একজন স্বপ্ন বিপ্লবীর জীবনের গল্প

Sir Fazle Hasan Abed
স্যার ফজলে হাসান আবেদ। স্টার ফাইল ফটো

'পথের ধারে মাটি কাটছিলেন নারীরা। বলা হয়, নারী নাকি কঠিন কাজ করতে পারেন না। অথচ নারীরা যে দায়িত্ব নিতে পারেন, কোনো পুরুষ তা পারেন না।'

ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ যাওয়ার পথে কথাগুলো বলছিলেন ফজলে হাসান আবেদ, সবার প্রিয় আবেদ ভাই। নারীরা যে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা কেউ ভাবেনি বলে ১৯৭৪ সালের একটি অভিজ্ঞতার গল্প বললেন।

'দুর্ভিক্ষের সময় রৌমারীতে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, পরিবারের পুরুষরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। নারীরা মুমূর্ষু বাচ্চা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। নিজে না খেয়ে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। নিজেও অভুক্ত, অপুষ্টিতে জর্জরিত। কিন্তু সন্তানের খাবার থেকে নিজে একটুও খাচ্ছেন না। এর থেকে শিক্ষা পেলাম যে, নারীরা বাচ্চা ফেলে রেখে চলে যায় না। দায়িত্ব নেয়, পুরুষ দায়িত্ব নেয় না। নারী শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে বিপদমুক্ত হতে চায়। আমার শিক্ষাটা হলো যে, এই নারীদের সুযোগ দিলে তারা অসাধ্য সাধন করতে পারবেন।'

সাধারণত আবেদ ভাই প্রশ্ন না করলে কিছু বলেন না। প্রশ্ন করলেও বিস্তারিত বলেন না। বারবার প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে হয়। নারীদের প্রসঙ্গে প্রশ্ন না করলেও তিনি বলে যেতে থাকলেন।

'মেয়েরা পারবে না, সমাজ প্রতি পদে পদে এই বাধা তৈরি করেছে', সে কথা বারবার বললেন।

হাঁস-মুরগি ও গরুর অসুখ তখন গ্রামাঞ্চলের নিয়মিত বিষয়। হাঁস-মুরগির মতো অসুখে গরুও মারা যায়। একটি গরু মারা যাওয়া মানে কৃষকের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। একদল ছেলে-মেয়েকে তিন মাসের ট্রেনিং দিয়ে 'প্যারাভেটেরিনারিয়ান' তৈরি করা হলো।

আবেদ ভাইয়ের ভাষায়, 'তখন বলা শুরু হলো মেয়েরা গরুর ইনজেকশন দিতে পারবে না। কাজের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো করছে। তবুও "মেয়েরা পারবে না" এ কথা বলা বন্ধ হলো না। প্রথম ব্যাচের পর ছেলেদের নেওয়া বন্ধ করে দিলাম। শুধু মেয়েদেরই "প্যারাভেটেরিনারিয়ান" হিসেবে তৈরি করতে থাকলাম।'

যারা বলতেন মেয়েরা পারবে না, তাদেরকে আবেদ ভাই এই গল্পটি বলতেন।

'বাংলাদেশের মেয়েরা সব কাজ করতে পারে। মেয়েরা নদী থেকে পানি তোলে। এক কাঁখে পানি-ভর্তি কলস, আরেক কাঁখে বাচ্চা নিয়ে খাড়া নদীর পাড় বেয়ে মেয়েরা তরতর করে উঠে আসে। মেয়েরা পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। এই মানসিকতা হলো পুরুষের মনোজগতের সীমাবদ্ধতা।'

২.

বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। এর মধ্যে শুধু টিটেনাস আক্রান্ত হয়ে মারা যেত সাত শতাংশ শিশু। 'টিটেনাস টক্সয়েড ইনজেকশন' দেওয়া গেলে এই সাত শতাংশ শিশুকে বাঁচানো যাবে। সিদ্ধান্ত নিলেন স্বাধীন দেশের এই শিশুদের বাঁচাতে হবে। ভ্যাকসিন সংগ্রহ, যারা টিকা দেবেন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা সমস্যা হবে না। ব্র্যাক তা করতে পারবে।

কিন্তু ভ্যাকসিনগুলো রাখতে হবে ঠান্ডায়। থানাপর্যায়ে রেফ্রিজারেটর থাকতে হবে। তারপর সেগুলো গ্রামে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার সময়ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্র্যাক যখন মুরগির ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছিল, তখনো এই তাপমাত্রার সমস্যায় পড়েছিল। পাকা কলার ভেতরে ভ্যাকসিন ভরে নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুরগির ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল।

শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ ব্র্যাকের একার পক্ষে করা সম্ভব না, দরকার সরকারের সহযোগিতা।

ফজলে হাসান আবেদ দেখা করলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতি পুরো বিষয়টি শুনে মুগ্ধ হলেন। কিন্তু সমস্যা হলো সব থানাপর্যায়ে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই। জিয়াউর রহমান বললেন, পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড করেছি। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সব থানা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে আসবে। এখন অন্য কিছু চিন্তা করেন। টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে কয়েক বছর সময় লাগবে।

অন্য চিন্তা করতে থাকলেন ফজলে হাসান আবেদ। দেখা গেল বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ডায়রিয়া। ডায়রিয়া প্রতিরোধে লবণ, গ্লুকোজ ও পটাশিয়ামের মিশ্রণে ওরাল স্যালাইন তৈরির ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছিল কলেরা রিসার্চ ল্যাব (বর্তমান আইসিডিডিআর,বি) ১৯৬৮ সালে। কিন্তু মানুষের কাছে তা পৌঁছানো যায়নি। আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে ব্র্যাক যৌথভাবে কাজ শুরু করল। স্যালাইনের নমুনা নিউইয়র্কের একটি ল্যাবে পাঠানো হলো জানার জন্যে যে, কীভাবে তা প্যাকেট করা যাবে। শুধু প্যাকেট করলেই হবে না, মিশ্রণে পানির পরিমাণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। পানি কম-বেশি হলে স্যালাইন কাজ করে না। তখন দেশে হাফ লিটার পানি মাপার কোনো নির্দিষ্ট পাত্র বা বোতল ছিল না। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশাল কর্মীবাহিনী তৈরি করা হয়েছে।

আবেদ ভাই বলেছিলেন, 'আমাদের কর্মীরা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছেছে। নারী-পুরুষ, মসজিদের ইমাম, গ্রামের মাতব্বরদের বুঝিয়ে, ভাত রান্নার পাতিলে হাফ লিটার পরিমাণ স্থানে দাগ দিয়ে খাবার স্যালাইন বানানো শিখিয়েছে। কত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে। শেষে এসে দেখা গেল, গরিব মানুষ মনে করছে এটা শুধু তাদের জন্যে, বড়লোকদের জন্যে নয়। এই ভুল ধারণা বদলানোর জন্যে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলাম। টেলিভিশনে যেহেতু দেখায়, তাহলে এটা শহরের বড়লোকরাও খায়, ভুল ভাঙতে থাকে গরিব মানুষের।'

বাংলাদেশে সফল হওয়ার পর ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলোসহ পৃথিবীর বহু দেশে ব্র্যাকের সহায়তা নিয়ে ওরাল স্যালাইন কার্যক্রম পরিচালনা করে সাফল্য পায়।

৩.

মুক্তিযুদ্ধের ফসল ব্র্যাক। আবেদ ভাই একদিন বলছিলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের আগে যখন ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েছিলাম, তখন এক রকমের চিন্তা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে চিন্তার বাইরে আর কিছু ভাবার অবকাশ রাখল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের পক্ষে যে কাজ করছিলাম, তারই ধারাবাহিকতায় দেশে ফিরে এসে কাজ, ব্র্যাক গঠন করা যেন অনিবার্য ছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ম্যারিয়েটা, আমরা বিয়ে করব বলে স্থির করেছিলাম। সে বাংলাদেশে আসতে চাইল না, আমি ইংল্যান্ডে থাকতে চাইলাম না। সম্পর্কটা পরিণতি পেল না। তখন বাংলাদেশ ছাড়া আমার ভাবনায় আর কিছু ছিল না। ম্যারিয়েটা ইংল্যান্ডে আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। অনেক বড় অবদান ছিল তার। দেশ ও ম্যারিয়েটা—দুইয়ের মধ্যে আমি দেশ বেছে নিয়েছিলাম।'

