সরকারি কর্মচারী: বছরের পর বছর ধরে শিথিল হচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধিমালা

সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়ালে যেসব আইন ও বিধির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সেসব আইন ও বিধি গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে শিথিল করা হয়েছে।

সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়ালে যেসব আইন ও বিধির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সেসব আইন ও বিধি গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে শিথিল করা হয়েছে। ফলে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের শাস্তির মাত্রা কমেছে। এতে সরকারি কর্মচারীদেরকে দুর্নীতি-অনিয়মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুই সরকারই এ সংক্রান্ত আইন-বিধিমালা সংশোধন করে দুর্নীতির শাস্তি কমিয়েছে। অন্তত তিনটি আইন ও বিধিমালা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য মিলেছে।

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা (১৯৮৫) সংশোধনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তি হিসেবে তাকে 'তিরস্কার' অন্তর্ভুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।

এই সংশোধনীর আগে এই শাস্তি ছিল 'বাধ্যতামূলক অবসর', 'চাকরি থেকে অপসারণ' বা 'চাকরি থেকে বরখাস্ত'।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, দুর্নীতিবিরোধী নিয়ম-নীতি শিথিল করা হলে দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

'যদি তদন্তে পাওয়া যায় যে একজন সরকারি কর্মচারী দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন, তাহলে ওই ব্যক্তি কেন চাকরিতে থাকবেন? কেন অন্য কর্মকর্তারা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির পাশাপাশি কাজ করবেন? সহকর্মীরা কী বার্তা পাবেন?' এমন প্রশ্ন রেখে ফিরোজ মিয়া বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জবাবদিহি এড়াতে সুযোগ তৈরি করার বদলে সরকারের উচিত স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কঠোর দুর্নীতি দমন বিধি প্রণয়ন করা।

গত এপ্রিলে একটি তদন্তে দেখা যায় বর্তমানে সহকারী সচিব প্রমথ রঞ্জন ঘটক ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মাদারীপুরে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা থাকাকালে ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পাঁচ জন জমির মালিককে টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দেখা গেছে, প্লটগুলো সরকারের মালিকানাধীন এবং কাউকে এজন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

এজন্য প্রমথ রঞ্জনকে সিনিয়র সহকারী সচিব পদ থেকে সহকারী সচিব পদে পদাবনতির শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

ফিরোজ মিয়া বলেন, 'প্রমথ যে অপরাধ করেছেন তার সঙ্গে এই শাস্তি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক যুগ্ম সচিব বলেন, '১৯৮৫ সালের বিধিমালা শিথিল করা না হলে ওই কর্মকর্তা নিশ্চয়ই বরখাস্ত হতেন। তিনি যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ তার সৎ সহকর্মীরা এটি নিয়ে অস্বস্তি বোধ করবেন।'

গত এপ্রিলে বগুড়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বীর আমির হামজাকে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায ১২ মাসের জন্য বেতন কমিয়ে দেয় সরকার। দুর্নীতির এই লঘু শাস্তিতে অবাক হয়েছিলেন অনেকে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন এসব ঘটনায় যুক্ত কর্মচারীদের বরখাস্ত করার শাস্তি থাকা উচিত।

অনেকে বিশ্বাস করেন, ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (ডিমিসাল অন কনভিকশন) অধ্যাদেশের পরিবর্তে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে সরকারি কর্মচারীদের দায়মুক্তি দিয়েছে সরকার।

১৯৮৫ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতে হতো।

তবে ২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে ১২ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হওয়ার পরও কোনো কর্মকর্তা- কর্মচারী চাকরিতে থাকতে পারবেন।

অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি-১৯৭৯ এর ২০০২ সালের সংশোধনী এর আরেকটি উদাহরণ।

বিধিমালার ১৩ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবছর সম্পদের হিসাব নিজ দপ্তরে জমা দেওয়ার বিধান ছিল (যদিও বাস্তবায়ন হতো না)।

তারপরও ২০০২ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে বিধিমালা সংশোধন করায় এখন প্রতি পাঁচ বছর পর পর কর্মচারীদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান করা হয়েছে, এটাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কার্যত, সরকারি কর্মচারীরা তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া নিয়ে মাথাই ঘামান না।

উপরন্তু এই বিধান আরও শিথিল করার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি সংশোধন করে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান বাতিলের চিন্তা চলছে। প্রয়োজনে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী সংগ্রহ করার বিষয়টি বিধিমালায় যুক্ত করে নতুন বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

সাবেক সচিব বদিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, আইনকে দুর্বল করা মানে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। তার মতে, নিয়ম-কানুন শিথিল করা সরকারি কর্মচারীদের বার্তা দেয় যে, তারা দুর্নীতি করে পার পেয়ে যেতে পারেন। কঠোর আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান বলেন, 'দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে এমন আইন বা প্রবিধান প্রণয়ন করা সংবিধানকে উপেক্ষা করার শামিল।'

সংবিধানে বলা আছে, কোনো নাগরিক যাতে অবৈধ সম্পদ অর্জন করতে না পারে সে জন্য সরকার আইন প্রণয়ন করবে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ বলছে, 'রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবেন না...।'

কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে।

আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ গত ২৫ জুন সংসদকে বলেন, দুর্নীতি সরকারের অর্জনকে গ্রাস করে ফেলছে। তিনি বলেন, সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাদের (দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদেরকে) চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ অপরাধী সুরক্ষার আইন হিসেবে পরিণত হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখা উচিত।

গত ২৬ জুন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কবিরুল হক বলেন, 'বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।'

Comments