বিশেষ নিবন্ধ

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: কতটা সম্মানের, কতটা পেলেন

একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, একজন চে, একজন গৌতম বুদ্ধ। তিন সময়ের তিনজন মানুষ। যাদের ভূগোল ও ভগবান এক ছিল না। কিন্তু কর্মগুণে, জীবনের অভীপ্সায়, বৃহত্তর মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির দিশায়  অভিন্ন বৈশিষ্ট্যর অধিকারী ছিলেন। যে বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা চে-র কাছে ধার নিয়ে বলতে পারি, 'হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিয়েম্প্রে'-বিজয় না পর্যন্ত লড়াই কর। একজন গৌতম, একজন চে, একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই সত্যে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত রেখেছিলেন প্রবল প্রতীতি। 

কথা ও কাজে জারি রেখেছিলেন মহাজাগতিক সত্য অন্বেষণের এক ধারাপাত। এ কারণেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যু হয় নিজের প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই। সত্য ও বাস্তবতা উনাদের কাছে নিজের ও অপরের জন্য দ্বৈতরূপে নাজিল হয় না। উনারা স্মরিত হন দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। এটা কালের ধর্ম, যুগের দাবি। প্রয়োজনেই সে তার মহৎ সন্তানদের কীর্তিকে অক্ষয় ও অমর করে রাখেন। এ যেন, 'রাজা প্রজারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান।'

এ সত্যের বাইরের আরেক সত্য হল, মহৎ মানুষেরা বেঁচে থাকেন তার অনুসারীদের মধ্যে-তাদের দেখানো পথে ও কর্মতৎপরতায়। যেমনভাবে বেঁচে রয়েছেন একজন গৌতম বুদ্ধ, আড়াই হাজারেরও বেশি সময় ধরে। সময়ের পরিক্রমায় অনুসারীদের যুগ পরিবর্তিত হয়েছে, কিংবা লুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ভুগছে। এখন অনুসারীদের জায়গা করে নিয়েছে সংবাদপত্র-গণমাধ্যম। গণমাধ্যম যাকে যেমনভাবে উপস্থাপন করেন তিনি তেমনভাবেই স্মরিত হন, বৃহত্তর মানুষের হৃদয়ে তার প্রকাশ ঘটে সেভাবেই। বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট থাকার পরও গণমাধ্যমে একজন রামকৃষ্ণকে, একজন বিবেকানন্দকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তিনি সেভাবেই মূর্ত হন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝারে।

 একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও সেই সত্য জারি থাকবে এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। কিন্তু উনি যে মাপের চরিত্র ও স্বাধীন বাংলাদেশে ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের গণমাধ্যম কি উনাকে সেভাবে হাজির করলেন উনার মৃত্যুতে, শেষ বিদায়ের ক্ষণে? এই সময় রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা হচ্ছে নানাভাবে। সরবে, ইশারায়, ইংগিতে এসব নিয়ে চর্যা হচ্ছে সর্বত্রই। একটা সমাজ-রাষ্ট্র যখন রুচির দুর্ভিক্ষে ভোগে তো যেন মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বা গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা আরও বেশি করে প্রতিভাত হল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে।

চে'র মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, 'এক রূপকথার বিদায়'। এই শিরোনামের মধ্যে দিয়ে পত্রিকাটি পবিত্র এক সত্যই উচ্চারণ করেছিল সেদিন। চে' সত্যিই বৈশ্বিক এক মিথ। সেই মিথ জন্মে দিয়েছে এমন এক রূপকথার, যে রূপকথা কোনো দেশ-অঞ্চল কিংবা মহাদেশের বৃত্তে আবদ্ধ থাকার নয়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল, যে চে-কে নির্মমভাবে খুন করা হল, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র প্রত্যক্ষ মদতে এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। সেই মার্কিন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকাতেই চে-র মৃত্যুসংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, 'এক রূপকথার বিদায়' বলে। সংবাদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা এখানেই। তার সাহসের বলিহারির প্রকাশিত হয়ে এভাবেই। কিন্তু একজন জাফরুল্লাহর ক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যম কি তেমন কিছু করলেন?
 
গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রয়াণে প্রথম পাতায় দ্য ডেইলি স্টার লিখেছে: 'People's doctor no more' – এ শিরোনামে তাকে খাটো করা হয়েছে। মানবজমিন লিখেছে: 'বিবেকের কণ্ঠস্বরের বিদায়' – হ্যাঁ, এটি তাঁর অন্যতম পরিচয়। ইত্তেফাক আর কী লিখবে? লিখেছে, 'ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই।' কালের কণ্ঠ লিখেছে, 'সবাক জীবন ছেড়ে নির্বাক জগতে।' সমকালে বিজন কুমার শীল লিখেছেন, 'এক জীবনে বহু জীবনের সমান যিনি।' ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মানবতাবাদী সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক, বাঙ্গালি জাতীর সূর্যসন্তান।' সন্দেহ নেই: একজন মানুষকে বোঝা ও সংক্ষেপে ধারণ করা কঠিন কাজ।''

এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি, দৈনিক যুগান্তর জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর শিরোনাম করেছে সিঙ্গেল কলামে এবং তাও সেটা ভাঁজের নীচে। দৈনিক দেশ রূপান্তর করেছে প্রথম পাতাতে ডান সাইডে-বেশীরভাগ পত্রিকা যেখানটাই করেছে। তাদের শিরোনাম ছিল, 'দূর গগণে গণবন্ধু'। প্রশ্ন হল জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি এরকম ট্রিটমেন্ট পাওয়ার মতো ব্যক্তি ছিলেন? উনার জীবন ও কর্মের অর্জন কি তাহলে লিড হওয়ার মতো নয়? এমনকি যে পত্রিকাটা উনাকে নিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে বিশেষ সম্মাননা জানাল, তারাও লিড করার প্রয়োজনবোধ করলেন না? একেবারে গতানুগতিক, দায়সারা ট্রিটমেন্ট দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের শেষ খবরটি করার মধ্যে দিয়ে উনারা নিজেদের দেয়া সম্মাননাকেই কি খাটো করলেন? আমাদের সংবাদপত্রের গুণীজনরা কি এসব নিয়ে ভাবার সময় পাবেন? 

জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি লিড হওয়ার মতো কীর্তিমান ব্যক্তি ছিলেন না? উনাকে নিয়ে সম্পাদকীয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ব্যক্তির তরফে অনেক লেখা এসেছে। তাই বলে প্রতিষ্ঠানের তরফে কোন শ্রদ্ধাঞ্জলি, মূল্যায়ন থাকবে না? প্রতিষ্ঠানের শক্তিকে ভুলে গিয়ে প্রতিষ্ঠান নির্মাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে প্রকৃত সম্মান জানানো কি আদৌ সম্ভব?

মনে রাখা প্রয়োজন, সেদিনের ভারতের গৌতম বুদ্ধ যা করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ষাটের দশকের ল্যাটিন আমেরিকায় একজন চে যা করেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেই কাজটিই করার চেষ্টা করে গেছেন। যার নাম হৃদয়বৃত্তির উন্মীলন আর মানুষের জন্য অবারিত ভালবাসা। আপনার মধ্যে অপরকে ধারণ করার সাধনা। যার নাম ত্যাগ। যার নাম কল্যাণব্রত। অন্যদের মাঝে এসব নিয়ে চাপানউতোর থাকতে পারে। মত-দ্বিমতও হতে পারে।

৯০ দশকে একজন কর্মবীর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

জাফরুল্লাহর কাছে এর নাম মানুষের জন্য পক্ষপাত। যে পক্ষপাতের জন্য গৌতমবুদ্ধ রাজপ্রাসাদ ছেড়েছিলেন। চে ছেড়েছিলেন কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো সরকারের মন্ত্রীত্ব। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছেড়েছিলেন ব্রিটিশরাজপুত্র বর্তমানের রাজা তৃতীয় চার্লসের মতো বিলাসী জীবনের হাতছানি।

