বন্যায় ভেসে গেছে ৫৭৬ কোটি টাকার মাছ, পথে বসেছেন নোয়াখালীর হাজারো খামারি
বন্যায় নোয়াখালীর আটটি উপজেলা ও সাতটি পৌরসভায় ৮৫ হাজার ৩৭৯টি খামারের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এর ফলে পথে বসেছেন হাজারো মৎস্য খামারি। অনেকে ঋণের অর্থ পরিশোধের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেগমগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার খামারিরা।
মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
মঙ্গলবার বিকেলে জেলার বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর, চাটখিল, সদর ও সোনাইমুড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সদর উপজেলার কাদিরহানিফ ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের নারী উদ্যোক্তা রহিমা আক্তার বেবী ও তার স্বামী মো. সেলিম গত ১৬ বছর ধরে মাছ চাষ করেন। চার মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে বেশ সুখেই চলছিল তার সংসার।
বেবী বলেন, 'জনতা ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। মোট সাত একর জায়গায় ১০টি মাছের খামার ও চারটি পুকুরে মাছ চাষ করেছিলাম। এই ডিসেম্বরে কমপক্ষে এক কোটি টাকার মাছ বিক্রি করতে পারতাম।'
এই মাছ বিক্রি করে ব্যাংক ও এনজিওর ঋণ পরিশোধ এবং মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেছিলেন এই দম্পতি। কিন্তু বন্যায় তার খামার ও পুকুর ভেসে গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বেবী বলেন, 'বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন ভেসে গেছে। এত টাকা ঋণ এখন কীভাবে পরিশোধ করব?'
বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মাছুদুল হক চৌধুরী বলেন, 'আমার আল-বারাকা মাছের খামার ও হ্যাচারি ৬০ একর জমির ওপরে। এখানে কাজ করেন প্রায় ৫০ জন মানুষ। হ্যাচারিতে বিভিন্ন ধরনের মাছের উন্নত মানের পোনা উৎপাদন করি এবং মাছ চাষ করি।'
১৯৮৫ সালে ৩০ শতাংশ জমির ওপর তিনি মাছ চাষ শুরু করেন। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে বর্তমানে তার খামার দাঁড়িয়েছে ৬০ একর জমিতে।
এবারের বন্যায় তার সাত কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে জানিয়ে মাছুদুল বলেন, 'দুটি ব্যাংক থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খামারে পুঁজি লাগিয়েছি। লাখ লাখ টাকার জাল দিয়েও মাছ রক্ষা করতে পারিনি। প্রতি মাসে ব্যাংকের সুদ আসে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। এত টাকা এখন কীভাবে শোধ করব?'
সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরভাটা ইউনিয়নের চর নাঙ্গলিয়া গ্রামের তরুণ সিফাতুল ইসলাম ঢাকার তেজগাঁও কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে চাকরির পেছনে না ঘুরে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বছর দুয়েক আগে নিজ গ্রামে ৪ একর জমিতে মাছের খামার গড়ে তুলেছেন।
নিজের ও স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন সিফাত। আগামী ডিসেম্বরে মাছ বিক্রির মৌসুমে আট লাখ টাকার মাছ বিক্রির লক্ষ্য ছিল তার।
তিনি বলেন, 'আশা ছিল ডিসেম্বরে মাছ বিক্রি করে সবার ঋণ শোধ করব, খামারটা আরও বড় করব। বন্যার সব স্বপ্ন ভেসে গেছে।'
তাদের মতো এমন পরিস্থিতি হাজারো মৎস্য চাষির।
নোয়াখালী সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মানস মণ্ডল জানান, চলমান বন্যায় উপজেলায় ১৫ হাজার ২৯৮টি খামারের ১৮৮ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
চাটখিল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল ইসলাম পাইলট বলেন, উপজেলা নয়টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার ছয় হাজার মৎস্য খামারের ১৮০ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
বেগমগঞ্জ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাসুমা আক্তার বলেন, বেগম উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ১৩ হাজার ৮৯০টি মৎস্য খামারের ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহযোগিতা ও খামার সংস্কার করার জন্য বরাদ্দ চেয়ে অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কবিরহাট উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার বলেন, উপজেলায় ১২ হাজার খামারের নয় কোটি ৫০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
সুবর্ণচর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফয়েজুর রহমান বলেন, আট হাজার ৫৩২টি পুকুর-জলাশয়ের ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বন্যার পানিতে।
সেনবাগ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সাব্বির হোসেন বলেন, সাড়ে পাঁচ হাজার খামার-জলাশয়ের ১০ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। উপজেলার অনেক ইউনিয়নে বন্যার পানি এখনো বেশি থাকায় ওইসব এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
সোনাইমুড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুফি আহম্মদ বলেন, আট হাজার ৬৫০টি খামারের এক কোটি ৭৬ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলাম সরকার বলেন, ১১ হাজার ৬৫৮টি পুকুর ও জলাশয়ের ১৬১ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, 'বন্যায় মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।'
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত খামার ও কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য বরাদ্দ চেয়ে অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
Comments