২০০২ বা ২০০৩ সালের এক রাতে হবিগঞ্জে ব্র্যাকের চা-বাগানের বাংলোতে বসে রাত তিনটা পর্যন্ত গল্প বলেছিলেন আবেদ ভাই। ম্যারিয়েটা সম্পর্কে বলেছিলেন বহু কথা, একান্ত ব্যক্তিগত কথা। তবে লিখতে না করেছিলেন। তাই 'ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক' বইয়ে লিখিনি। মৃত্যুর আগে তিনি এ নিয়ে কথা বলে গেছেন। একটি বইয়ে তা লেখা হয়েছে। সেকারণে এখানে একটু উল্লেখ করলাম। কখনো হয়তো বিস্তারিত লিখব। তবে তার জন্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট খুঁজে পেতে হবে।

৪.

মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ পরিচালনা নিয়ে খুবই হতাশ ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। আবেদ ভাইয়ের বক্তব্য ছিল, 'মুক্তিযুদ্ধ থেকে যে শিক্ষাটা আমাদের পাওয়ার কথা ছিল, তা পাইনি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। যুদ্ধবিধস্ত একটা দেশ, চারিদিকে অরাজকতা। স্বাধীন দেশকে আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল না।'

আবেদ ভাই তাজউদ্দীন আহমদে মুগ্ধ ছিলেন। মনে করতেন, 'তাজউদ্দীন আহমদকে যদি অবহেলা না করে সুযোগ দেওয়া হতো, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। তাজউদ্দীনের শিক্ষা, যোগ্যতা, সততা, নেতৃত্বের গুণাবলী সবই ছিল অতুলনীয়।'

অযোগ্যতা ও তোষামুদে প্রসঙ্গে আবেদ ভাই বলতেন, অযোগ্যরা তোষামুদে হয়, যেমন খন্দকার মোশতাক। যোগ্যরাও অনুগত থাকেন, তবে তোষামুদের পর্যায়ে নেমে তা প্রকাশ করেন না, যেমন তাজউদ্দীন আহমদ।'

যোগ্য ও বড় নেতার সংজ্ঞা ছিল আবেদ ভাইয়ের কাছে এমন, 'যিনি বড় মাপের যোগ্য নেতা, তিনি অধিকতরযোগ্য পরবর্তী নেতার জন্যে নিজের আসন ছেড়ে দেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ইচ্ছে করলে আরও ১০ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। তা না করে যোগ্য নেতৃত্বের পথ তৈরি করে দিয়ে সরে গেছেন। গান্ধীও তাই করেছিলেন। নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। সবার শ্রদ্ধার আসনে থেকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।'

৫.

আবেদ ভাই বলতেন, 'মানুষ হয়তো মনে করে যে, আমি একজন সফল মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক তৈরি করেছি, বহু স্বীকৃতি-পুরস্কার পেয়েছি। তবে কাজ তো আর এসব ভেবে করিনি। আমি নিজের কাজে খুশি এই কারণে যে, আমি কাজ করেছি মানুষের জন্যে, গরিব মানুষের জন্যে, যাদের কথা তেমন কেউ ভাবে না। তবে আমি আত্মতৃপ্ত নই। এখনো বহু কাজ করা বাকি রয়ে গেছে।'

বাকি কাজ তার গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক করছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। প্রাণঘাতী রোগে তাকে চলে যেতে হয়েছে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। বেঁচে থাকলে ২৭ এপ্রিল পালিত হতো স্যার ফজলে হাসান আবেদের ৮৮তম জন্মদিন।

 

গোলাম মোর্তোজা: দ্য ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক এবং 'ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক' বইয়ের লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Matarbari project director sold numerous project supplies

Planning Adviser Prof Wahiduddin Mahmud today said the Matarbari project director had sold numerous project supplies before fleeing following the ouster of the Awami League government on August 5.

1y ago