চে জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনায়। পড়েছিলেন চিকিৎসাবিদ্যা, পেশায় ছিলেন ডাক্তার। পছন্দ করতেন কবিতা-লিখতেন নিজেও। নেশা ছিল ভ্রমণের। অনুরাগ ছিল দাবা, ফুটবল ও রাগবি খেলার প্রতি। ১৯৬১ সালে হন কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো সরকারের শিল্পমন্ত্রী। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেয়া চে হলেন কিউবার রাষ্ট্রদূত হয়ে ঘোরেন বিভিন্ন দেশ। তারও আগে জড়িয়ে পড়েছিলেন গুয়েতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে-সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রতীতি থেকে। এর পর ফিদেল কাস্ত্রোর সংস্পর্শে এসে জড়িয়ে যান কিউবার বিপ্লবী আন্দোলনে। সহযোদ্ধা হন ফিদেল-রাহুলের। দেশটির অত্যাচারী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে দুইবছর ধরে সংগ্রামের পর পতন হয় সেই সরকারের। গঠিত হয় ফিদেল কাস্ত্রোর সরকার। কিন্তু সেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদেও থিতু হন না। ১৯৬৫ সালে সব ছেড়েছুড়ে কিউবা ছাড়েন তিনি। বিপ্লব সংগঠনের উদ্দেশে চলে যান লাতিন আমেরিকা থেকে আরেক মহাদেশ আফ্রিকায়। দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মুক্তি ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লব বিস্তারের স্বপ্ন দেখেন কঙ্গোয়। সেখান থেকে চলে যান বলিভিয়ায়। ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার সেনার হাতে বন্দী হয় তিনি। সিআইএ-র মদদে সেনারা তাকে হত্যা করে ওই বছরের ৯ অক্টোবর।

চে সেই রূপকথার নায়ক, যে রূপকথা কল্পলোকের নয়, বাস্তবের। রূপকথায় রাজ্য ছিল, রাণী ছিল, রাজকুমার ছিল, রাজকুমারী ছিল আর ছিল ক্ষমতা। কিন্তু এসবের সবকিছুই ছেড়েছিলেন তিনি। যার উদাহরণ পৃথিবীর জ্ঞাত ইতিহাসে রয়েছে শুধুমাত্র একজনের। তিনি হলেন মহামতি বুদ্ধ ওরফে রাজকুমার সিদ্ধার্থ। যিনি মানুষের দুঃখ কষ্ট কীভাবে লাঘব করা যায়, মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ কীভাবে অন্বেষণ করা যায়, সেইলক্ষ্যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে বেছে নিয়েছিলেন সন্ন্যাসের পথ, ধ্যান সাধনায় বসেছিলেন বোধবৃক্ষে।

মহামতি গৌতম বুদ্ধ'র আড়াই হাজার বছর পর বুদ্ধ'র মতো চে-ও সবকিছু ছেড়েছুড়ে বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। দু'জনেরই লক্ষ্য ছিল এক, উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন, চাওয়া ছিল মানুষের মুক্তি ও দুঃখ দুর্দশা অপনোদন। বুদ্ধ'র সময়ের পথ ও পন্থা ছিল সন্ন্যাস গ্রহণ ও ধ্যানে নিমগ্ন হওয়া। চে'র সময়ের পথ হলো বিপ্লব। বুদ্ধ যদি জন্মাতেন চে'র সময়ে আর চে' যদি হতেন বুদ্ধ'র সময়ের মানুষ, তাহলে উনারা হাঁটতেন ওই পথেই।

বুদ্ধ ছেড়ে এসেছিলেন প্রাণপ্রিয় সন্তান রাহুলকে। চে ছেড়ে এসেছিলেন আলেইদাকে। উনাদের কাছে মানুষের মুক্তি-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এতোটাই প্রধান ও গুরুত্ববহ ছিল যে, তার জন্য প্রিয়তমার কোমলবাহু, আত্মজের জন্য এক পৃথিবীর মায়া এবং ক্ষমতার দম্ভ-লোভ লালসা এবং সকলকিছু প্রাপ্তির সকল নিশ্চয়তাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করতে কোনো দ্বিধা কিংবা সংশয় কাজ করেনি।

