বিড়িশ্রমিক: কারখানার ‘জ্যান্ত জাহান্নামে’ যক্ষ্মার সঙ্গে বসবাস
বরিশালের কাশিপুর এলাকার একটি কারখানায় কয়েক দশক ধরে হাতে বিড়ি তৈরি করছেন ডালিয়া বেগম (৬৫)।
ডালিয়ার প্রয়াত স্বামী জালাল হাওলাদারও একই পেশায় ছিলেন। কয়েক বছর আগে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয় তার।
ইদানীং ডালিয়ার প্রায়ই জ্বর জ্বর অনুভূত হয়। তার ছেলে পাশের দোকান থেকে ওষুধ এনে দেন। 'আমার স্বামী যক্ষ্মায় মারা গিয়েছিলেন। এখন আমিও অসুস্থ বোধ করছি,' বলেন তিনি।
ডালিয়া বলেন, 'আমাদের দিন এনে দিন খাওয়া। তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে পারি না। ডাক্তার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের জন্য বিলাসিতা।'
ডালিয়ার এই গল্প আলাদা কিছু নয়; বরিশালের বিড়ি কারখানাগুলোতে তার মতো এমন অনেক শ্রমিক দেখা যায়।
আরেক বিড়িশ্রমিক শ্রমিক রহিমা বেগম তার ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে কারখানায় এসেছেন। কয়েক মাস ধরে তার কাশির সঙ্গে রক্ত আসছে। তিনি বলেন, 'জানি না আমার কী হচ্ছে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছি।'
৪৫ বছরের বেশি সময় আগে বরিশাল বিভাগ হাতে তৈরি বিড়ি উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বরিশাল শহরে তিনটি কারখানা এবং ঝালকাঠি জেলায় আরও চারটি বিড়ির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করেন।
গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও এসব কারখানায় নেই কোনো নজরদারি। মালিকপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার নজিরও খুব কম।
সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে ডেইলি স্টার বরিশালে বিড়ি কারখানার একাধিক শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
কারখানার ভেতরে 'জ্যান্ত জাহান্নাম'
সংকীর্ণ জায়গা, তামাকের ভ্যাপসা দুর্গন্ধ, বড়দের সঙ্গে কাজ করছে শিশুরাও, কেউ না কেউ সব সময় কাশছে। কারখানার ভেতরে তাকালেই চোখে পগে ক্ষমাহীন পরিবেশ। মৌলিক সুবিধা যেখানে দুঃস্বপ্ন।
এর আগের পর্বে ডেইলি স্টার তুলে ধরেছে কারখানার ভেতরে শিশুরা কীভাবে বঞ্চনার শিকার হয়। তবে নারী বা পুরুষের জন্য কারখানার ভেতরে কাজ করা সহজ—ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়।
বরিশাল বিভাগের সাতটি বিড়ি কারখানার মধ্যে প্রাচীনতম কারিকর বিড়ি। ঐতিহ্য ধরে রেখে শ্রমিকরা হাতে তৈরি করেন।
সাধুর বটতলা এলাকায় তাদের একটি শাখা কারখানায় ঢুকতেই তামাকের তীব্র দুর্গন্ধ নাকে আসে। যেখানে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আবছা আলোয় শতাধিক শ্রমিক, যাদের বেশির ভাগই নারী, হাতে বিড়ির শলাকায় তামাক ভরছেন আর গোছাচ্ছেন। স্বল্প বিরতিতে নিস্তব্ধতা ভেদ করে অবিরাম কাশির শব্দ।
এই ১০ হাজার বর্গফুট জায়গায় বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা খুবই সামান্য: চারটি ছোট জানালা, আর একটিমাত্র দরজা। বাতাস আসার এই পথ। ফলে সংকীর্ণ কারখানা স্যাঁতসেঁতে এবং অন্ধকার। বাইরে থেকে আলো আসে খুবই সামান্য। বৈদ্যুতিক বাল্বগুলোর আলোও অপর্যাপ্ত।
একই রকম উদ্বেগজনক অবস্থা শৌচাগারের। দুটি শৌচাগারের মধ্যে কোনোটিই ব্যবহার উপযোগী না। পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অস্বাস্থ্যকর ও অপরিষ্কার। বাইরে একটি টিউবওয়েলের জীর্ণ দশা। ফলে শ্রমিকদের আরও অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।
এই শাখায় প্রায় ৫৩২ জন স্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন। তাদের প্রত্যেককে সপ্তাহে ১৬ থেকে ৩২ হাজার বিড়ি শলাকা তৈরি করতে হয়। হাতে তৈরি বিড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ শ্রমিক তিন দিনে তাদের কাজ শেষ করে ফেলেন। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে কারখানায় কোনো কাজ থাকে না।
বিশেষজ্ঞদের বলছেন, মাস্ক ও গ্লাভস সরবরাহ করা হলে শ্রমিক ও তাদের শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে।
তবে কোনো কারখানায় এ রকম সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার দেখা যায়নি।
শোষণের শেষ নেই
বিড়ি শিল্পে কারখানার মালিক, স্থায়ী শ্রমিক এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের আয় বৈষম্য অকল্পনীয়।
