নিরাপত্তার বেড়াজালে স্বাধীনতাটাই হারিয়ে গেছে: প্রধানমন্ত্রী

‘নিরাপত্তা বেষ্টনীর ঘেরাটোপে এভাবে মেলায় আসার কোনো মজা নেই। কারণ, নিরাপত্তার বেড়াজালে স্বাধীনতাটাই হারিয়ে গেছে। এখানে আসলে মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা, স্কুল জীবনের কথা।’
উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৬ জনকে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩’ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি

অমর একুশে বইমেলায় উপস্থিত থাকতে পেরে খুব আনন্দিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসায় প্রাণের মেলার এই উচ্ছ্বাসে সেভাবে আগের মতো আর মিশতে পারেন না তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'নিরাপত্তা বেষ্টনীর ঘেরাটোপে এভাবে মেলায় আসার কোনো মজা নেই। কারণ, নিরাপত্তার বেড়াজালে স্বাধীনতাটাই হারিয়ে গেছে। এখানে আসলে মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা, স্কুল জীবনের কথা।'

তিনি জানান, '৮১ সালে দেশে ফিরতে পারার পর থেকে তিনি প্রতিবারই আসতেন বইমেলায়। এই প্রাঙ্গণের সঙ্গে তিনি এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যেখানে এখন আর সেই স্বাধীনতাটা নেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'জানি না কবে আবার স্বাধীনতাটা পাবো। তবুও মানুষের জন্য যদি কাজ করতে পারি, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, দারিদ্র্য বিমোচন করে মানুষকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ উপহার দিতে পারি—সেটাই আমাদের লক্ষ্য।'

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে মাসব্যাপী 'অমর একুশে বইমেলা ২০২৪' উদ্বোধন কালে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, 'আমি সকল প্রকাশককে মুদ্রণ প্রকাশনার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রকাশক হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। যাতে আমরা আমাদের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিশ্বমঞ্চেও দ্রুত পৌঁছে দিতে পারি।'

'এখন আমাদের যুগটা হয়ে গেছে আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ', এই যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশ্বায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত।

'সেজন্য আমি আমাদের প্রকাশকদের অনুরোধ করবো, এখন প্রকাশকদের শুধু কাগজের প্রকাশক হলেই হবে না, ডিজিটাল প্রকাশক হতে হবে। কাজেই, ডিজিটাল প্রকাশক হলে এটা দ্রুত শুধু আমরা আমাদের দেশে না বিদেশেও সকলের কাছে পৌঁছাতে পারবো এবং অন্যান্য ভাষাভাষীরাও পড়বে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, কাজেই সেদিক থেকে আমার মনে হয়, একটু মন মানসিকতার পরিবর্তন করে আধুনিক প্রযুক্তিটাও নিজেদের রপ্ত করতে হবে। লাইব্রেরিগুলোতে পড়ার জন্য থাকবে, আবার অডিও ভার্সনটাও যেন থাকে। এটারও প্রয়োজন আছে। সেটা থাকলে অনেকের সুবিধা, শোনার মাধ্যমে জানতে পারবে। সেই ব্যবস্থাটাও আমাদের নেওয়া উচিত।

যদিও বই পাঠের আনন্দের অনেকটাই ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়ার মধ্যে থাকে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, বইয়ের প্রকাশনা থাকবে। কারণ একটি বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টে পড়ার মধ্যে একটি আলাদা আনন্দ আছে। তবে, আজকালকার যুগে ছেলেমেয়েরা আবার ট্যাবে বই পড়ে, আবার ল্যাপটপ বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের সাহায্যে বই পড়ে। যদিও আমরা তাতে মজা পাই না।

প্রধানমন্ত্রী অনুবাদ সাহিত্যের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে আমরা এগিয়ে যাব। আর অনুবাদ সাহিত্যে আমি বাংলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাই—এক সময় অনেকে দাবি তুলেছিলেন অনুবাদ করা যাবে না কিন্তু আমি অনুবাদের পক্ষে। অনুবাদ যদি না হয় তাহলে এত ভাষা আমরা কোথা থেকে জানব। কাজেই যেকোনো ভাষাকে অনুবাদ করে এক একটা দেশকে জানতে হলে, জাতিকে জানতে হলে, সংস্কৃতিকে জানতে হলে আমরা ভাষার মধ্যে দিয়ে জানতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগৃহীত রচনা: দ্বিতীয় খণ্ড' এবং 'প্রাণের মেলায় শেখ হাসিনা' (বাংলা একাডেমিতে শেখ হাসিনার গত ২০ বারের ভাষণের সংকলন) শীর্ষক দুইটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