রাজকুমার সিদ্ধার্থ, মন্ত্রী চে-র পর আমরা একজন জাফরুল্লাহকে পাই। যিনি চে-র মতো ডাক্তার ছিলেন। চে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ভোগবিলাসের জীবন, মন্ত্রীত্বের অমৃতমোহন পদ। যার জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে সবাই থাকেন মুখিয়ে। জাফরউল্লাহ চৌধুরীও ছেড়ে এসেছিলেন বিলাসী জীবনের সব উপকরণ। মধ্য ষাটের দশকে ইংল্যান্ডে তিনি যে জীবন যাপন করতেন, তা যে কোন রূপকথাকে হার মানায়। বাঙালি এক যুবক ডাক্তারি পড়ছেন বিদেশি-বিভূঁইয়ে। যাপন করছেন সেদেশের অতি উচ্চবিত্ত সমাজের নাগরিক জীবন নয়, দেশটির রাজপুত্ররা যে বিলাস উপভোগ করেন তার সমান্তরাল এক জীবন। ব্যবহার করতেন রোলস রয়েস ব্রান্ডের সেরা গাড়িটি। যে দর্জি চার্লসের পোশাক বানাতেন, উনার পোশাকও তিনিই বানিয়ে দিতেন। সেই জীবন তিনি ছেড়ে এসেছিলেন স্বেচ্ছায়, দেশপ্রেম থেকে, দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে। জীবনের ঝুঁকি ছিল রণাঙ্গনে যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু সবই থোড়াই কেয়ার করেছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ হাসপাতাল। তাৎক্ষণিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই হাসপাতালের জন্য ডাক্তার তৈরি করেছেন, যারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় রেখেছেন অনন্য এক ভূমিকা। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে প্রশংসিত হয়েছে সকল মহল ও সর্বজন কর্তৃক। 

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ইচ্ছে ছিল ও পরিকল্পনাও করেছিলেন সেই মোতাবেক যুদ্ধ শেষে আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যাবেন। কিন্তু শেষাবধি আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কেননা ততদিনে দেশের মানুষের সঙ্গে উনার তৈরি হয়ে গেছে অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন। উনার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নায়ক সূর্যসেনের সরাসরি ছাত্র। সেই সূর্যসেন যিনি ব্রিটিশের রক্তচক্ষু ও দানবীয় শক্তিকে উপেক্ষা করে কয়েকদিন চট্টগ্রাম স্বাধীন রেখেছিলেন। সেদিন যদি সূর্যসেনের সেই বিজয় স্থায়ী হতো তাহলে হয়তো ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার কেবল নয় নতুন করে লেখা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সেটা হয়নি। জীবন দিয়ে সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম স্বাধীন করার, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই জারি রাখার, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী হওয়ার মাশুল দিতে হয়েছে নিজের ও সহযোগিদের জীবন উৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে। 

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাবার কাছে শুনেছেন সূর্যসেনের গল্প, যিনি ছিলেন বাবার সরাসরি শিক্ষক। সেদিনই কি পণ করেছিলেন দেশের জন্য, দেশবাসীর মুক্তির জন্য, মানুষের পাশে থাকবেন সর্বাবস্থায়। আমাদের জানা নেই সেটা। মহৎ মানুষের পণ কখন কীভাবে হয়েছে সেটা দেখাটা জরুরি নয়, জরুরি হল তাদের কাজের মধ্যে মহত্ব কীভাবে জারি রয়েছে সেটা অনুসন্ধান করা। পণ নয়, তাদের কাজই তাদের করে তোলে মহৎ ও মহীয়ান।

