গ্রামের দরিদ্র নারীদের স্বপ্ন বোনার কারিগর আফরোজা আঁখি 

কারখানায় এক কর্মীকে কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন আফরোজা আঁখি। ছবি: স্টার

একসময় সমাজের সবাই তাকে অবহেলা করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও জোটেনি চাকরি। অর্থের অভাবে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে অনেক সময়। 

সন্তানদের জন্য সামান্য দুধ যোগাড় করতে না পেরে ফিডারে পানির সঙ্গে বিস্কুট মিশিয়ে সন্তানকে খাইয়ে কান্না থামিয়েছেন।

সব বঞ্চনা-অবহেলা আর অভাবের সাগর পাড়ি দিয়ে পাবনার সুজানগর উপজেলার ভায়না গ্রামের আফরোজা আক্তার আঁখি এখন ওই গ্রামের বঞ্চিত নারীদের মুক্তির অবলম্বন হয়ে উঠেছেন।  

কঠোর মনোবল, পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে তিনি দুর্গম গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেছে হস্তশিল্প কারখানা, যেখানে তার মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত ও বঞ্চিত নারীরা কাজের সুযোগ পেয়েছে। 

আর্থিক অভাব আর সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে লড়াই করে চলা এক সময়ের ভাগ্য বিড়ম্বিত এই নারী এখন নিজের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি গ্রামের হতদরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পুরো জেলায়। 

তার কারখানা থেকে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেই এখন কাজ শুরু করেছে। 

নিভৃত গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি পাটের ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, ফুলের টব, শো-পিস দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন ইউরোপের মাটিতে জায়গা করে নিয়েছে। আফরোজা আক্তার আঁখিও পেয়েছেন সফল উদ্যোক্তার খেতাব।

আঁখির কারখানায়া তৈরি পাটের ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, শো-পিস এখন বিদেশের বাজারেও যাচ্ছে। ছবি: স্টার

আঁখির সফলতার এ পথ মসৃণ ছিল না। ৩৩ বছরের জীবনে গত ১০ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে গ্রামের সাধারণ এই নারীকে। 

আঁখির বাবা গ্রামের দরিদ্র মানুষ হলেও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন।

শুরু থেকেই আঁখি লেখাপড়ায় মনযোগী ছিলেন। স্কুল-কলেজের গণ্ডি সফলতার সঙ্গে পার করে ভর্তি হন স্নাতকে পলিটিক্যাল সায়েন্স বিষয়ে। মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়।

আঁখি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করার ইচ্ছা থাকলেও, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। 

'শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি না খাইয়ে রাখা হতো। ক্ষুধার জ্বালায় একপর্যায়ে স্বামীকে ছেড়ে (ডিভোর্স দিয়ে) বাবার বাড়িতে চলে আসি,' বলেন তিনি। 

সে সময় গ্রামের সবাই তাকে নিয়ে নানা কথা বলেছে। তবে সবকিছুকে পেছনে ফেলে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তারপর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও জোটেনি সামান্য একটি চাকরি। 

একসময় আবার বিয়ে করেন। স্বামী গ্রামের সাধারণ ইলেকট্রিশিয়ান আব্দুল কুদ্দুস সবসময় স্ত্রীর পাশে থেকেছেন। পরে আঁখি ভর্তি হন আইন কলেজে। পাশও করেন ভালোভাবে। 

এর মাঝে তাদের দুটি ছেলে সন্তান হয়। উন্নত জীবনের আশায় কাজের জন্য দেশের মাটি ছেড়ে কাতার পাড়ি জমান কুদ্দুস। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালেই ফিরে আসতে হয় তাকে। 

আঁখি আইন পাশ করে এক আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু, করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
করোনার দীর্ঘ থাবায় কর্মহীন পরিবারটিতে দুই বেলা খাবার জোটেনি। দুধের জন্য কাঁদতে থাকা শিশুকে ভুলিয়ে রাখতে গরম পানির সঙ্গে বিস্কিট মিশিয়ে খাইয়েছেন। 

সে সময় হাতের কাজ করার কথা ভাবেন আঁখি। প্রথমে পাটের ম্যাট দেখে সেটা তৈরির চেষ্টা করতে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, ইউটিউবের ভিডিও দেখে একসময় সে কাজ শিখে নেন। পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বানাতে শুরু করেন ভিডিও দেখে। প্রতিবেশীদের কাছে সেসব বিক্রিও করেন, তবে সেটা বাণিজ্যিকভাবে হচ্ছিল না।