প্রতিতে ২৫টি করে ৪০টি প্যাকেটে মোট এক হাজার বিড়ির শলাকা কারখানা মালিক প্রায় ৮০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করেন।
স্থায়ী শ্রমিকরা এক হাজার শলাকার জন্য পান মাত্র ৯০ টাকা। বিড়ির প্যাকেট যখন ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায়, তখন প্রতি প্যাকেটের খুচরা মূল্য দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৪ টাকা।
বিড়ি তৈরির কাজ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। প্রবীণদের প্রতি সপ্তাহে ৩২ হাজার শলাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন লক্ষ্য দেওয়া হয়। বেশি আয়ের আশায় এই 'স্থায়ী' শ্রমিকরা তাদের বেশির ভাগ কাজ স্থানীয় নারী ও শিশুদের দিয়ে করিয়ে নেয়। বাড়তি টাকায় আশায় তাদের কেউ কেউ রিকশা চালান কিংবা স্থানীয় চায়ের দোকানে কাজ করেন।
চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা প্রতি এক হাজার বিড়ি তৈরি করে পান মাত্র ৩৫ টাকা এবং স্থায়ী শ্রমিকদের পকেটে ওঠে ৫৫ টাকা।
প্রক্রিয়াটি তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত: বিড়ি শলাকা একত্রিত করা, তামাক ভরা এবং মোড়কজাত করা। চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা বিড়ি রোল করার জন্য পান মাত্র ১৬ টাকা, তামাক ভরার জন্য তিন টাকা এবং প্যাকেজিংয়ের জন্য আরও ১৬ টাকা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এই স্বল্প মজুরি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কারিকর বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ।
তিনি বলেন, 'দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, কিন্তু আমাদের মজুরি বাড়ছে না। আমরা অনেকেই নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করতাম, যদি মাসে পাঁচ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হতো।'
দুষ্টচক্র
বরিশালের বিড়ি কারখানাগুলোতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, মা, মেয়ে, দাদি কিংবা নানি—নামমাত্র মজুরির জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়ে দেন। বহু প্রজন্মের পরিশ্রমের এই গল্পগুলো যে বিষণ্ন বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে: দারিদ্র্যের চক্র যুগের পর যুগ পুরো পরিবারকে ধোঁয়ায় আটকে রাখে।
এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে আমরা ১৯ বছর বয়সী ফাতেমা আক্তারের গল্প বলেছি। ১৩ মাস বয়সী ছেলেকে কোলে নিয়ে দীর্ঘ সময় কারখানায় কাজ করেন তিনি। তার মা—মিনারা বেগমের হাত ধরে এই পেশায় এসেছিলেন ফাতেমা। মিনারা বেগমের বয়স এখন ৪০ বছর। এখনো তিনি এখানে কাজ করেন। দিন দিন তার শরীর ভেঙে পড়ছে।
'মাঝে মাঝেই আমাকে ইনহেলার নিতে হয় এবং গরমের দিনে আমার শরীর ফুলে যায়,' বলেন মিনারা।
তবে কী কারণ, মিনারা তা জানেন না। দুই থেকে তিন দিন কাজ করতে তার ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয়। যা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। যে কারণে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিতে পারেন না।
মাস্টার্স পাস করেছেন এক সন্তানের মা শিলা হালদার। তার চার বছর বয়সী মেয়েকে পাশে বসিয়ে বিড়ি রোল করছেন, মেয়েটিও ধৈর্য ধরে বসে আছে; যে কাজ একদিন তাকেও করতে হতে পারে।
৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারখানায় কাজ করছেন শীলার মা দিপালী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বুকেব্যথায় ভুগছেন। বিড়ি রোল করতে করতে তিনি বলেন, 'ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য আমার নেই।'
রিনা বেগম (৪০) কাজ করছেন দুই যুগের বেশি সময়। তিনি অ্যালার্জি এবং অ্যাজমায় ভুগছেন। তবে বহু বছর ডাক্তার দেখাননি। রিনা বলেন, 'দিনে পাঁচ হাজার বিড়ি প্যাক করলে আমার আয় হয় ৮০ টাকা।'
কারখানার পাশেই মাসে দুই হাজার টাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি।
১৯৭৫ সাল থেকে বিড়ি কারখানায় কাজ করেন শাহ আলম। তিনি বলেন, 'কারখানায় কাজ শুরুর পর থেকেই আমার কাশির সমস্যা। কিন্তু এই কাজ (বিড়ি রোল) ছাড়া তো আমি আর কিছু পারি না। আর কী করব?'
