বাজেট ২০২৪-২৫

কর অব্যাহতি বেড়ে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা

ব্যক্তি পর্যায়ে চাপ কমাতে এবং উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহজ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেসব কর অব্যাহতি প্রস্তাব করেছে তাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে করছাড়ের পরিমাণ ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাজেট, অর্থবছর, মোস্তফা কে মুজেরি, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ,

ব্যক্তি পর্যায়ে চাপ কমাতে এবং উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহজ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেসব কর অব্যাহতি প্রস্তাব করেছে তাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে করছাড়ের পরিমাণ ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মোট কর আদায়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় নামে পরিচিত ছাড়ের পরিমাণ যুক্ত করা হলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ত। তাহলে ঋণের ওপর রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা কমতে পারত।

প্রত্যক্ষ কর ব্যয় হলো কর ভর্তুকির একটি রূপ যা গণনা করার সময় আয়ের কর অযোগ্য অংশ বাদ দিয়ে ছাড়, ডিসকাউন্ট এবং করের হার হ্রাস করে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত কর ব্যয় প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে ১১ শতাংশ বেশি, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।

শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ পরিমাপের অংশ হিসেবে এ নিয়ে বাজেটে দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যক্ষ কর ব্যয় হিসেব করল এনবিআর।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার শর্তের অংশ হিসেবে রাজস্ব ব্যয় হিসাব করতে বলার পর কর কর্তৃপক্ষ এ উদ্যোগ নিয়েছে।

আইএমএফ ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কর ছাড় যৌক্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে।

অর্থনীতিতে কর মওকুফের প্রভাব জানার জন্য অর্থনীতিবিদেরাও বিভিন্ন খাতে দেওয়া কর ছাড় ও শুল্ক সুবিধার হিসেব করার কথা বলে আসছিলেন।

প্রথম ধাপে ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী প্রত্যক্ষ কর ব্যয় বা রাজস্ব ছাড়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকায়।

পরের বছরে এটি ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয় কোম্পানিগুলোকে এবং ৪৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা পায় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্যাটের মাধ্যমে দেওয়া অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'এই কর ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি।'

'কর ভর্তুকি কমাতে, সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে।'

তবে এই অর্থনীতিবিদ স্বীকার করেন, কর ভর্তুকি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 'যেমন, এটি দেশীয় ইলেকট্রনিক্স খাতকে দ্রুত প্রসারিত করতে সহায়তা করেছে।'

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'অব্যাহতি দেওয়া রাজস্ব যদি এনবিআর আদায় করতে পারতো তাহলে তা সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কাটাতে সহায়তা করতো।'

'তবে বাস্তবতা বিবেচনায় সরকারকে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে কর ছাড়ের অনুমতি দিতে হয়।'

অন্যদিকে, চাল, ডাল এবং গমের মতো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সবকিছুকে করের আওতায় আনা উচিত, বলে মনে করেন তিনি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক করকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।

'ভর্তুকি এবং কর ছাড়ের মতো সুবিধা সাধারণভাবে নির্ধারণ করা উচিত নয়। এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা উচিত।'

বাংলাদেশে শুল্ক হার বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ এবং এভাবে চলতে থাকলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর দেশটি আর বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, কোনো ধরনের নীতি নির্ধারণ ছাড়াই কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। অনেকগুলো খাতই কয়েক দশক ধরে এসব সুবিধা ভোগ করে আসছে।

 'এটা একটা বড় সমস্যা'

যারা কর অব্যাহতি পাচ্ছেন তারা এর প্রায় অর্ধেক, ৪৭ শতাংশই খরচ করছেন বেতন ও অন্যান্য খাতে।

ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স ও মূলধন লাভের খাতগুলো ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট কর ব্যয়ের ১০ শতাংশ পেয়েছে।

'অন্যান্য খাতে এ ধরনের কৌশলগত সহায়তা দেওয়ার সরকারি সক্ষমতা আটকে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সুবিধার প্রভাব বিশ্লেষণ করা তাই কঠিন,' বলেন তৌফিকুল ইসলাম।

যেহেতু নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়, তাই এই সিদ্ধান্তগুলো প্রায়শই বস্তুনিষ্ঠভাবে নেওয়া হয় না।

কর ছাড়ের সর্বোচ্চ প্রাপকদের মধ্যে আরও রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৭ শতাংশ, পোশাক খাত ৪ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক খাত ৩ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, 'কর অব্যাহতি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে ত্বরান্বিত করলেও কর ভিত্তি অনেকাংশে সংকুচিত হচ্ছে।'

এ প্রেক্ষাপটে দেশের চলমান উন্নয়ন টিকিয়ে রাখতে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত ভালো করার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি অন্যতম বড় বাধা। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি না হলে ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এতে রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা আসবে এবং বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, বলেন মন্ত্রী।

এরই অংশ হিসেবে ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনী মুনাফার ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

Comments