চট্টগ্রাম জেলায় একের পর এক ডাকাতি, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রাইভেটকারের গ্লাস ভেঙে যাত্রীদের জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম জেলায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ডাকাতির ঘটনা। জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং অর্থনীতির 'লাইফ লাইন' খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন মূল অপরাধীরা। 

এমনকি পুলিশ পরিচয়ে তল্লাশির নামেও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। বার বার ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও তদন্তের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগীরা।

শুধু বুধবার রাতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের টেরিয়াইল এলাকায় যানবাহন আটকে গাড়িতে হামলা চালিয়ে লুট এবং বড়দারোগারহাট এলাকার উত্তর ফেদাইনগরে এক সাংবাদিকের বাড়িসহ তিনটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে জিনিসপত্র লুটে নিয়েছে ডাকাতদল। তবে এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকেই সনাক্ত করতে পারেনি জেলা পুলিশ। 

মহাসড়কে ডাকাতির সময় হামলার শিকার হয়েছেন মিরসরাইয়ের সেবা হাসপাতাল লিমিটেডের পরিচালক আব্দুর রহমান। চট্টগ্রাম থেকে মিরসরাইয়ে যাওয়ার পথে তার প্রাইভেটকারের গ্লাস ভেঙে তাকে জিম্মি করে তাদের জিনিস লুট করে দেশীয় অস্ত্র বহন করা সাত থেকে আট জনের দল।

এর আগে, গত সোমবার সাতকানিয়ার পশ্চিম বাজালিয়া বড়দুয়ারা এলাকায় দুটি স্থানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে স্থানীয় মোসলেমের বাড়িতে সশস্ত্র ডাকাত দল গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিস লুটে নেয়। সেখানে আসার আগে তারা নাছির নামে স্থানীয় আরেকজনের ঘরে হামলা চালায়।

থানা ও জেলা পুলিশের সূত্র মতে, গত একমাসে চট্টগ্রামে আটটিরও বেশি ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এরমধ্যে বোয়ালখালী, সাতকানিয়া এবং সীতাকুণ্ডে ঘটনা বেশি।

গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যম শাকপুরার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ আমানত নামে একটি ভবনে পুলিশ পরিচয়ে গণ-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ১০-১২ জনের ডাকাতদল ভবনের সাত পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ১৬টি মোবাইল, ৬ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ২০ হাজার টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় বলে গণমাধ্যমকে জানান ভবনের মালিক মো. সাবের। তিনি জানান, ডাকাতদল পুলিশ পরিচয় দেওয়ায় দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ডাকাতি বা দস্যুতার ঘটনা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা থানার জন্য ডিস-ক্রেডিটের বিষয়। ডাকাতির মামলা নেওয়া মানে ওই থানার সার্বিক আইনশৃঙ্খলার অবস্থা শোচনীয়। তাই থানার 'র‍্যাংক' ধরে রাখতে ডাকাতির মামলা ফিরিয়ে দেওয়া হয় বা চেপে রাখা হয়। এটা শুধু থানায় করা হয় বিষয়টি এমন নয়, অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এগুলো চেপে যান।

আবার আসামির খোঁজ পেলেও অভিযানে যাওয়ার আগে তথ্য-ফাঁসের ঘটনা আছে, যার কারণে সার্বিকভাবেই আসামি ধরা দুষ্কর হয়ে পড়ে, বলেন একাধিক কর্মকর্তা।

সীতাকুণ্ড সার্কেলে কাজ করে আসা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় মহাসড়কে ডাকাতির শিকার হলেও পুলিশি ঝামেলার কারণে অনেকে বলতে চান না, তাই অনেক ঘটনা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

মহাসড়কে ডাকাতির শিকার আব্দুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি শহর থেকে মিরসরাই যাচ্ছিলাম। ড্রাইভারসহ গাড়িতে আমরা তিনজন ছিলাম। আমার সামনে-পেছনে পণ্যবাহী ট্রাক ছিল। রাত ১২টার দিকে রাস্তায় যানজটে পড়লে পাশের ঝোপ থেকে বের হয়ে আসে দেশীয় অস্ত্র বহনকারী ডাকাত দল।'

'তারা গাড়ির সব গ্লাস ভেঙে ফেলে আমার মিস্ত্রির কাছ থেকে মোবাইল ও আমাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। তারা বার বার আমাদের গাড়ির দরজা খোলার জন্য বলছিল। আমরা তা করিনি। একপর্যায়ে আমরা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এসে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ঘটনাটি জানাই। ঘটনার সময় অনেকে দেখলেও কেউ ভয়ে গাড়ি থেকে নামেননি', বলেন তিনি।

এর আগেও, গত বছরের আগস্ট মাসে সীতাকুণ্ডের পন্থিছিলা এলাকায় মহাসড়কে চলাচলের সময় ১০টি গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

বড়দারোগারহাট এলাকায় ডাকাতি সংগঠিত হওয়া বাড়ির একটি চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক হাসান ফেরদৌসের। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাত ৩টার দিকে ৭-৮ জনের সশস্ত্র দল বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা বাড়ির কেয়ারটেকার মো. রফিক মিয়াকে মারধর করে, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। পরে ঘরের দরজার তালা ভেঙে আলমারী খুলে তাণ্ডব চালায়। অবশ্য বাড়িতে কেউ থাকেন না, তাই আমরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়নি।'

'সেখান থেকে বেড়িয়ে ডাকাত দল পার্শ্ববর্তী আমান উল্লাহ মেম্বার ও নাদেরুজ্জামানের বাড়িতে লুটপাট করে। সেখানেও তারা অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইলসহ কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুট করেছে, আমরা পুলিশকে জানিয়েছি', বলেন তিনি।

'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ডাকাতি নতুন নয়'

বুধবার রাতে মহাসড়ক ও উপজেলায় ডাকাতির ঘটনা জানেন না বলে জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ডাকাতির ঘটনাগুলো অবগত নই। আমাকে ওসি কিছু জানাননি।'

পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনাগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'র‍্যাব-পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনা নতুন কিছু নয়। এগুলো আগেও হয়েছে। আমাদের টিম ঘটনার পরপর আসামিদের ধরার চেষ্টা করছে। তদন্তে সব বের হবে।'

হাইওয়ে পুলিশের ভাষ্য

কুমিল্লা হাইওয়ে রিজিওয়েনের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. খাইরুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সীতাকুণ্ডে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা আমার জানা নেই। আর ডাকাতির মামলা তদন্ত করে স্থানীয় থানা পুলিশ। আমরা শুধু মহাসড়কে দুর্ঘটনা কিংবা মাদক পেলে সেই মামলাগুলো তদন্ত করি।'

'আমরা ফেনী পর্যন্ত মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যামেরা বসিয়েছি। ডাকাতির ঘটনা অনেকগুলো ডিটেক্ট হয়েছে। ফেনীর পরও আমাদের কাজ চলমান। তবে স্থানীয় থানা আমাদের কাছে সাহায্য চাইলে আমরা তাদের সাহায্য করব। এ ছাড়া, আমরা আমাদের প্রধান বরাবর মহাসড়কে ডাকাতি, হত্যা কিংবা অন্যান্য মামলা তদন্তের অনুমতি চেয়েছি', বলেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

6h ago