আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, ৩৩ নাগরিকের বিবৃতি
গত ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলনকারী সকলের মৃত্যুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন পেশার ৩৩ নাগরিক।
গত ২১ জুলাই এক বিবৃতিতে তারা এই দাবি জানিয়ে বলেন, দেশে যে পরিস্থিতি চলছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বিবৃতিতে তারা বলেন, গত ১৬ জুলাই ২০২৪, সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে বাস এবং ট্রাক বোঝাই করে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে গুন্ডা ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটানো এবং নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যে সহিংসতার সূত্রপাত হয় তা বাংলাদেশকে গত কয়েকদিনে এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। বিশেষ করে এই সহিংসতার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশ জুড়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এলে রংপুরে আবু সাঈদকে সরাসরি বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে একে একে অনেক আবু সাঈদের প্রাণ ঝরতে শুরু করেছে পুলিশ, বিজিবি, এপিবিএন কিংবা সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে। এরকম পরিস্থিতি আন্দোলনটিকে আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রাখল না।
এতে আরও বলা হয়, 'নিজ দেশের বিক্ষুব্ধ মানুষকে হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। কাঁদানে গ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেড উপর থেকে ছুড়ে ফেলায় দেশজুড়ে অনেক মানুষ হতাহতের শিকার হচ্ছেন। পুরো বাংলাদেশ মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে যেন। এমনকি আহত সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছে না, দলীয় সন্ত্রাসীরা বাধা প্রদান করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরকম অমানবিক, অদূরদর্শী পরিস্থিতি বাংলাদেশে এর আগে সম্ভবত ঘটেনি। এতে আমরা যারা এখনও বেঁচে আছি, প্রবল অসহায়ত্ব এবং ক্রন্দন তাদের সমস্ত বোধশক্তিকে গ্রাস করছে। এরকম কখনো আগে আমরা কেউই অনুভব করিনি।'
বিবৃতিদাতারা আরও বলেন, অবাক হই ২০২৪ সালের এই আধুনিক সময়েও আমাদের মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হতে হয়। দাবি আদায় করতে হয় জীবনের বিনিময়ে বা দমন করতে হয় হত্যা করে। অতি সাধারণ, রাজনৈতিক পরিচয়হীন এবং নির্বিবাদ মানুষ হয়েও আমরা মেনে নিতে পারছি না এতগুলো তাজা প্রাণের এই পরিণতি। নিজেদের সন্তান আর সাঈদ, ফারহানসহ আরও অগুণতি মুখ বারবার ভেসে উঠছে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে বলে জ্ঞানত বুঝতে পারছি না, কারণ কোনোভাবেই তারা আর ফিরবে না। নিজের দেশের মাটিতে, আমাদের সন্তানেরা অধিকার চাইতে গিয়ে আমাদের দেশের রক্ষকদের গুলিতে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এই রক্তক্ষরণ কোনোদিন থামার নয়, এই অশ্রু কোনোদিন মোছার নয়। এই হত্যাকাণ্ডগুলো মেনে নিতে পারি না, মানব না। মানুষ মরণশীল, কিন্তু এই মৃত্যুগুলো নির্মম, নিষ্ঠুর, মর্মন্তুদ। কোনো ব্যাখা, কোনো প্রতিকার পারবে না ওদের ফিরিয়ে দিতে। সেই অসহনীয় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে চাই, নিজের দেশের মাটিতে, নিজের অধিকার চাওয়ার অধিকারটুকু আমরা নিজেদের জন্য চাই, আমাদের সন্তানের জন্য চাই, সবার জন্য চাই।
বিবৃতিতে বলা হয়, পথ ও মত বিভিন্ন। কিন্তু ভিন্ন মত প্রকাশের পরিণতি যদি এত ভয়ানক হয় তবে নিজেদেরকে স্বাধীন দেশের নাগরিক বলে ভাবতে পারি না। নির্বিচার হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির তৈরি না হলে সেইদিন দূরে নয়, যেদিন রক্তের প্রতিশোধ রক্ত দিয়ে নেয়ার খেলায় অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে এই দেশ।
তারা বলেন, গত ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলনকারী সকলের মৃত্যুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আমরা এরকম ঘৃণ্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। পরিশেষে আমরা চাই যে, সরকার এবং সরকারের অধীনস্থ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের শিক্ষার্থীসহ সব সাধারণ নাগরিকের প্রতি অহিংস-সংবেদনশীল আচরণ করবে। অন্যথায় এই মৃত্যুর বিভীষিকা ও এই পর্বতসম অন্যায়ের ভার সইতে না পেরে এই ছা-পোষা মানুষদের এর সুরাহায় পথে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকবে না।
বিবৃতিদাতারা হলেন-- বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, শিক্ষাবিদ; তানজীম উদ্দীন খান, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; শহীদুল আলম, আলোকচিত্রী ও প্রতিষ্ঠাতা, দৃক; আশরাফ কায়সার, সিনিয়র সাংবাদিক; মিজানুর রহমান আরিয়ান, নাট্য নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকার; রাশনা ইমাম, ব্যারিস্টার-এট-ল, এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক ডা. নিজামুদ্দিন আহমাদ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ (অবসরপ্রাপ্ত); অধ্যাপক সানজিদা শাহ্রিয়া, কাউন্সিলর ও সাইকোথেরাপিস্ট; মানজুর- আল- মতিন, এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট ও টিভি উপস্থাপক; ডা. মহিউদ্দিন আহমদ, চিফ কনসালটেন্ট, আইসিইউ, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল; অধ্যাপক ডা. মোহম্মদ রোকনউদ্দিন; আমেনা খাতুন; রেজওয়ানা রহমান, শিক্ষক; ফাহীম মাসুদ চৌধুরী, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার; আয়নুল হক; মুবিনা মোস্তফা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক; ড.স্নেহার্দ্রী চক্রবর্তী, আইনজীবী ও শিক্ষক; ডা. তাজনূভা জাবীন, চিকিৎসক; নাসিমা সিরাজী, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন; ডা. সাদিয়া শারমিন; মেহেরুন্নেসা বেলি, শিক্ষক; ধ্রুবজ্যোতি হোর, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন; তাপস বন্ধু দাস, এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; অনুপ কুমার বসাক, স্থপতি; নাফিজ আহমেদ, শিক্ষক; নাভিদ নওরোজ শাহ্, মানবাধিকার কর্মী; নাফিউল আলম সুপ্ত, আইন পেশাজীবী; আব্দুল কাদের জিলানী, আইনজীবী; মোহাম্মদ শাহরিয়ার, আইন পেশাজীবী; ডা. সারা আহমেদ; আবু রায়হান বকসী; ইভা মজুমদার।
Comments