যেমনটা আমরা দেখি মহামতি গৌতম বুদ্ধের কাজের মধ্যে। দেখি চে-র জীবন ও কর্মের পরিভ্রমণে। দেখি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একজীবনের সাধনা, ত্যাগ ও কর্মনিষ্ঠায়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ইচ্ছে ছিল মরদেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের কল্যাণার্থে দান করে দেয়ার। সেই অনুযায়ী সব প্রক্রিয়াও সম্ভবত এগিয়ে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষাবধি সেটা করা সম্ভব হয়নি। কারণটা জানিয়েছেন পুত্র বারিশ চৌধুরী। ঢাকা মেডিকেল ও গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের কোন চিকিৎসকই উনার মরদেহ কাটাছেঁড়া করতে সম্মতি হয়নি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাবশত উনারা এ কাজে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। সঙ্গত কারণেই পারিবারিক সিদ্ধান্তে উনাকে সাভারের গণস্বাস্থ্য প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকথার এক চরিত্র নয় কেবল, নায়ক বিশেষ। উনাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। এবং প্রতিটি গল্পই যেন এক একটা রূপকথা বিশেষ। একটা মানুষের জীবন এতটা রূপকথার চরিত্র হয়ে উঠতে পারে তা বোধ করি আমরা যদি আমাদের কালে একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেখা না পেতাম, সেটা কখনোই বিশ্বাস করতাম না। এখন এই রূপকথাসম চরিত্র জাফরুল্লাহর জীবন ও কর্মের দিকে যদি একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করা যায় তাহলে দেখব উনার মানুষের প্রতি সহজাত এক দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতার মর্মমূলে ছিল মানুষকে হৃদয়বৃত্তি দিয়ে ভালবাসার। মানুষের প্রত্যেকটা সমস্যাকে অন্যের বা অপরের চোখ দিয়ে না দেখে আপনার হৃদয় দিয়ে অনুভব করার। 

জাফরুল্লাহ চৌধুরী সমস্যাকে কেবল দর্শক হিসেবে দেখেননি। যথাসম্ভব প্রতিটি সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। সমস্যা দূর করতে কী করার সেটা নিয়ে ভাবিত হয়েছেন। উনার পক্ষে সম্ভবপর হলে সেটা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমাদের সমাজ রাষ্ট্রের বেশীরভাগ মানুষের স্বভাবজ বৈশিষ্ট্য যখন উটের সেখানে তিনি সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবল বিরোধী ছিলেন। এবং সেটা কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করে গেছেন। উনি মনে করতেন সমস্যার সমাধানের মধ্যে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মূল সূত্র লুকায়িত রয়েছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সক্রিয় রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। কিন্তু নানান কারণেই রাজনীতির বৃহত্তর পাটাতনের সঙ্গে ছিল অবাধ গতায়াত। এবং এর পেছনেও ছিল ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অভীপ্সা। উনি প্রশ্ন করতে ভালবাসতেন। কারণ উনি কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন।

 সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতেন। সামাজিক শক্তির বিকাশ কায়মনে জারি রাখতেন। প্রাতিষ্ঠানিকতার চর্চায় ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তায় আস্থাবান ছিলেন। উনি বিশ্বাস করতেন এসবের সঙ্গে প্রশ্নের শক্তি গভীরভাবে যুক্ত রয়েছে। গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সামাজিক সাম্য ও ন্যায় বিচার তখনই নিশ্চিত হবে যখন রাষ্ট্র ও সমাজে প্রশ্নের শক্তি জাগরুক থাকবে এবং সদা চর্চিত হবে। এই প্রতীতি থেকেই তিনি অম্ল হলেও প্রশ্ন করতে কখনও সংশয়িত হননি।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজের জীবদ্দশায় মিথ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এটাও তার শক্তির পরিচয়। উনি ম্যাগসাইসহ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। আড়ালের মানুষ ছিলেন না কখনোই। কিন্তু উনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া মিথগুলো আড়ালের মানুষের মিথকেও হার মানিয়েছে। এটাও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শক্তি বলে আমরা মনে করি। উনি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উনার প্রতিষ্ঠানে যতোটা সম্ভব নারী বান্ধব পরিবেশ যেমন নিশ্চিত করেছেন তেমনি নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন। যখন নারী ড্রাইভারের হদিশ পাওয়া ছিল রীতিমত দুরূহ ও অত্যাশ্চর্য একটা কাজ, তখন তিনি নারী ড্রাইভার রেখেছেন। ব্যবহার করতেন পুরনো দিনের একটা গাড়ি। ড্রাইভার সেই গাড়ি পুরনো হয়ে গেছে জানালে, তিনি বলেছিলেন, তুমিও তো পুরনো হয়ে গেছো, তোমাকে বদলে দিই। এরকম হাজারও গল্প রয়েছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ঘিরে। 

উনার ব্যবহার করা একটা শার্টের বয়স ছিল প্রায় ত্রিশ বছর। বাতিল করার কথা বললে বলেছিলেন, ছেঁড়া নাইতো বাতিল করে দিব? এসব উনার অহংকার বা বাড়াবাড়ি নয়। এসবটাই প্রেম। যে প্রেম সবাইকে নিয়ে সবার সাথে থাকতে পছন্দ করে। কোনকিছু বাতিল বা ছেড়ে দিতে নয়।

