সম্পদ জব্দের পর কী করবেন বেনজীর?

জব্দ হওয়ার পর বেনজীর আহমেদের সম্পদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই থাকবে।
বেনজীর আহমেদ। ফাইল ছবি সংগৃহীত

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, তার অনুসন্ধান চলাকালেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সাবেক পুলিশপ্রধানসহ তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশও দেওয়া হয়েছে।

এই আদেশে জব্দ হওয়ার পর বেনজীরের সম্পদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই থাকবে। তিনি এগুলোর মালিকানা বদল, হস্তান্তর কিংবা বিক্রি করতে পারবেন না।

প্রশ্ন হলো—এখন বেনজীর আহমেদ কি সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ ঠেকাতে আদালতে যাবেন? তার কি সেই সুযোগ আছে? এর পরবর্তী প্রক্রিয়াটাই বা কী?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে।

এ ব্যাপারে শাহদীন মালিক বলছেন, 'এটা (মামলা হওয়ার আগেই সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন) দুদক আইনেই আছে। দুদক যদি মনে করে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি দুর্নীতি করে অর্জিত সম্পত্তি হস্তান্তর করে দেবে, তাহলে দুদক এই আবেদন করতে পারে।

শাহদীন মালিক। ছবি: সংগৃহীত

'বিচারে তিনি (বেনজীর আহমেদ) যদি দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তো তার কারাদণ্ডের শাস্তি হবে। পাশাপাশি এই সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে চলে যাবে। রাষ্ট্র এই সম্পত্তির মালিক হবে। যাতে সে এগুলো ট্রান্সফার করতে না পারে, দোষী সাব্যস্ত হলে সরকার যাতে এগুলো বাজেয়াপ্ত করতে পারে এ জন্যই ফ্রিজ করে রাখা।'

অভিযোগের ব্যাপারে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর মামলা হবে বলে জানান ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের এই আইনের শিক্ষক। এরপর তদন্ত শেষে চার্জশিট পাওয়ার পর আদালত অভিযোগ গঠন করবেন। এর মাধ্যমে শুরু হবে বিচারিক প্রক্রিয়া।

'দুদক আইনে দুর্নীতির জন্য কারাদণ্ডের পাশাপাশি বাজেয়াপ্তকরণ অন্যতম প্রচলিত শাস্তি'—মন্তব্য করে শাহদীন মালিক বলেন, 'পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া এক বছরের বেশি হওয়া উচিত না। আর বিচারিক কাজ ছয় মাসের মধ্যেই শুরু করতে পারার কথা। যেহেতু সব ডকুমেন্টারি এভিডেন্স।'

বিচারে শাস্তি হয়ে গেলে সাবেক আইজিপি আদালতের আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।

তবে শুরুর পর্যায়ে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পত্তি জব্দ ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার যে আদেশ দিলেন আদালত, তার বিরুদ্ধেও আদালতে আবেদন করার সুযোগ আছে বেনজীর আহমেদের।

এ কথা জানিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এই আবেদন করতে হবে বিচারিক আদালতের সম্পত্তি জব্দের সিদ্ধান্ত আসার পর ত্রিশ কার্যদিবসের মধ্যে। ওই আবেদনের ভিত্তিতে আদালত যে আদেশ দেবেন, তাতে সন্তুষ্ট না হলে তিনি পরে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন।

জেড আই খান পান্না। ছবি: সংগৃহীত

এই আইনজীবীর ভাষ্য, 'এটাকে বলা হয় আগাম ক্রোক। ধরা যাক একটা বিদেশি জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছে কেউ টাকা পান। এক্ষেত্রে জাহাজটি যদি ক্রোক না করা হয় তাহলে তো সেটা চলে যেতে পারে। মালিকানা হস্তান্তর হতে পারে। এটা যদি হয়েই যায় তাহলে তো নতুন মালিককে অপরাধী হিসেবে ধরা যাবে না। ওটা ফেরতও আনা যাবে না। এ কারণেই আগাম ক্রোকের আবেদন করা হয়।'

