ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অন্তত ৫৫০ জন এক চোখ, কিংবা দুই চোখই হারিয়েছেন

আমি জানি না কবে আমি আমার নিজের জীবনে ফিরতে পারব। কবে মাঠে খেলতে যেতে পারব, বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে বেড়াব।’
আল আমিন (বামে) ও কাজী ফারুক।

'আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে কেউ একটু সাহায্য করবেন,' জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে চিৎকার করে শুধু এই কথাগুলো বলেছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আল আমিন হাওলাদার।

পুলিশ সেদিন বরিশালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল।

স্কুলছাত্র আল আমিনকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ঢাকার হাসপাতালে তারই মতো শত শত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছিল। যাদের মধ্যে অনেকে জুলাই-আগস্টের এই ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলিতে আংশিক অনেকে পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইওএইচ) পরিচালক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা জানান, শুধু এই হাসপাতালেই আন্দোলনের সময় চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়া সাতশ'র বেশি রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে ৩৬৬ জন এক চোখের এবং ১৭ জন দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।

আল আমিন জানায়, নগরীর হাতেম আলী বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সে। গত ১৭ জুলাই বন্ধুবান্ধব আর স্কুলের সিনিয়রদের সঙ্গে বিক্ষোভে যাই। আগের দিনও গিয়েছিলাম আমরা। ১৭ জুলাই বিকেলে আমরা নথুল্লা রোডের বিক্ষোভে ছিলাম।

'সেদিন আমি আমার সিনিয়র আর সহপাঠীদের সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। নির্বিচারে হামলা করা হচ্ছিল ওদের ওপর। কিন্তু আমি কোনোদিন ভাবি নাই পুলিশ আমাদের দিকে গুলি আর ছররা গুলি চালাবে,' বলছিল ১৪ বছরের এই কিশোর।

সেদিন এই ১৪ বছরের কিশোরের শরীরের বিভিন্ন অংশে অন্তত ২২ ছররা গুলি লাগে। যার মধ্যে একটি লাগে তার ডান চোখে। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সারাগায়ে ছররা গুলিতে বিধ্বস্ত ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেও সেখানেও অপেক্ষা করছিল পরিবারটির জন্য নতুন বিপদ। আল আমিনের মা শারমিন জাহান বলেন, 'চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন ওকে হাসপাতালে রাখা যাবে না, বাড়িতে নিয়ে যান। কারণ কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে আন্দোলনে আহত সব রোগীকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে রাতের মধ্যেই। চোখসহ তখন ছেলের সারাগায়েই ছররা গুলি।'

পরদিন যা কিছু তার কাছে সম্বল ছিল তাই নিয়েই ছেলের চিকিৎসার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। আহত ছেলের চিকিৎসায় ঘুরতে থাকেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে।

হাসপাতালে কোনো জায়গা নাই, সব জায়গাতেই রোগী। যার ফলে চিকিৎসা পেতে দেরি হচ্ছিল। পরে গ্রামীণ জিসি চক্ষু হাসপাতালে কয়েক দফা টেস্ট আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা দ্রুত অস্ত্রোপচারের কথা বলেন এবং ওকে (আল আমিন) ঢাকার ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ড করেন, বলেন আল আমিনের মা।

আল আমিনের মতো জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, লায়ন্স আই ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ আই হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগসহ ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জনকে ভর্তি করা হয় বলে জানান, বাংলাদেশ চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মেহবুব উল কাদির।

তিনি বলেন, তাদের মধ্যে ৬৩০ জনের অপারেশন হয়েছে, যাদের ৯০ শতাংশের বেশি এক চোখ বা দুটো চোখই হারিয়েছেন।

তাদের অধিকাংশই ছররা গুলিতে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন এবং রেটিনার রক্তক্ষরণের কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বলে জানান তিনি।

১৭ জুলাই থেকে মাত্র ১০ দিনে ৪৪৫ জন রোগীকে এনআইওএইচের জরুরি সেবায় আনা হয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্তত ৩০৫ জনের অস্ত্রোপচার হয়েছে।

গত ১১ আগস্ট হাসপাতাল থেকে বলা হয়, ৪ থেকে ১০ আগস্টের মধ্যে আরও ২৬১ জন রোগীকে আনা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ১৮১ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