কারিকর বিড়ির পরিচালক রাহুল দে বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে মালিকপক্ষ বিড়ি বাদ দিয়ে খাদ্য উৎপাদনের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে এতে সময় লাগবে।'
তিনি আরও বলেন, 'নতুন কাজে শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।'
একই চিত্র সবখানে
ফিশারি রোডে কারিকর বিড়ির দ্বিতীয় শাখায় ২৭৫ জন স্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন।
বিষাক্ত পরিবেশের কারণে অনেক শ্রমিক, বিশেষত নারী ও শিশুরা শ্বাসকষ্টে ভুগছে। এ ছাড়া, অন্যান্য আরও শারীরিক জটিলতা আছে।
গত ৩০ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছেন পারুল বেগম (৪০)। দুই বছর আগে একজন চিকিৎসক তাকে ইনহেলার ব্যবহার করতে বলেছিলেন। পাশাপাশি তাকে তামাক কারখানার কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আটকে গেছেন পারুল।
তিন দিনে ১০ হাজার বিড়ি প্যাক করে তিনি পান মাত্র ১৬০ টাকা। এই টাকায় চিকিৎসা করানো খুবই কঠিন।
জাকির শিকদারের বুকে ব্যথা শুরু হওয়ার পর থেকে বিড়ি গোছাতে সাহায্য করছেন তার ২৪ বছর বয়সী মেয়ে সোনালী আক্তার। সোনালী দিনে পাঁচ হাজার শলাকা বিড়ি প্যাক করেন।
জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় ধরে কারখানায় কাজ করছেন ৬৫ বছর বয়সী মাকসুদা বেগম। শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রতিদিন ছয় হাজার শলাকা বিড়ি প্যাক করে তিনি পান ৯৬ টাকা। তার অনেক সহকর্মীর মতো, মাকসুদাও স্থানীয় দোকানের ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
অধিকাংশ বিড়ি শ্রমিক নগরীর পলাশপুর ও কালা খাঁ বস্তিতে বাস করেন। তাদের ঘরগুলো সঙ্কুচিত, জরাজীর্ণ। পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই।
পলাশপুর ১ নম্বর বস্তিতে থাকেন ফিরোজা বেগম (৬৫)। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বিড়ি রোল করা শুরু করেন। দুই হাজার শলাকা তৈরি করলে তার আয় হয় মাত্র ৩২ টাকা।
বস্তির আরেক বাসিন্দা পারুল বেগম সপ্তাহে ২৫ হাজার শলাকা তৈরি করেন। প্রতি হাজার শলাকার জন্য পান মাত্র ১৬ টাকা।
কালা খাঁর বাসিন্দাদের পরিস্থিতিও আলাদা নয়।
রোগশোকের ঘরবসতি
তামাক কারখানার ক্ষতিকর পরিবেশ এবং যক্ষ্মাসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগের ঝুঁকির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষকদের মতে, এই রকম পরিবেশে তামাকের গুঁড়া এবং অস্বাস্থ্যকর বাতাসের মানের কারণে শ্রমিকদের বিশেষত শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং টিবির মতো সংক্রমণের সংবেদনশীলতা বাড়ায়।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বছরে প্রায় দুই হাজার যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা করেন, যাদের ৬০ শতাংশই তামাকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবের শিকার।
ব্র্যাকের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ৭০ শতাংশ মানুষ যক্ষ্মার জীবাণু বহন করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে প্রায়ই এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। তামাকের সংস্পর্শে টিবি সংক্রমণের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
বরিশাল বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওসমান গণি বলেন, 'গত বছর আমরা সচেতনতামূলক সভা করে শ্রমিকদের মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলাম কিন্তু তারা এসব নির্দেশনা মানছেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত বছর বিভিন্ন খাতের প্রায় এক হাজার শ্রমিককে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অথচ বিড়ি শ্রমিকরা তেমন আগ্রহ দেখাননি।'
তবে কারিকর বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদের দাবি, গত ৪০ বছরে শ্রমিকরা কোনো ধরনের সুরক্ষা বা চিকিৎসা সুবিধা পায়নি।
কারিকর বিড়ির পরিচালক রাহুল দে বলেন, 'কারখানাগুলো স্থানীয় ইউনিয়ন শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, কোম্পানি কেবল বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহ করে।'
'তারপরও কোনো অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করি,' যোগ করেন তিনি।
Comments