এ ছাড়া, উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৬ জনকে 'বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩' প্রদান করেন।

পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন—শামীম আজাদ (কবিতা), ঔপন্যাসিক নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী (কথা সাহিত্য), জুলফিকার মতিন (প্রবন্ধ/গবেষণা), সালেহা চৌধুরী (অনুবাদ), নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক (যৌথভাবে নাটক ও নাট্য সাহিত্য), তপঙ্কর চক্রবর্তী (শিশু সাহিত্য), আফরোজা পারভিন এবং আসাদুজ্জামান আসাদ (মুক্তিযুদ্ধের উপর গবেষণা), সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং মো. মজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধুর উপর গবেষণা), পক্ষীবিদ ইনাম আল হক (পরিবেশ/বিজ্ঞান ক্ষেত্র), ইসহাক খান (জীবনী) এবং তপন বাগচী ও সুমন কুমার দাস (যৌথভাবে লোক কাহিনী)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বইমেলা ঘুরে দেখেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল যেটা এখন করতে পেরেছে। আগামীর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। কাজেই স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হবে সর্বক্ষেত্রেই। আমাদের স্মার্ট জনগোষ্ঠী হবে, স্মার্ট গভর্মেন্ট হবে, স্মার্ট ইকোনোমি হবে এবং স্মার্ট সোসাইটি হবে। এই স্মার্ট সোসাইটি করতে গেলে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুই আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের সাহিত্য ও রচনাবলী অত্যন্ত প্রাণবন্ত, জীবনভিত্তিক এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। কাজেই, এগুলো আমরা যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব বাঙালি, বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতি তত বেশি বিশ্বের দরবারে বিস্তার লাভ করবে। সবাই সেভাবেই কাজ করবেন, সেটাই আমি চাই।

আগামীতে আরও আন্তর্জাতিক সাহিত্যিকদের নিয়ে এসে বিশেষ করে বাংলা ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করেন তাদেরকে এনে আরও বর্ণাঢ্য সাহিত্য মেলা করার ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী।

কোমলমতি শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে সরকার প্রধান বলেন, বই পড়ার অভ্যাসটা সবার থাকা উচিত। এটা বাবা-মা যদি ছোটবেলা থেকে শেখায় তাহলেই কিন্তু এই বই পড়ার অভ্যাসটা হবে।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে '৯৬ থেকে ২০০১ পরবর্তী মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে না পারায় বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার পাদপিঠ হয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ যে খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন—সে কথারও উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দ্বিতীয়বার যখন আমি সরকারে আসি, সেটা প্রতিষ্ঠা করি। এখন সেখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে, অনেক ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে সেখানে জানা যায়। এটা যেন আরও সমৃদ্ধ হয়, সেটা আমি চাই।'

তিনি তার সরকারের অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'র স্বীকৃতি এনে দেওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় কানাডা প্রবাসী রফিক এবং সালামসহ 'ভালবাসি মাতৃভাষা' নামের সংগঠনের অবদানের কথাও স্মরণ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা এসেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা দাবি দিবসের ধর্মঘট চলাকালে তিনি গ্রেপ্তার হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ করে তিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন জানিয়ে জাতির পিতার কন্যা বলেন, বাবার পথ অনুসরণ করে এ পর্যন্ত যত ভাষণ দিয়েছি, অন্তত ১৯-২০ বার হবে। আমি কিন্তু প্রতিবার বাংলায় ভাষণ দেই।

তিনি বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। '৭৪ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি দেওয়ার পর প্রথম সেখানে ভাষণ দিতে যান তখন তিনি বাংলাতেই ভাষণ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। রবি ঠাকুর যেমন তার কবিতার মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে এসেছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তার যে বক্তব্য সেটাই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

Comments

The Daily Star  | English

8 killed as private car falls into roadside canal in Pirojpur

At least eight people, including four members of a family, died after a private car plunged into a roadside canal in Pirojpur early today

2h ago