পরে হস্তশিল্পের বাজার ধরতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিডি ক্রিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আঁখি। তাদের নমুনা দেখান। কিন্তু কারখানা না থাকায় কাজ পেতে বেগ পেতে হয়। অনেক অনুরোধের পর ১০ পিস স্যাম্পলের অর্ডার পান আঁখি। 

সুজানগরের ভায়না গ্রামে আঁখির কারখানায় কাজ করছেন নারী কর্মীরা। ছবি: স্টার

তবে সে কাজ করার মতো অর্থও তার কাছে ছিল না। কোনোভাবে দুই হাজার টাকা ধার করে কাঁচি, দড়ি কিনে মেশিন ছাড়া হাতের কাজ শুরু করেন।

সময়মতো চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করায় তার প্রতি আগ্রহ দেখায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রথমে ছোট ছোট অর্ডার নিয়ে ঘরেই কাজ শুরু করেন, নিজে গ্রামের আরও কয়েকজন নারীকে কাজ শিখিয়ে তাদের অর্ডার দিয়ে কাজ বুঝে নিতেন। এভাবে এক বছরে প্রায় লাখ টাকা আয় করেন। সেসময় ছোট একটি কারখানা করার স্বপ্নও দেখেন। 

এ সময় আঁখি ১০টি মেশিন কিনে ছোট একটি কারখানা তৈরি করেন। এজন্য প্রায় ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। নিজের জমানো এক লাখ টাকার সঙ্গে স্বামীর জমি বন্ধক রেখে দুই লাখ টাকা, আর দুই লাখ টাকা ঋণ করে শুরু করেন তার ছোট কারখানা, শুরু হয় তার স্বপ্নের পথ চলা। 
ধীরে ধীরে কারখানায় উৎপাদন বাড়তে থাকে, আঁখির হস্তশিল্প পণ্য বিদেশের বাজারে বিক্রি হতে থাকে। 

চাহিদা বাড়ায় একসময় কারখানার পরিসর বাড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি। ২০২৩ সালে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সঙ্গে ব্যবসার জমানো টাকা যোগ করে ৪০টি মেশিন দিয়ে দুর্গম গ্রামে শুরু করেন হস্তশিল্পের নতুন কারখানা। 

তার এ কারখানায় বর্তমানে প্রায় ৪০ জন কাজ করেন, যারা গ্রামের সাধারণ দরিদ্র নারী। আঁখির এ উদ্যোগ গ্রামের দরিদ্র নারীদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। 

এ কারখানায় কর্মরত ভায়না গ্রামের অনিতা সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানকে নিয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে সংসার চালাতে হত। গ্রামে কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় অর্থাভাবে সংসার চলছিল। এ সময় আঁখির কারখানায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেই উপার্জন করতে পারছি।'

কারখানার আরেক কর্মী বিধবা রিমা খাতুন বলেন, 'এই গ্রাম থেকে নারীরা কারখানায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করবে, আগে কেউ ভাবতে পারেনি। গ্রামের এই নারীদের বাইরে কাজ করার সুযোগও নেই।' 

গ্রামে থেকেই কাজ করে সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে পেরে অনিতা ও রিমার মতো অনেকেই এখন নিজেদের উপার্জনে গর্ব অনুভব করে। 

আফরোজা আঁখি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য অনেকের দ্বারে ঘুরেছি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাইনি। এখন ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি, ফিরিয়েছি সংসারের সচ্ছলতা।'

আঁখি জানান, তার কারখানায় গ্রামের নারীদের তৈরি করা হস্তশিল্প এখন ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে। 

তিনি বলেন, 'প্রতি সপ্তাহে প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার পণ্য বাজারে সরবরাহ করে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় হচ্ছে আমার ছোট এই কারখানা থেকে। নিভৃত গ্রামের দরিদ্র অনভিজ্ঞ নারীদের তৈরি করা পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে গ্রামের নারীরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছেন।'

'শুধু নিজে ভালো থাকতে চাইনি। গ্রামের আর কোনো নারীকে যেন সমাজে বঞ্চিত হয়ে বেঁচে থাকতে না হয়, সেজন্য কাজের পরিধি আরও বাড়াতে চাই। এজন্য সরকারের সহযোগিতা চাই,' যোগ করেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Commercial banks’ lending to govt jumps 60%

With the central bank halting direct financing by printing new notes, the government also has no option but to turn to commercial banks to meet its fiscal needs.

10h ago