রোগীদের অনেকে হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে অথবা দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। জরুরিভিত্তিতে তাদের পুনর্বাসন জরুরি।

সারা দেশ থেকে একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে, যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি।

ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ভিট্রিও-রেটিনাল সার্জন ফারহানা ইয়াসমিন জানান, আল আমিনের ক্ষেত্রে ছররা গুলিটি তার রেটিনায় ঢুকে গিয়েছিল।

গত ১৩ আগস্ট আল আমিনের চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে ছররা গুলিটি বের করা যায়নি। তার অপটিক নার্ভে এমনভাবে ছররা গুলিটি আটকে গেছে যার ফলে সার্জনদের পক্ষে এটি বের করে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

ডা. ফারহানা বলেন, এখন যে অবস্থায় আছে তাতে ছররা গুলিটি আর কোনো ক্ষতি করবে না কিন্তু আল আমিন তার আহত চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। তার ফলোআপ দরকার আর আরও একটি অপারেশনও লাগতে পারে।

এই চিকিৎসক গত দুই দিনে অন্তত পাঁচজন একই ধরনের রোগীর চিকিৎসা করেছেন।

গত ১৪ আগস্ট হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে আল আমিন। আমার সব বন্ধুরা স্কুলে ফিরেছে। কিন্তু আমার তো কোথাও যাওয়া নাই। ঘরের মধ্যেই বসে থাকি, নয়তো শুয়ে থাকি।

'আমি জানি না কবে আমি আমার নিজের জীবনে ফিরতে পারব। কবে মাঠে খেলতে যেতে পারব, বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে বেড়াব।'

তবে চোখে আঘাত পাওয়া রেস্তোরাঁকর্মী কাজী ফারুক এখনো চক্ষু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন।

দুই চোখেরই দৃষ্টি হারিয়েছেন ফারুক। হঠাৎ করেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেছে তার কাছে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও দেশ ছেড়ে পালানোর পর রাজপথে বিজয়ের উৎসবে ফেটে পড়েছিল ঢাকা। আর সেদিনই ফারুকের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার দিন।

সেদিন অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতোই মেরুল বাড্ডায় মেসের ছোট্ট ঘরটাতে তার দিন শুরু হয়েছিল। ক্যাপিটাল নামের যে রেস্তোরাঁয় গত চার বছর ধরে ফারুক কাজ করছিলেন। তবে অস্থিরতা আর কারফিউয়ের কারণে সেটি বন্ধ ছিল।  

যখন শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর আসে লাখো মানুষের মতো ফারুকও উল্লসিত জনতার সঙ্গে যোগ দেন।

গত ১৬ জুলাই থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয় আন্দোলনকারী হিসেবে ছিলেন ফারুক। বিজয়ের সেই দিনেও তিনি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

আন্দোলনকারীরা বাড্ডা থানার কাছাকাছি আসতেই উৎসব রূপ নেয় আতঙ্কে।

কোনো রকমের সতর্কতা ছাড়াই পুলিশ গুলি চালায় এবং এরমধ্যেই সেখানে ফারুকের গায়ে ছররা গুলি লাগে। যার মধ্যে চোখও বাদ যায়নি।

সাথে সাথেই জাতীয় চক্ষু হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হলেও যে অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, আমরা এখনো তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।

এমন একটা সফল গণঅভ্যুত্থানের পর উৎযাপনের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হওয়াটা কষ্টের। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করছেন। অন্তত একটি চোখেও যদি দেখতে পারি সেটাই আমার জন্য অনেক, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন ফারুক।

হাসপাতাল প্রয়োজনীয় সেবা দিচ্ছে, তবুও ফারুকের দুশ্চিন্তা যায় না।

'হাসপাতাল আমাকে যা কিছু প্রয়োজন সব দিচ্ছে, কিন্তু যে ওষুধ এখানে পাওয়া যাচ্ছে না সেগুলো আমাকে কিনতে হচ্ছে। লোকজন এখন আমার খোঁজখবর নিচ্ছে, সাহায্য করছে কিন্তু আমার ভয় হয় তারা যদি এসব না করে, তাহলে আমি একলা হয়ে যাবো।

ফারুকের পরিবারও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে। অনেক আগেই বাবা-মাকে হারানোর কারণে ফারুককে জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তবে এর মতো খারাপ সময় হয়তো আর কখনো তার জীবনে আসেনি।

Comments