উনি রিপু একটা প্যান্ট পরতেন। সেটাও বাতিল করেননি। রিপুর প্রসঙ্গে রিপুযুক্ত স্থানে হাত বুলিয়ে বলেছেন, ভালইতো আছে। রিপু করে চলছে তো, ওকে ফেলে দেব কেন? একটা মানুষ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপারে যেমন ভাবছেন তেমনি ছোটখাটো কোনকিছুই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। একেই বলে বড়র ধর্ম। বড়তো সেই যে বা যিনি সব ব্যাপারে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ততটুকু করেন। বড়তো আকারে প্রকারে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে উনার হৃদয়ের ব্যাপ্তির ওপর। উনি হৃদয় দিয়ে কতোটা ধারণ করতে পারেন তার ওপরই নির্ভর করে বড়'র শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ব।

বলা হচ্ছে উনি একজীবনে কয়েকজীবনের কাজ করে গেছেন। উনি দেশের যোদ্ধা সকলের বন্ধু। উনি গরীবের ডাক্তার। উনি সংশপ্তক। উনি গণবন্ধু। উনি একটা মিথ। একটা রূপকথার চরিত্র। এর কোনটাতেই সত্যের অপলাপ নেই। বাড়িয়ে বলার চেষ্টাও নেই। কিন্তু কেবলই এসব নয়, এসবেরও অধিক কিছু।

বাংলাদেশের চিকিৎসাখাতে উনি যে অবদান রেখে গেছেন তা কখনো ভোলার নয়। আমাদের ওষুধ শিল্পের আজ যে অর্জন, সমৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাববিস্তারি ভূমিকা, এর পুরোভাগে রয়েছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান। জাতীয় চিকিৎসা নীতি প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন করে তিনি এ খাতের ভেতরগত চারিত্র্যকাঠামোই পাল্টে দিয়েছেন। এবং এটা বাস্তবায়নে উনার লড়াইয়ের গল্প পাঠ করতে করতে আমরা কেবল বিস্ময়, রোমাঞ্চ ও গৌরববোধ করি না, করোটিতে চে-র গল্পের উপস্থিতিও টের পাই।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের গল্পটা যেন মহাকাব্যের গল্পের মতন। তার কত বাঁক, কত রঙ, কত ঢেউ, কত স্বপ্ন; সেসবের কয়টার হদিশইবা আমরা জানি? করোনার দিনগুলোতে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা কি কোন রূপকথার গল্পে আদৌ মিলবে? উনার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতাল নিজেই একটা প্রতিবাদ। ওষুধ শিল্পের অরাজকতার বিরুদ্ধে মস্তোবড়ো এক প্রশ্ন। যে ওষুধ বাজারে বিক্রি হয় ৬০০ টাকায় সেটা তিনি গণস্বাস্থ্যে উৎপাদন করে ৪০টাকায় বিক্রির ব্যবস্থা করেন। তারপরও ১০টাকা লাভ থাকে বলে জানান। আমাদের দেশের ওষুধ ব্যবসায়ীরা তাহলে কি করেন নতুন করে নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যারা শাসক ও প্রশাসকবর্গরূপে ওই যন্ত্রটার নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু সেই যন্ত্র যথার্থভাবে কাজ করে না বলেই একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এক জীবনে অনেক জীবনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। 

যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে এত গল্প, এত কথা; অথচ সেই নায়কের বিদায়ে গণমাধ্যম কী করলো? লিড নেই, বিশেষ সম্পাদকীয় নেই, নেই বিশেষ আয়োজন। তাহলে মানুষ কীভাবে জানবে তিনি যে অসাধারণ একজন মানুষের কথা,যিনি আমাদের কালের নায়ক ছিলেন। যিনি সাধারণে অসাধারণ ছিলেন। যিনি প্রকৃতার্থে একজন মহীরুহ ছিলেন। অথচ সময়ে সবচেয়ে বড়ো মানুষটিকে আমাদের সংবাদপত্র বিদায় জানাল যেভাবে তাকে কি বলা যেতে পারে?

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago