মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন তথ্যভিত্তিক হয়, পরমতসহিষ্ণুতাও জরুরি
বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রকে সবচেয়ে বড় 'সাংবিধানিক শক্তি' হিসেবে অভিহিত করে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বক্তারা বলেছেন, এই গণতন্ত্রের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য।
বক্তাদের অভিমত, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সফল হয়নি। ফলে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যে নতুন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য মত ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষার সব আইন এবং প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে।
পাশাপাশি এই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে পরমতসহিষ্ণুতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন আলোচকরা। বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে হবে তথ্যভিত্তিক। এই স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে এমন কালো আইনগুলো বাতিল করতে হবে। জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য কাজ করতে হবে।
আজ শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে 'অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতা' শীর্ষক এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কবি, লেখক, সংবাদকর্মী, সম্পাদক, অনুবাদক, আইনজীবীসহ বিদ্যায়তনিক পরিসরের বিশিষ্টজনরা অংশ নেন।
এটি ছিল দ্য ডেইলি স্টারের আয়োজনে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংবিধান বিষয়ক সিরিজ আলোচনার তৃতীয় পর্ব।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী এবং ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণকারী লুৎফুন্নাহার লুমা বলেন, 'এখনো অনুভব করতে পারছি না যে আমরা কতটা স্বাধীন হয়েছি। আগে সবকিছু অনেক ভেবে বলতে হতো। এখনো ভেবে বলতে হয়। এর কারণ হয়তো দমনের চিন্তাটা আমাদের মস্তিস্কে বসে গেছে।'
এখন ভিন্নমত প্রকাশের কারণে সরকারি দমন-পীড়ন না চললেও অনেকের ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন লুৎফুন্নাহার। বলেন, এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার বিকল্প নেই।
গবেষক ও শিক্ষক খান মো. রবিউল আলমের পর্যবেক্ষণ হলো, অভ্যুত্থানের পর সংবাদপত্রগুলো এখনো সেই ভয়ের বাতাবরণ থেকে বের হতে পারেনি। এই ভয় কাটিয়ে যারা সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে চান, লিখতে চান, তাদের লেখাগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাতায় ভালো মানের লেখার ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। লেখক যাতে নিরাপত্তা পান, সেই ব্যবস্থা-কাঠামো তৈরি করতে হবে।
এ বিষয়ে আইনজীবী মানজুর-আল-মতিনের ভাষ্য, গণমাধ্যমের মালিকানা নিয়ে একটা বড় সমস্যা এখনো থেকে গেছে। এক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যেমন ভিন্ন চিন্তা ও তৎপরতা দেখা গেছে তেমন গণমাধ্যম নিয়েও ভিন্ন চিন্তা হতে পারে কিনা, ট্রাস্টি বোর্ড হতে পারে কিনা, সেটা ভেবে দেখার পক্ষে মত দেন তিনি।
সাংবাদিক ও কলাম লেখক আমীন আল রশীদের অভিমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সাংবিধানিকভাবে কিংবা আইনি নিরাপত্তার বিষয়টি একরকম। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যক্তি হিসেবে আরেকজন ব্যক্তির মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ওই জায়গাটিতে এখনো একটা বড় ঘাটতি থেকে গেছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর মত ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবটাকেও সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক জুনান নাশিত বলেন, 'গত ১৬ বছরে আমরা মুখ খুলতে পারিনি। যে দমন-পীড়নের মধ্যে আমরা ছিলাম, যে মানসিক বৈরিতা আমাদের মধ্যে কাজ করেছে, যে দমবন্ধ অবস্থা কাজ করেছে, সেখান থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। এই অচলায়তন ভাঙার দায়িত্ব শুরু সরকারের না। আমাদের সবার।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, 'আমার বিবেচনায় আমাদের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধান তাৎপর্যের বিষয়টি হলো—একটা রাস্তায় এজমালি ভাষার মধ্যে বিচিত্র মত-পথ ও মতাদের্শর মানুষ কীভাবে নিজেদের মত-পথ ও মতাদর্শ অক্ষুন্ন রেখে একসঙ্গে কাজ করতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ তৈরি করেছে এই গণঅভ্যুত্থান এবং সম্ভাবনাও তৈরি করেছে।'
প্রকাশনা সংস্থা দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন প্রশ্ন রাখেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা আমরা আমাদের পারিবারিক পরিসরে কতটুকু করতে পেরেছি, প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে কতটুকু পেরেছি? সমাজে ঐক্যের জায়গায় কতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি?'
মাহরুখ মহিউদ্দিনের ভাষ্য, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য এই সমন্বয়টা হচ্ছে না। এর কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।
আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন বলেন, 'ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের ডিএনএর ভেতর ঢুকে আছে। এখান থেকে বের হতে হবে। নতুন চিন্তা করতে হবে।
কবি ও গবেষক কাজল রশীদ শাহীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সামাজিক পরিসরের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। বলেন, এটার জন্য ব্যক্তির দায় ও দরদ থাকতে হবে।
সাংবাদিক, গল্পকার, অনুবাদক মশিউল আলমের পর্যবেক্ষণ হলো, 'আমাদের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা আছে যে আমরা চাই এমবেডেড জার্নালিজম করা হোক। নিউট্রাল সাংবাদিকতা করা যাবে না। নিউট্রাল করলেই তা স্বৈরাচারের দোসর হয়ে যাবে। এই চিন্তা থেকে বের হতে হবে।'
এছাড়া এখানকার সংস্কৃতিকে পরমত অসহিষ্ণু কালচার হিসেবেও অভিহিত করেন মশিউল। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ দেন। কথা বলেন সাংবাদিকতায় আইনি সুরক্ষার বিষয়েও।
অনুবাদক সাখাওয়াত টিপু বলেন, 'আমরা একটা মুক্তাঞ্চল চাই যেখানে প্রত্যেক মানুষ সামাজিক ও মৌলিক অধিকারের কথা বলবে সহিঞ্চু উপায়ে। অন্যের জায়গা খর্ব না করে। যেন আমরা একটা বিকশমান সমাজ দেখতে পাই।'
গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী মনে করেন, বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে ন্যায়সংগত বিধিনিষেধ থাকতে পারে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় যান তারা আইন, সংবিধানকে হাতের খেলনা বানিয়ে ফেলেন। আর এই দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্যতম বাধা হলো বিচারবিভাগ।
আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন—কবি শামস আরেফিন, অধ্যাপক শাকির সবুর, সাংবাদিক আবিদ আজম, জুবায়ের ইবনে কামাল ও ইয়াসির আরাফাত, অধ্যাপক খোরশেদ আলম, গবেষক সিলমি সাদিয়া, সাংবাদিক মাশরুর শাকিল এবং ইমরান মাহফুজ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্তরায় আমরা নিজেরাও। যখন আমরা ক্ষমতার বাইরে থাকি, তখন মতপ্রকাশ নিয়ে আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষা, অনেক দাবি থাকে। কিন্তু যখন আমরা ক্ষমতায় যাই তখন আমরা আগের সেই আকাঙ্ক্ষাকে ধরে রাখতে পারি না।'
মাহফুজ আনাম মনে করেন, সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা নিশ্চিতে কীভাবে এটাকে আইনি রূপ দেওয়া যায়, সাংগঠনিক রূপ দেওয়া যায়, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
ডেইলি স্টার সম্পাদক এটাও মনে করেন যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে পরমতসহিষ্ণুতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান। তিনি বলেন, 'মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য আমাদের শ্রেষ্ঠ আইন আছে, সংবিধান আছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে হিউম্যান এজেন্সির প্রয়োজন, তা নেই।'
Comments