‘বাংলাদেশকে বুঝতে হলে আবেদকে বোঝা দরকার’

SIR Abed-1.jpg
স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: স্টার

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষ। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি তার স্বপ্নগুলোকে কর্মে রূপান্তরিত করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং দক্ষ মানুষ ছিলেন। আর এ কারণেই তিনি ব্র্যাককে পরিণত করতে পেরেছেন বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়ন সংস্থায়।

বিশ্বব্যাপী গরীবের উন্নয়নে একটি প্রখ্যাত নাম ‘আবেদ’। তার মন পরে থাকতো দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন ভাবনায়। গরীব মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

‘স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন ও কর্ম ১৯৩৬-২০১৯’ শীর্ষক একটি স্মরণসভায় মানিকগঞ্জে ব্র্যাকের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রথম শিক্ষক মাজেদা খানম বলেন, “মানুষকে ভালোবাসার মতো মন ছিলো আবেদ ভাইয়ের। মানুষকে উঠে দাঁড়াতে তিনি তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবেদ ভাই আর নেই। কিন্তু তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝেই রয়েছেন।”

গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটিতে ব্র্যাকের আয়োজনে এই স্মরণসভায় সুধীজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, উন্নয়ন কর্মী, কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী এবং সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকরা।

স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়।

অনুষ্ঠানে আবেদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাহজাহান’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শামা রহমান এবং অদিতি মহসিন।

১৯৭২ সালে ৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি ছোট ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। এখন ব্র্যাকের ব্যাপ্তি বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিশ্বব্যাপী ১০ কোটিরও বেশি মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে সংস্থাটি।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক উদ্যোগ নিয়েই মূলত কাজ করে ব্র্যাক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং নেদারল্যান্ডসে শাখা অফিসসহ এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে কাজ করছে সংস্থাটি।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বার্তায় বলেছেন, “দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই উন্নয়নে ফজলে হাসান আবেদের অবদান জাতিসংঘের জন্য এক অনুপ্রেরণার উত্স।” গতকাল অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো বার্তাটি পড়ে শোনান।

গুতেরেস তার বার্তায় আরও বলেন, “স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন ব্র্যাকের স্বপ্ন হয়েছে। তিনি সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি নারীদের উন্নয়নে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন এবং ব্র্যাকের মাধ্যমে তিনি নারীদের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে আনেন।”

স্যার ফজলে হাসান আবেদ আরও বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষার মাধ্যমেই উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু হতে পারে। ব্র্যাকের শিক্ষা মডেল এখন বিশ্বজুড়ে অনুসরণ করা হয়।

“১৯৭০ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ ছিলো ডায়রিয়া। স্যার ফজলে হাসান আবেদ সারাদেশে অত্যন্ত কার্যকর প্রচারণার মাধ্যমে এই রোগটি কাটিয়ে উঠতে অবিশ্বাস্য রকমের সহায়তা করেছিলেন।”

“আজ জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবিক সংকট মোকাবিলার দিকে সকলের মনোযোগ। এখন ব্র্যাক রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। আমি জানি, ব্র্যাক তার প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখবে।”

গুতেরেস বলেছেন, “স্যার আবেদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে জাতিসংঘ ব্র্যাকে পাশেই থাকবে।”

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশের উন্নয়নে, বাংলাদেশের প্রতিটি অঙ্গনে কোনো না কোনোভাবে অনবদ্য অবদান রেখেছেন। দেশের সর্বত্র তার পদচিহ্ন রেখে গেছেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে বুঝতে হলে আবেদকে বোঝা দরকার। আমরা যদি আবেদ ভাইকে ভুলে যাই তাহলে তা হবে নিজেদের জীবনকে ভুলে যাওয়ার মতো।”

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস বলেছেন, “তার (আবেদ) চিন্তাভাবনার গভীরতা এবং শক্তি সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক।”

স্যার আবেদের বিষয়ে জানতে একটি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা পরবর্তী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করবে। এমনটি জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “তিনি আসলে এনজিওর সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আমাদের তা উপলব্ধি করা দরকার।”

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, “আবেদ ভাই কিডনি ডায়ালাইসিস কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলো, তাতে সমর্থন করেছেন।”

ফজলে হাসান আবেদের নামে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন জানিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, “আবেদ ভাইয়ের হাসি ছিলো অনুপ্রেরণামূলক। আমি ভাবতেই চাই না যে ফজলে হাসান আবেদ মারা গেছেন। তিনি বেঁচে আছেন, হাসছেন এবং অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন।”

ক্যাম্পেইনিং ফর পপুলার এডুকেশনের (সিএএমপিই) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, “স্যার আবেদ বহু সংস্থাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন এবং সিএএমপিই এর মধ্যে অন্যতম।”

তিনি বলেন, “তিনি ছিলেন আমাদের জন্য বটবৃক্ষের মতো। আমরা তার দেখানো পথ অনুসরণ করে যাবো।”

হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের পাবলিক পলিসির প্রভাষক ড. মার্থা চ্যান বলেছেন, “স্যার ফজলে হাসান আবেদকে সারা পৃথিবী উন্নয়ন জগতের এক মহানায়ক ও মহান ব্যক্তি হিসেবে স্মরণ করবে।”

তিনি বলেছেন, “অল্প কয়েকজনের মতো আবেদ একজন নীরব বিপ্লবী ছিলেন। যিনি তার সৃজনশীল এবং বিস্তৃত স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত করতে পেরেছিলেন।”

ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারম্যান আমিরাহ হক বলেছেন, “ব্র্যাক গত পাঁচ বছর ধরে বিশ্বের সেরা এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।”

এনক্লুড ক্যাপিটাল ইউকে লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লরি জে স্প্যাংলার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এরাম মারিয়াম, ব্র্যাকের ড. চন্দ্র শেখর শাহা ও শুখেন্দ্র কুমার সরকার, স্যার ফজলে হাসান আবেদের ছেলে শামেরান আবেদ, কন্যা তামারা হাসান আবেদ, ভাতিজা আনাদিল হোসেন এবং তানিয়া মুর্শেদ প্রমুখ স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ড. মঈন খান ও আবুল হাসান চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, আইনবিদ ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার, অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স পেনি মর্টন, ডিএফআইডি-বাংলাদেশের প্রধান জুডিথ হারবার্টসন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Consensus key to take Bangladesh forward: Yunus

"We are now working to bring our beloved Bangladesh back onto the path of equality, human dignity, and justice," he said

1h ago