ডয়চে ভেলের তথ্যচিত্রে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

ডয়চে ভেলে

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) গোয়েন্দা শাখার কিছু সদস্য যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড আছে, তাদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা হয়েছিল বলে জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের একটি তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছে।

'মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা যখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী' শিরোনামে ২০ মিনিটের ওই তথ্যচিত্রে আরও দেখানো হয়েছে, কীভাবে শ্রীলঙ্কা গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠিয়েছিল।

এতে শান্তিরক্ষীদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়, এই ধরনের মোতায়েন শান্তিরক্ষা মিশনের মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।

তথ্যচিত্রে বলা হয়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েন আছে।

ডয়চে ভেলের তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে, একশ'র বেশি র‍্যাব সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৪০ জনকে পাঠানো হয় জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি ২০১৯ সালে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর।

এতে শান্তিরক্ষা মিশনে থাকা র‍্যাবের তিন সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়। এই তিন জন র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন র‍্যাবের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তথ্যচিত্রে গোয়েন্দা শাখার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলা হয়, 'র‍্যাবের এই ইউনিটটি বাংলাদেশ জুড়ে টর্চার সেলের একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। এসব সেলের কিছু সেফ হাউস রয়েছে, অন্যগুলো র‍্যাব কম্পাউন্ডের আড়ালে রয়েছে।'

কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন বেসামরিক সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দিতে শান্তিরক্ষী হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছিল বলে জানায় ডয়চে ভেলে।

ডয়চে ভেলের তথ্যচিত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, জাতিসংঘ মিশন র‍্যাবের কোনো বিষয় নয়।

'সুতরাং এ নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই,' তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন।

তথ্যচিত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্ড্রু গিলমোর বলেন, 'জাতিসংঘের হাত দৃশ্যত বাঁধা' ।

তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'তখন অধিকাংশ শান্তিরক্ষী সুইডেন এবং আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলো থেকে আসত।'

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে স্নায়ুযুদ্ধের যখন সমাপ্তি ঘটছে, তখন মিশনগুলোর ভয়াবহতা দেখে পশ্চিমা সরকার শান্তিরক্ষা কর্মকাণ্ড থেকে ক্রমশ সেনা সরিয়ে নিতে শুরু করে। তার বদলে তারা অর্থ সহায়তা দেওয়ার বিষয় প্রাধান্য দেয়।

জাতিসংঘে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশের একজন রাজনৈতিক সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানান, গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সেনাদের রক্তক্ষয় কতটা সহ্য করা যাবে তা বিবেচনায় আনতে হয়।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, যদি জাতিসংঘের মিশনে পাঠানো সেনাদের মরদেহ ফিরতে শুরু করে, তখন সেই সরকারগুলোকে সংসদীয় তদন্তের মুখে পড়তে হয়।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি কোনো সমস্যা নয়, বলে জানান তিনি।

'ফলাফল, জাতিসংঘে খুব, খুব কম উচ্চপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, পশ্চিমা আদর্শের সেনা কাজ করছেন,' বলেন অ্যান্ড্রু গিলমোর।

তিনি আরও বলেন, 'প্রায় কখনোই পর্যাপ্ত সেনা ছিল না। তার মানে এই নয় যে জাতিসংঘ বলতে পারে, "ঠিক আছে, আমরা এই দলটি নেব কারণ এই দেশ মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কিংবা দুঃখিত, আপনাদেরকে আমরা নিতে পারছি না।"'

'জাতিসংঘের এটি করার সুযোগ নেই,' বলেন গিলমোর।

গিলমোর বলেন, 'এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে আক্ষরিক অর্থেই শান্তিরক্ষীরা অনুপস্থিত থাকলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানী হতে পারে। আর তখন আপনাকে সমন্বয় করতে হয় যে, হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর চেয়ে দুই তিন জন 'মন্দ লোক' পাঠানো অপেক্ষাকৃত কম খারাপ বিকল্প হতে পারে।'

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তৃতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে অবদানের জন্য দেশটি বিভিন্ন সময়ে প্রশংসিত হয়েছে।

তথ্যচিত্রে বলা হয়, ২০১২ সালে শান্তিরক্ষীদের বেশ কয়েকটি যৌন নিপীড়ন কেলেঙ্কারির পর জাতিসংঘ তার কর্মীদের জন্য নতুন মানবাধিকার নীতি ঘোষণা করে।

সেই নীতি অনুসারে শান্তিরক্ষায় সেনা পাঠানো দেশগুলো সাধারণ ফোর্স কমান্ডার এবং তাদের সহকারীদের বাদে অন্যান্য সেনা সদস্যদের যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব পালন করে। এসব দেশকে প্রত্যেক সেনার জন্য প্রত্যয়ন দিতে হয় যে, তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেননি বা এমন কোনো অভিযোগও তার বিরুদ্ধে নেই৷

ডয়চে ভেলের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ লিখিতভাবে জানায়, 'প্রত্যেক ব্যক্তিকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় রিসোর্স নেই। তবে সেনা এবং পুলিশ সদস্য সরবরাহকারী দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের একটি দীর্ঘস্থায়ী নীতি আছে।'

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, জাতিসংঘের মুখপাত্র বলেছেন, 'প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর, সুনির্দিষ্টভাবে র‍্যাব সদস্যদের মাধ্যমে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগগুলো নিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা দ্বিপাক্ষিকভাবে দেশটির জাতীয় কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যুক্ত থেকে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।'

অভিযোগ প্রমাণ হলে নিয়োগ বাতিল, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা: জাতিসংঘ

ডয়চে ভেলের তথ্যচিত্র নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমরা প্রতিবেদনটি দেখেছি। আমাদের শান্তিরক্ষা বিভাগের সহকর্মীরা এ বিষয়ে যোগাযোগ করছেন এবং এই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্টদের কাছে একটি বিবৃতি দিয়েছি। আমরা আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই যে মহাসচিব এমন সব কর্মকর্তাকে শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠাতে অঙ্গীকারবদ্ধ, যারা দক্ষতা ও সততার সর্বোচ্চ মানদণ্ড মেনে চলেন। এসব মানদণ্ডের মধ্যে আছে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও অঙ্গীকার।'

গতকাল স্থানীয় সময় বুধবার বিকেলে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিয়মিত প্রেস বিফ্রিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।

দুজারিকের জবাবের পর সম্পূরক প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, যে দেশ থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মকর্তা পাঠানো হচ্ছে (স্বাগতিক দেশ), তারাই মূলত এসব কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাই করেন। সে ক্ষেত্রে, যদি কোনো দেশ বা দেশের শাসক নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হয়ে থাকে, তাহলে তারা কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করবে? তারা কীভাবে জানবে কে লঙ্ঘনকারী, আর কে লঙ্ঘনকারী নন?

জবাবে দুজারিক বলেন, 'যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে করা হয়। প্রথম ধাপে ব্যক্তিগত মানদণ্ডে যাচাই হয়। পরের ধাপে বাছাইয়ের কাজটা করে স্বাগতিক দেশ এবং অন্য বাছাই প্রক্রিয়াটা হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে।'

'বিগত বছরগুলোতে অল্প কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে আমরা কর্মকর্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ব-ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পেরেছি যারা আমাদের শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করেছেন। এ ধরনের কিছু ঘটলে আমাদের শান্তিরক্ষা বিভাগের সহকর্মীরা যাচাই-বাছাই ও অন্যান্য নীতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিই। এ ধরনের ঘটনার (মানবাধিকার লঙ্ঘন) কারণে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়া কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল হতে পারে। এ ছাড়াও, অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িতদের মিশন থেকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago