বান্দরবান

৩ কোটি টাকায় পৌনে ২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ‘লাগামহীন অনিয়ম’

রাস্তা নির্মাণে বালুর পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়ের কাটা মাটি। ছবি: স্টার

বান্দরবানের থানচি উপজেলার ৩ নম্বর সদর ইউনিয়নে থানচি বাজার-আপ্রুমং পাড়া সড়ক থেকে রবার্ট পাড়া-মায়ারাম পাড়া-হানারাম পাড়া পর্যন্ত এক কিলোমিটার ৭৭০ মিটার পিচ ঢালা রাস্তা নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

এক ঠিকাদার কাজ পেলেও কাজটি করছে আরেকজন, ব্যবহার হচ্ছে অতি নিম্নমানের নির্মাণ-সামগ্রী। এ ছাড়া, রাস্তা যতটুকু হওয়ার কথা ততটুকু নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

সম্প্রতি সরেজমিনে নির্মাণাধীন রাস্তাটি দেখতে গেলে কোনো প্রকৌশলী এসেছেন ভেবে অভিযোগ দিতে আসেন স্থানীয়রা। তারা জানান, রাস্তা তৈরির সময় সব মাটির স্তূপ তাদের ঘরের দেয়ালে এসে পড়েছে। বৃষ্টি হলে সব মাটি ঘরে ঢুকে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

রাস্তার কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মাণাধীন রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ঝিরি-ঝরনার ভাঙা পাথর। ছবি: স্টার

রাস্তার পাশে ঝিরি-ঝরনার ভাঙা পাথরের স্তূপ আর ব্যবহার অযোগ্য নিম্নমানের ইটের টুকরো দেখা গেছে।

সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বান্দরবান কার্যালয় থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এম ট্রেডার্সকে এই সড়কটি নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়।

কার্যাদেশ অনুযায়ী, 'অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩' নামের প্রকল্পে এ কাজের নাম থানচি-রবার্ট পাড়া-মায়ারাং পাড়া-হানারাম পাড়া রাস্তা নির্মাণ। কাজের মেয়াদ ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত।

কাজ শুরুর আগে নির্মাণ-সামগ্রীর ল্যাবরেটরি টেস্ট করার কথা। কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রমিক, পথচারী ও যানবাহনের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে কার্যাদেশে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে ইটভাটায় বাজেয়াপ্ত বড় বড় ইটের টুকরো। বালুর পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়ের কাটা মাটি। প্রথম শ্রেণির ইট ব্যবহার না করে দেওয়া হয়েছে ইটভাটার অকেজো ইট।

এ ছাড়া, ঠিকাদারের নাম, প্রকল্পের নাম, প্রাক্কলিত ব্যয়, চুক্তির মূল্য, কাজের শুরু ও মেয়াদ লিখে সাইনবোর্ড টাঙানোর কথা থাকলেও সেটা নেই।

রাস্তার পাশে বাড়িঘরের বেড়ার ওপর মাটি পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শোভন ত্রিপুরা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তা তৈরির সময় মাটি স্তূপ করে আমাদের ঘরের দেয়ালের সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়েছে। এখন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অভিযোগ করা হলে ঠিকাদার ঘরের পাশে রড দেওয়া ছাড়া সেফটি দেয়াল তৈরি করে দেবে বলেছে। কিন্তু রড ছাড়া দেয়াল করে দিলে আরও বড় ঝুঁকি হবে।'

স্থানীয় বেনেডিক ত্রিপুরা বলেন, 'আমরা শুনেছি মায়ারাং পাড়া পর্যন্ত রাস্তা হবে। কাগজে-কলমে আছে হানারাম পাড়া পর্যন্ত। প্রটেকশন ওয়ালে ঝিরির পাথর ভেঙে ব্যবহার করা হয়েছে। আপত্তি জানিয়েও লাভ হয়নি।'

তিনি বলেন, 'আমাদের এলাকায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের তিনটি পাড়া। রবার্ট পাড়ায় ৩৪, মায়ারাম পাড়ায় ২৪ ও হানারাম পাড়ায় ৩৮ পরিবারের বসবাস। আমাদের এতদিন পায়ে হেঁটে বাজারে ও স্কুলে যেতে হতো। তিন পাড়ার মধ্যকার সংযোগ রাস্তা হচ্ছে বলে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তার কাজের মান দেখে হতাশ হয়েছি। যেভাবে কাজ করেছে তাতে এক বছর যেতে না যেতেই রাস্তাটা ভেঙে যাবে বলে মনে হচ্ছে।'

রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে ইটভাটায় বাজেয়াপ্ত বড় বড় ইটের টুকরো। ছবি: স্টার

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মায়ারাং পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, কোন এলাকা পর্যন্ত রাস্তা হবে তারা তা জানেন না। তাদের পাড়া পর্যন্ত এসে রাস্তা থেমে গেছে। কিন্তু, হানারাং পাড়া পর্যন্ত কাজ করার কোনো লক্ষণ তারা দেখছেন না।

রবাট পাড়ার শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক কাজ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। নিম্নমানের ইটের টুকরো, ঝিরির পাথর, পাহাড়ের লাল মাটি কেন ব্যবহার হচ্ছে—জিজ্ঞেস করা হলে শ্রমিকরা জানান, ঠিকাদার যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, তারা সেভাবে কাজ করেছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে থানচি উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) এমদাদুল হকের সঙ্গে ১২ মার্চ কথা হলে তিনি বলেন, 'তিনজন ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সরকারি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। আমি নিজেও অফিসের কাজে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটিতে গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে ঠিকাদার হয়ত নিম্নমানের মাল দিয়ে কাজ করেছে।'

রাস্তার ছবি দেখালে তিনি বলেন, 'বালুর ফিলিং এবং ইটের খোয়া যেভাবে দেওয়ার কথা, সেভাবে দেওয়া হয়নি। এক নম্বর ইট এবং ঝাংকা বালু (রাজবিলা ঝাংকা ইউনিয়ন এলাকার বালু) দিয়ে রাস্তার কাজ করার কথা। কিন্তু সেরকম মানসম্মত কাজ একবারেই করেনি। এটা খুবই নিম্নমানের কাজ।'

পরে তিনি ঠিকাদারকে ফোন করে কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ না করা পর্যন্ত ঠিকাদার কাজ শুরু করতে পারবেন না বলে জানানো হয়। প্রকৌশলী নিজেই রাস্তা পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান।

এদিকে রবার্ট পাড়ার বাসিন্দারা জানান, ১৩ মার্চ সকাল থেকে ঠিকাদার আবার কাজ শুরু করেন। শ্রমিকদের নিষেধ করা হলে তারা ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা পায়নি বলে জানায়।

কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান এম এম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মং এ মারমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লাইসেন্স আমার, কিন্তু কাজটা আমি করছি না। ঠিকাদার আনিসুর রহমান সুজন কাজটি করছেন। কাজের মান সম্পর্কে তিনি বলতে পারবেন।'

জানা গেছে, ঠিকাদার সুজনের ভাই মেহেদী হাসান কাজের দেখাশোনা করছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রমিকরা ভুল করে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে আমার ধারণা। কাজটি আমাদের ব্যক্তিগত লাইসেন্সে নয়। জেলা ও থানচি উপজেলার এলজিইডি কর্মকর্তাদের অনুরোধে এম এম ট্রেডার্সের কাছ থেকে কাজটি বুঝে নিয়েছি আমরা।'

এসব বিষয়ে কথা বলতে ১৩ মার্চ দুপুরে এলজিইডি বান্দরবান জেলা কার্যালয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ জিয়াউল হক ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। টেলিফোনে তিনি জানান, বাইরে প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে গেছেন।

নির্মাণাধীন রাস্তার বিষয়ে জানতে চাইলে অফিসে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী জামাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

জামাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাজ তো ভালোই চলেছে। তবে শুরুতে কাজটি নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল। কাজটি পেয়েছিল এম এম ট্রেডার্সের ঠিকাদার আতাউর রহমান রিপন। সে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করায় আনিসুর রহমান সুজনকে দেওয়া হয়। পরে সুজন নিজে না করে তার ভাই মেহেদী হাসানকে দায়িত্ব দিয়েছে বলে শুনেছি।'

সহকারী প্রকৌশলী জামাল উদ্দিন নিজেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি বলে জানান।

তবে ঠিকাদারের পক্ষ নিয়ে তিনি বলেন, 'থানচিতে একমাত্র ঠিকাদার সুজনের নিজস্ব ইটভাটা আছে। তাই যেকোনো প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে সুজনের পক্ষে কাজ করা সহজ। অন্য ঠিকাদাররা সহজে এসব কাজ করতে পারবে না। তবে কাজের মানের বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।'

নির্মাণাধীন রাস্তার ছবি দেখালে তিনি থানচির এলজিইডি প্রকৌশলী ও ঠিকাদারকে ফোন করে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।

এরপরেও ১৪ মার্চ সকালে যথারীতি কাজ চলেছে বলে জানান রবাট পাড়া বাসিন্দারা।

১৪ মার্চ নির্মাণাধীন রাস্তাটি দেখে ডেইলি স্টারকে এলজিইডির থানচি উপজেলা প্রকৌশলী এমদাদুল হক বলেন, '৩১ বছরের চাকরি জীবনে সরকারি টাকার এমন অপচয় আর দেখিনি।'

বিষয়টি থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুনকে জানানো হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা খবর নিয়ে দেখি। যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। যারা এ কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

12h ago