলাম—কাজ হবে।
কর্মচারী এগিয়ে এসে খুব নিচু স্বরে আমাকে বললেন যে কীভাবে সিসিটিভি মনিটর চালাতে হয়। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আমি দোকানে অবস্থান করলাম। তারা সহযোগিতা করল। গাড়িগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করলাম। তবে তারা ঠিকই বলেছিলেন—ফুটেজ এতই ঝাপসা যে ঠিকভাবে কিছু বোঝা যায় না। তারা আমাকে পরামর্শ দিলেন ফার্মেসির ফুটেজ দেখতে। কারণ, তাদের ক্যামেরাটা তুলনামূলক উন্নত। যখন বললাম সকাল থেকে দেখছি ফার্মেসিটি বন্ধ, তখন তারাই বললেন কোথায় গেলে ফার্মেসির মালিককে খুঁজে পাওয়া যাবে।
টানটান উত্তেজনা
একটি নির্মাণাধীন ভবনের সামনে ফার্মেসির মালিককে পেলাম। প্রথমে তিনি ফুটেজ দিতে অস্বীকার করলেন। অবশ্য রাজি করাতে খুব বেগ পেতে হয়নি। তবে বললেন, 'আগামীকাল আসুন।'
পরদিন ২২ জুলাই সেখানে আবার গেলাম। কল করলাম ফার্মেসির মালিককে। তিনি বললেন ফার্মেসির উল্টোপাশে এক ঘুপচি ঘরের এক ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। গেলাম। ছেলেটি ফোনে কথা বলে আমার থেকে পেনড্রাইভ চাইল। আমি তাকে ফুটেজ দেখানোর জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু ছেলেটি জানালো, এই সিসিটিভির সেটআপ রয়েছে এক বিধবার বাড়িতে। সেখানে অপরিচিত কাউকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে তাকে পেনড্রাইভ দিয়ে অপেক্ষা করলাম ঘণ্টাখানেক।
ছেলেটি ফিরে এসে বলল, আমি যে সময়ের ফুটেজ চেয়েছি, তখন খুব সম্ভবত বিদ্যুৎ ছিল না। কারণ সে যতটুকু ফুটেজ দেখেছে, তার পুরোটা ব্ল্যাংক। 'সম্ভবত পেনড্রাইভে আপনার কাজে আসার মতো কিছু নেই' জানিয়ে ছেলেটি হারিয়ে গেল।
অফিসে ফিরলাম ভগ্নহৃদয়ে। মনে হচ্ছিল, সত্যিটা জানার খুব কাছ থেকে ফেরত যাচ্ছি।
অফিসে ফিরে দেখলাম, অনেক কষ্টে জোগাড় করা তিনটি ফাইলের কোনোটিই আমার কম্পিউটারে খোলা যাচ্ছে না। অফিসের আইটি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় ফুটেজগুলো চালু হলো। প্রথম ফাইলটিতে সত্যিই কিছু নেই। সম্পূর্ণ কালো পর্দা ঢাকা একঘণ্টার ফুটেজ।
কিন্তু দ্বিতীয় ফাইলটি ওপেন করতেই মিলল 'সোনার হরিণ'।
ঠিক ক্যামেরার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল একটা কালো গাড়ি। গায়ে 'র্যাব-৩' লেখা। অন্য একটি গাড়িও দেখা গেল। প্রথমে গাড়ির নম্বর প্লেট দেখা যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে একটি গাড়ির পেছনের ডালা খুলে 'তালা ভাঙার কিছু যন্ত্র' বের করতে দেখা গেল সাদা পোশাকধারী কাউকে। ওই সময় নম্বরপ্লেটটি ক্যামেরার সামনে দৃশ্যমান হয়।
যা খুঁজছিলাম পেয়ে যাই সেটা। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে জানি, একটি প্রতিবেদন তৈরি করা এতটাও সহজ না। এর জন্য সহায়ক তথ্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মন্তব্য পাওয়ার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ধীর। ইন্টারনেট না থাকায় কর্তৃপক্ষ থেকে গাড়ির নম্বর যাচাই করাও সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে প্রতিবেদনটি ছাপা হয় আরও বেশকিছুদিন পর—৩০ জুলাই, যখন নাহিদকে দ্বিতীয়বারের মতো তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। অবশ্য সেবার তারা তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে।
শেষের মজা
'নাহিদকে প্রথমে কে তুলে নিয়ে গেল?' শিরোনামে প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন আরও পাঁচজন সমন্বয়কসহ তাকে টেলিভিশনে দেখা যায়। 'হারুনের ভাতের হোটেল' থেকে তাদের দিয়ে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দেওয়ানো হয়। আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা ছিল সেই বিবৃতিতে, যদিও তা সফল হয়নি।
এর মাসখানেক পর র্যাবের পক্ষ থেকে একটি কল পাই। ততদিনে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। নাহিদ এই সরকারের তরুণ উপদেষ্টাদের একজন। র্যাবের ওই কর্মকর্তা আমার কাছে সেই সিসিটিভি ফুটেজটি নিতে চান। বলেন, তাদের 'মাননীয় উপদেষ্টা'কে কারা অপহরণ করেছিল, তার তদন্ত করতে চায় র্যাব।
Comments