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন বেনজীর আহমেদ এবং স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি জব্দ (ক্রোক) এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে তাদের নামে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন।

পরে গত রোববার একই আদালত থেকে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা আরও ১১৩টি দলিলের সম্পদ এবং গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট জব্দ (ক্রোক) করার আদেশ আসে।

বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি দুই পর্বে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১ ও ২) প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। পরে ২২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানান, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেসব অভিযোগ এসেছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

এরপর ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক আদেশে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অগ্রগতির বিষয়টি হলফনামা আকারে দুই মাস পর জানাতে দুদককে নির্দেশ দেন।

সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের এই উদ্যোগকে 'খানিকটা ব্যতিক্রমী' বলে অভিহিত করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, 'দুদকের দিক থেকে এই উদ্যোগটা খানিকটা ব্যতিক্রমী বলতে হবে। দুদক সাধারণত বলে থাকে—কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে দুদক স্বপ্রণোদিত হয়েই কাজটি করেছে। এটা আইনগতভাবেই তাদের এখতিয়ারে আছে।'

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোকে 'বহুল আলোচিত, বিকট, অবিশ্বাস্য ও দুর্নীতির উৎকট প্রকাশ' হিসেবেও অভিহিত করেন ইফতেখারুজ্জামান। এজন্যই হয়তো দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের ধারণা, 'প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যের সাপেক্ষে সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের বিষয়গুলো যত দূর আলোচনায় এসেছে তাতে তারা (দুদক) হয়তো মনে করেছে এগুলো পাচার কিংবা হস্তান্তরের ঝুঁকি থাকতে পারে। বিশেষ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি যেহেতু অত্যন্ত প্রভাবশালী। দুটি বাহিনীর শীর্ষ পদে তিনি ছিলেন। এর বাইরেও তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার তথ্যও ব্যাপক আলোচিত। এসব কারণেই হয়তো দুদক তার সম্পত্তি জব্দের আবেদন করেছে।'

পুরো বিষয়টাকে এখন পর্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখলেও শঙ্কার কথাও জানান টিআইবি নির্বাহী পরিচালক। বলেন, 'এটা যেহেতেু ব্যতিক্রমী উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি, এক্ষেত্রে সত্যিকারের জবাবদিহি নিশ্চিত হবে কিনা, দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবেই এমন তৎপরতা দেখানো হচ্ছে কিনা তা নিয়েও সংশয় জাগে। এমন যদি হয়ে যায় তাহলে মানুষের মনে প্রচণ্ড হতাশা তৈরি হবে।'

আর যদি সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া মেনে শেষ পর্যন্ত সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় ও সরকারিভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা যে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে তাদের কাছেও শক্ত বার্তা যাবে বলেও মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, 'দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে অন্তত এই বার্তা পৌঁছাবে যে এসব অপরাধ করে পার যাওয়া যায় না। বিচার একদিন হবেই। এই বার্তাটা আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। কাজেই দুদক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য এটা সুযোগ।'

বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় র‌্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন। যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ।

ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক এই পুলিশপ্রধান ২০২২ সালে কর্মজীবনে শুদ্ধাচার চর্চার জন্য শুদ্ধাচার পুরষ্কারও পান। ওই বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাপ্রধানদের ভেতর থেকে তাকেই এ পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।

পরের বছর অবসরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ২০২৩ সালের ৫ মার্চ রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশানে এক দিনে চারটি ফ্ল্যাট কেনেন বেনজীর। ফ্ল্যাটগুলোর মোট আয়তন ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট। দাম দেখানো হয় মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

গত রোববার ওই চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেন আদালত।

Comments

The Daily Star  | English

Quota protests: Bhashani univ students lift blockade on Dhaka-Tangail highway

Hundreds of students from Mawlana Bhashani Science and Technology University today briefly blocked the Dhaka-Tangail highway to protest the reinstatement of the quota system in government jobs

1h ago